ভূমিকম্প ! ভূমিকম্প !
নিশির আজ কাল কি যেন হয়েছে । কোন কাজে যেন ওর মন বসে না । বই নিয়ে বসে থাকে অথচ একটা কিছুও মাথায় ঢোকে না । আবার টিভি চালিয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকে কিন্তু কি প্রোগ্রাম হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই যেন ও দেখছে না ।
তেমনি সন্ধ্যা বেলা যখন প্রথম বারের মত ভূমিকম্পে পুরো শহর কেঁপে উঠল নিশি বুঝতেই পারলো না যে ভূমিকম্প হচ্ছে । ও তখন অপন ভূবণেই আছে । নিজের চিন্তায় ডুবে আছে । আবার কি চিন্তা করছে তাও জানে না ! কেবল একমনে কোন কিছুর দিকে তাকিয়ে আছে অথবা চোখ বন্ধ করে কিছু ভাবার চেষ্টা করছে !!
নিশি কখনই এমনটা ছিল না । সবসময় পড়াশুনা নিয়ে সিরিয়াস থাকা একটা মেয়ে । পড়াশুনার বাইরে যে অন্য কিছু ভাবতেই পারে না । অবশ্য ভাবার খুব একটা অবকাশও নেই ।
নিশির মা সুলতানা বেগম খুব কড়া টাইপের মহিলা । নিশি আর আর ওর ছোটভাই নিলয়কে উনি কড়া শাসনে রেখেছেন । তার কথামত উঠাতেন আবার তার কথা মত বসাতেন !
নিশির কোন অভিযোগ ছিল না । নিশি তার মার সব শাসন চুপচাপ মেনে নিয়েই ভাল ছিল । সব কিছু চলছিল আপন গতিতেই , সাভাবিক ভাবেই কিন্তু পাশের বাসার ঐ ফাজিল ছেলেটা কেমন করে যেন সব কিছু এলোমেলো করে দিল ।
ছেলেটা কেমন করে যেন তাকায় ! নিশির পুরো শরীর যেন কেঁপে ওঠে ! এমন না যে ছেলেটার তাকানোর ভিতর কোন খারাপ ভাব আছে । কিন্তু নিশি কিছুতেই বুঝতে পারে না । আবার নিজের মনকেও শান্ত করতে পারে না ।
আর ছেলেটার সাথে চোখাচোখি হলে তো আর কোন কথা নাই । নিশি কেমন যেন ফ্রিজড হয়ে যায় । কিছুতেই চোখ ফেরারে পারে না । নিশি অনেকবার চোখ না ফেরানোর কারন অনুসন্ধান করতে চেয়েছে , বারবার নিজেকে প্রশ্ন করছে কিন্তু কোন উত্তর পাই নি ।
শুরুটা খুব সাধারন ভাবে হয়েছিল । নিশি ঐ দিন কলেজে যাবার জন্য দাড়িয়ে ছিল বাড়ীর সামনে । নিশির মা নামতে দেরি করছিল । এমন সময় নিশির পাশে এসে ছেলেটি দাড়াল । তারপর একটা আইসক্রিম এগিয়ে দিয়ে বলল
-তুমি চকবার পছন্দ কর , তাই না ?
নিশি খানিকটা অবাক হয়ে তাকাল ছেলেটার দিকে । ও চকবার পছন্দ করে এটা ছেলেটা কিভাবে জানবে ! ছেলেটা খুব বেশিদিন আসে নি এখানে !
-নাও !
-না আম্মু বকবে ।
-তোমার আম্মু তো নেই এখন । এক কামড় নাও অন্তত ।
নিশি মাথা নাড়াল ।
-আপনি চলে যান । আম্মু দেখলে আমাকে বকবে । প্লিজ চলে যান । ছেলেটির মন খারাপ হল । যতটা উজ্জলতা নিয়ে ছেলেটা এসেছিল যাবার সময় মুখটা কেমন মলিন হয়ে গেল ।
ইস কি হত একটু আইসক্রিমটা নিলে !
নিশি ছেলেটাকে ভাল করেই চিনে । ঠিক ওদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকে । নাম অপু । ইউনিভার্সিটিতে পড়ে । ভাল ছেলেই তো মনে হয় । আর ওদের পরিবারটাও ভাল মনে হয় । নিলয়ের সমান ছোট একটা ভাই আছে । আর বড় একটা বোন । সিমসাম পরিবার ।
অপুকে যে ওর খারাপ লাগে তা কিন্তু না । দেখতে শুনতে খারাপ না । পছন্দ হবার মতই ছেলে । সেই তুলনায় নিশি নিজেকেই একটু কম মনে করে । ওর চেহারাটা যে আহামরী সুন্দর তা কিন্তু না । মোটামুটি চলে ।
অপু যেদিন থেকে ওর পিছনে ঘুরা শুরু করেছে তারপর থেকে নিশি প্রায়ই নিজেকে আয়নার সামনে দেখার চেষ্টা করেছে । বারবার বোঝার চেষ্টা করেছে ছেলেটা কেন ওর দিকে এমন ভাবে তাকায় ?? কোন উত্তরই সে খুজে পায় না ।
-এই নিশু ! নিশু !
মায়ের চিত্কারে নিশি বাস্তবে ফিরে আসে ।
-কি ? কি হয়েছে আম্মু ?
নিশি তার মা সুলতানা বেগম কে বেশ ভালই ভয় পায় । যখনই ডাকে নিশির বুকের ভিতর কেমন একটা ভয় কাজ করে । মনে হয় এই বুঝি বকা দিল । কোন কোন সময় চড় থাপ্পরও মেরে দেয় অবলীলায় । এমন একটা ভাব যেন নিশি কলেজে পড়া কোন মেয়ে না ক্লাস টুতে পড়া কোন কচি খুকি । নিশির খুব খারাপ লাগে আবার খুব ভয়ও পায় মাকে ।
সুলতানা বেগম বলল
-ওখাবে বসে আছিস কেন ? ভূমিকম্প হচ্ছে টের পাচ্ছিস না ।
নিশি একটু স্থির হয়ে টের পেল যে আসলেই ঘরটা কেমন যেন দুলছে । এই আর একবার যেন কেঁপে উঠল জোরে ।
-কি করবো আম্মু ?
-কি করবি মানে ?
-সোজা নিচে নেমে যা । লিফট দিয়ে যাবি না , সিড়ি দিয়ে নামবি ।
-তুমি ..
-তুই আগে যা আমি নিলয় কে আর তোর আব্বুকে নিয়ে নামছি ।
সুলতানা বেগম আর দাড়াল না । ভিতরের ঘরের দিকে চলে গেল । নিশি কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করলো । আগে কখনও এভাবে এমন পরিস্থিতির ভিতর পরতে হয় নি ।
নিশি ঠিক বুজতে পারলো না কি করবে । ঘর থেকে বের হবার সময় নিশির বিছনার উপর পরে থাকা ওর মায়ের মোবাইলটার দিকে চোখ গেল । কি মনে করে মোবাইলটা তুলে নিল । নিশি আর কিছু ভাবল না । তারপর মেইন দরজার দিকে দৌড় দিল ।
দরজা খুলে সিড়ির দিকে এগোতেই হাতের মোবাইরটা বেজে উঠল । আরে এই সময় ফোন করে কে ? নিশির একবার মনে হল ফোনটা কেটে দেই । কিন্তু স্ক্রীনে ভেসে ওঠা নাম্বারটা দেখে কেটে দিতে পারল না ।
নাম্বরটা ওর খুব বেশি চেনা ।
রাতের বেলা নিশি প্রায়ই মায়ের মোবাইলটা নিজের কাছে নিয়ে আসে । নিজের একটা সিম আসে ওর । ওটা মায়ের মোবাইলে ভরে টুকটাক কথা বলে বন্ধুদের সাথে । মায়ের চোখ লুকিয়ে কাজটা করতে হয় নিশিকে ।
মাঝে মাঝে মায়ের উপর খুব রাগ হয় । একটা মোবাইল কিনে দিলে কি হয় । ওদের ক্লাসে সবারই মোবাইল আছে কেবল ওর নেই । ওর তো মনে হয় ওদের কলেজে একমাত্র ও ই একমাত্র মেয়ে যার নিজের কোন মোবাইল নেই । কিন্তু এই কথা মায়ের মুখের উপর কিভাবে বলে !
ওর মায়ের কথা হল এতো তাড়াতাড়ি মেয়েদের মোবাইল ব্যবহার করা ঠিক না ।
মোবাইল নিয়ে নাড়ানাড়ি করছিল ঠিক তখনই মোবাইলটা বেজে উঠল । নিশি একটু অবাক না হয়ে পারল না ।
অপরিচিত নাম্বর থেকে ফোন । ওর এই নাম্বরটা সবসময়ই বন্ধ থাকে আর খুব বেশি মানুষ জানেও না । তাহলে ফোন দিল টা কে ?
নিশি ফোন ধরল না । পরপর তিনবার ফোন বেজে বেজে বন্ধ হয়ে গেল । তার কিছুক্ষন পরই ওর মোবাইলে একটা মেসেজ আসলো । ঐ অপরিচিত নাম্বর থেকেই । মেসেজে লেখা
ঐন্দ্রিলা আমি তোমার অপরিচিত কেউ না । একটাবার ফোনটা ধর প্লিজ ।
ঐন্দ্রিলা নিশির ভাল নাম । নিশির মনে হল পরিচিত কেউ হবে । তা না হলে ওর ভাল নাম জানতো না ।
কিন্তু কে !
পরের বার ফোনটা রিসিভ করল ।
-যাক অবশেষে ফোনটা ধরলে !
-কে আপনি ?
কথা বলেই মনে যে ও জানে কে ফোন দিছে । হ্যা তাই হবে ।
-চিনতে পারছো না ?
একটু চুপ করে থেকে নিশি বলল
-জি পারছি । আমি এখন রাখি । আম্মু এখনই চলে আসবে ।
-শুনো, তুমি যদি এখন ফোন রেখে দাও আমি এখন ছাদ থেকে লাফ মার । আমার চিত্কার তুমি শুনতে পাবে । ফোন রেখে দেখো !
নিশি ফোন রাখতে পারল না । কি একটা অচেনা দ্বন্দ্ব ওর মনের ভিতর চলতে লাগল ।
ছেলেটা এমন করে কেন কথা কেন বলে !
-দেখুন আম্মু চলে আসবে ! আম্মু ...
-তোমার আম্মু আসবে না । আর কথা বলতে হবে না । চুপচাপ শুনতে থাকে । কেমন ?
নিশি চুপ করে অপুর কথা শুনতে থাকে । কি এক অদ্ভুদ আবেশ ওর পুরো মনকে বিমোহিত করে ফেলল কিছুক্ষনের জন্য ।
নিশির বারবার মনে হতে লাগল যে ছেলেটা কি জাদু জানে ! কি অদ্ভুদ ভাবেই নিশিকে আস্তে আস্তে নিজের করে নিচ্ছে । নিশি চাইলেও কিছু করতে পারছে না ।
আশ্চর্য !
নিশি শেষ পর্যন্ত ফোনটা রিসিভ করল ।
-কোথায় তুমি ?
অপুর কন্ঠে কেমন একটা উত্কন্ঠা ।
-এই তো সিড়ির কাছে ।
-নিচে নেমো না ছাদে এসো ।
-কেন ? ভূমিকম্প হচ্ছে তো ।
-এই জন্যই বলছি ছাদে এসো । তাড়াতাড়ি ।
নিশি একবার পিছনের দিকে তাকায় । ওর আম্মু এখনও বাইরে আসে নি ।
কি করবে এখন ?
যদি আম্মু চলে আসে !
বুকের ভিতর কেবল এই ভয়টাই করতে লাগল । যা করতে হবে তাড়াতাড়ি করতে হবে । নিশি নিজের মনকে শান্ত করার চেষ্টা করল ।
অপু ছাদে । ওকে যেতে বলছে ।
আম্মুর ভয় লাগলেও নিশি ছাদের সিড়ির দিকে পা বাড়াল । পা টা একটু কাঁপছিল তার থেকেও খুব বেশি পরিমান ভয় করছিল ওর । যদি ওর মা টের পেয়ে যায় ! কেবল এই ভয়টাই ওর সারা শরীর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল । তবুও নিশি এই দুঃসাহসের কাজটা করেই ফেলল ।
ঠিক এরকম একটা সাহসের কাজ নিশি করেছিল কয়েক দিন আগে । আর একটু হলে তো মায়ের কাছে ধরাই পরে যেত ঐ দিন । বড় বাঁচা বেঁচে গিয়েছিল ।
নিশির মা সব সময় মেয়েকে সঙ্গে করে কলেজে নিয়ে যায় আবার সঙ্গে করে বাসায় নিয়ে আসে । এতো বড় মেয়েকে এভাবে গার্ড দেওয়াটা নিশির কেমন খারাপ লাগে । নিজেকে বড় বেশি পরাধিন মনে হয় । কিন্তু ওর কিছুই করার নাই ।
ঐ দিন যথারীতি নিশির মা ওকে কলেজে পৌছে দিল । আর বলল যে কলেজ শেষ ওকে নিতে আসবে । কিন্তু ঐ দিন দুঘন্টা আগেই নিশিদের কলেজ ছুটি হয়ে গেল ।
নিশি প্রথমেই ভাবল যে কি করা যায় । একা একা বাসায় চলে যাওয়া যায় । খুব বেশি দুরে না ওদের বাসাটা । রিক্সায় করে গেলে খুব বেশি হল বিশ-পঁচিশ মিনিট লাগবে । কিন্তু একা একা বাসায় গেলে তো আম্মু বকা দিবে ।
তাহলে ?
আম্মুকে ফোন দেওয়া যায় । কিন্তু নিশির কেন জানি ফোন দিতে ইচ্ছা করলা । দুইটা ঘন্টা অন্তত স্বাধীন ভাবে থাকা যাক । আচ্ছা একটা কাজ করলে কেমন হয় ?
ভাবনা মনে আসতেই বুকের ভিতর কেমন জানি একটা উত্তেজনা বোধ করতে লাগল ।
না থাক !
নিশি নিজের মনকে খানিকটা বেঁধে রাখতে চাইল । নিশির আম্মু যদি জানতে পারে তাহলে আর আস্ত রাখবে না ।
কিন্তু কিভাবে জানবে ?
নিশি নিজের মনকে যুক্তি দেখালো । এখনও দুঘন্টা বাকী । যা হয় হবে !
নিশি ওর বান্ধবীর ফোন নিয়ে অপুকে একটা ফোন দিল ।
অপুর ঠিক পনের মিনিটের মাথায় এসে হাজির ।
ওর সামনে এসেও কেমন অবিশ্বাসের চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে । ওর কাছে এসে বলল
-আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে তুমি আমাকে ফোন দিয়েছ ! সত্যি ফোন দিয়েছ তো ?
নিশি হাসল একটু । ওর একটু একটু ভয় ভয় করছিল কিন্তু ভালও লাগছিল খুব । অপুর মুন্ধ চোখে তাকিয়ে থাকাটা ওর আসলেই খুব ভাল লাগছিল ।
ঐদিন পুরো দেড় ঘন্টা ছিল অপুর সাথে । ঠিক যখন অপুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কলেজের সামনে এসে দাড়াল ওর আম্মু ঠি তখনই এসে হাজির । আর একটু দেরী হলে খবরই ছিল ।
নিশি যখন দরজা দিয়ে ছাদের উপর এসে দাড়াল ঠিক তখন বিল্ডিংটা আরো একবার দুলে উঠল । এবার আরো একটু জোরে ।
অপু কোথায় ?
ডান দিকে চোখ ফেরাতেই অপুকে দেখা গেল । ওর দিকে এগিয়ে আসছে । মুখটা কেমন হাসি হাসি !
ছেলেটা কি পাগল নাকি ? এই ভূমিকম্পের সময় ছাদে দাড়িয়ে আছে । আবার হাসছে । একটুও কি ভয় নাই ? অপু কাছে আসতেই নিশি বলল
-আপনার কি মাথা খারাপ ? এসময় কেউ ছাদে থাকে ? চলুন নিচে চলুন ।
অপু কিছু বলল না । হাসলো কেবল ।
-হাসছেন কেন ?
-ভয় লাগছে ?
নিশি কিছু না বলে অপুর দিকে চেয়ে থাকলো অপুর দিকে । অপু বলল
-আমি জানি তোমার ভয় লাগছে না । তুমি আমার সাথে আছো না ? তোমার ভয় লাগবে না ।
নিশি কিছু না বলে অপুর দিকে তাকিয়েই রইল । ছেলেটার কথা আসলেই ঠিক । যখন সিড়ি ভেঙ্গে ছাদে উঠছিল একটু একটু ভয় ভয় করছিল । কিন্তু এখন একটুও ভয় লাগছে না ।
-আপনার ভয় লাগছে না ?
অপু আবার কোন কথা না বলে কেবল তাকিয়েই রইল ।
নিশিরও কেন যেন কেবল তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছা ছেলেটার দিকে । কি আছে ঐ ছেলেটার মাঝে কেন এই রকম ভাবে তাকিয়ে থাকতে মন চায় !!
নিশি এর উত্তর জানে না !! জানতে চায়ও না । কেবল তাকিয়েই থাকে মন চায় !!
এরই মধ্যে ভূমিকম্পে আরো দুইবার পুরো শহরটা দুলে উঠল কিন্তু অপু কিংবা নিশির কারোই খুব বেশি ভাবান্তর হল না । তারা কেবল একে ওপরের দিকে তাকিয়েই আছে !! কতক্ষন থাকবে কে জানে !!
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ দুপুর ১২:৪৪