-সুমন ভাইয়া ? আপনি ?
আমি এমন একটা ভাব করলাম যে আমিও খুব অবাক হয়েছি । বললাম
-তোমরা এখানে ? কোথায় যাচ্ছ ?
-আমরাতো কুয়াকাটায় যাচ্ছি সবাই মিলে ? আপনি কোথায় যাচ্ছেন ?
যদিও আমি জানি ওরা সবাই মিলে কুয়াকাটা যাচ্ছে , কিন্তু এমন একটা ভাব করলাম যে আমি আরো অবাক হয়েছি ।
-আরে আমিও তো কুয়াকাটায় যাচ্ছি ।
-এটা যাচ্ছেন ?
এই প্রশ্নটা করল নিশি ।
-হ্যা একাই !
-হঠাৎ ...
-না মানে এমনি । বহু দিন কোথাও যাওয়া হয় না তাই ভাবলাম একটু ঘুরে আসা যাক !
নিশি আর কিছু বলল না । কেমন একটু হাসল ।
তাহলে কি নিশি বুঝে ফেলল যে কেন আমি কুয়াকাটা যাচ্ছি !
-আচ্ছা সুমন সাহেব ! থাকুন ! কুয়াকাটায় দেখা হবে !
দুবোন চলে গেল । মনটা খানিকটা খারাপই হল । নিশি আর একটু থাকতো ! আর একটু কথা বলতো ! ওকে কি করে বোঝায় যে ঢাকার সব কাজ কারবার ফেলে আমি ওদের পিছু পিছু এসেছি কেবল নিশির জন্য !
সমুদ্র পাড়ে বসে ওয় সাথে গল্প করবো । দুজন সমুদ্রের পানিতে পা ভিজিয়ে হাটবো । ওর হাতটা ধরে ....
সুমন মিয়া অফ যাও ।
নিজের মনকে বললাম । একটু বেশি বেশি ভাবতাছো ! গাছে এখনও কাঠাল পাকে নাই আর তুমি গোফে তেল দিয়া বইসা আছো ।
কিন্তু আমার দিকে যেভাবে তাকিয়ে হাসল আমি নিশ্চিত ও কিছুতো আচ করতে পেরেছে । আর মেয়েরা এসব ব্যাপারে একটু টের পেয়েই যায় ।
তাহলে এতো তাড়াতাড়ি কেন চলে গেল ?
আর একটু কথা বললে কি এমন হত !
কিছুক্ষন পর দেখলাম দুবোন আবার হাজির । এবার সাথে ওদের বাবা রয়েছে । আমি সালাম দিলাম । নিশির বাবা বললেন
-তুমিও নাকি কুয়াকাটায় যাচ্ছ ?
-জি আঙ্কেল ।
-একাই যাচ্ছ ?
জি !
-তা বাবা ঐশী জেদ ধরেছে যে তোমার সাথে যাবে । আসলে আমাদের গাড়ি একটু ছোটতো পাঁচ জন একটু চাপাচাপি হয়ে যায় । ওর একটু কষ্টই হচ্ছিল । তোমার যদি কোন ...
-না না আঙ্কেল সমস্যা কেন থাকবে ? আমিতো একাই যাচ্ছি । ঐশী সাথে গেলে ওর সাথে গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে !
-তোমার কোন কষ্ট হবে না তো ?
-সি আঙ্কেল কষ্ট কেন হবে ? আমি আগে জানলে তো ঢাকা থেকেই ঐশীকে সাথে নিয়ে আসতাম ।
হঠাৎ ঐশী বলল
-আব্বু আপুও আমাদের সাথে আসুক ।
আহা ! মনটাই খুশি হয়ে গেল ঐশীর কথা শুনে । বললাম
-হ্যা আঙ্কেল নিশিও আসুক ! আপনারা দুজন গল্প করতে করতে যান । আন্টিও নিশ্চয় খুশি হবে ।
খানিকটা ভয় হল হয়তো আঙ্কেল রাজি হবে না । কিন্তু রাজি হয়ে গেলেন ।
ছুটি কাটাতে যাচ্ছেন স্বামী স্ত্রীর একটু একা একা গল্প করতে তো মন চাইতেই পারে । যত বয়সই হোক না কেন এমন ইচ্ছা তো থাকতেই পারে ।
আর আঙ্কেল আমাকে যত ভাল জানুক তবুও একা ঐশীকে তো ছাড়তে চান না । দুবোন থাকলে তো আর কোন সমস্যা নাই ।
ফেরি যখন ঘাটে আসল আমাকে আর পায় কে ! কুয়াকাটা এখনও সাত আট ঘন্টার পথ, এই পুরোটা সময় নিশি একদম আমার পাশে থাকবে !
এটার থেকে আনন্দের আর কি হতে পারে !!
গাড়ী যখন স্টার্ট দেব দেখলাম ঐশী সামনের দরজা খুলল বসার জন্য । মনটা চাই ছিল নিশি ঐ খানটাতে বসুক । বসলে ভাল লাগতো !
আমার মনের কথাটা যেন নিশি চট করে বুঝে ফেলল । ঐশীকে বলল
-ঐশী তুই পেছনে বয় !
-কেন ?
-আমি সামনে বসব !
যদিও আমি চাচ্ছিলাম নিশি সামনে বসুক , তবে এটা বলাটা কেমন হয়ে যায় । তাই চুপ থাকলাম । নিশি বলল
-শোন বেশি কথা বলবি না । যা বলছি শোন । তুই না আরাম করে বসতে চাচ্ছিলি । পেছনে দুসিট নিয়ে আরাম করে বস ।
যাক নিশিই সামনে বসল । একেবারে আমার পাশের সিটে !
কুয়াকাটা পর্যন্ত জানিটা সত্যি অনেক চমৎকার হল । আমি যা ভেবেছিলাম তার থেকেও অনেক ভাল ।
ঐশীই বেশি কথা বলছিল কিন্তু নিশিও চুপ ছিল না । তারপর রাস্তার মাঝ খানে আমরা গাড়ি থামিয়ে আমরা চা খেলাম ডাবের পানি খেলাম ! আমার মনে হচ্ছিল যেন আমি স্বর্গে আছি ।
প্রতিটা মুহুর্ত আমাকে সত্যি খুব আনন্দ দিচ্ছিল । বরিশাল পার হতেই ঐশী ঘুমিয়ে পরল ।
অনেকটা জার্নি করা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে ! ঐশী ঘুমানোর পর কথা বার্তা একটু কমে এল কিন্তু নিশি টুকটাক কথা বলছিল ।
হঠাৎ নিশি আমাকে প্রশ্ন করলো
-আপনি কুয়াকাটা কেন এলেন ?
-আমি ? এই তো ঘুরতে !
-কেবলই ঘুরতে ?
না আমি এসেছি তোমার পিছন পিছন । কেবল তোমার জন্যই এসেছি । এই কথাটা বলতে খুব ইচ্ছা করলো কিন্তু কেন জানি বলতে পারলাম না । বললাম
-হ্যা ঘুরতেই এলাম । অনেক দিন কোথাও যাওয়া হয় না তাই ভাবলাম ...
নিশি কেবল একটু হাসল । আরকিছু বলল না । হোটেলে পৌছাতে পৌছাতে একটু রাত হয়ে গেল গেল ।
পরদিন সারাদিনই বলতে গেলে ঘুমিয়ে কাটালাম । কিন্তু বিকেল বেলা বের হতে হল নিশিদের সাথে , সাগর পাড়ে গিয়ে সূর্যাস্ত দেখতে । আঙ্কেল আর আন্টি আগে আগে হাটছিল ।
আমরা পেছনে । নিশি সমুদ্রের পাড়ে রাখা সি-চেয়ার গুলো দেখে বলল
-এগুলোর উপর বসা যায় না ?
-হুম যাবে না কেন ?
-বসার জন্যই তো রাখা হয়েছে ।
নিশি বসে পড়ল ।
-আপু বসলে কেন ? হাটবে না ?
-তুই হাট । আমার ভাল লাগছে না । আর এখান থেকেও সূর্যাস্ত দেখা যাবে ।
ঐশী আর কিছু বলল না ।
নিশি আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আপনিও ইচ্ছা করলে যেতে পারেন ।
মাথা খারাপ আমি তোমাকে ছেড়ে যাবো ।
আমি বললাম
-আমিও একটু বসি । আমারও হাটতে ভাল লাগছে না । ঐশী চলে যাবার পর নিশি কেন জানি হেসে উঠল ।
-হাসলে কেন ?
-এমনি ! কেন হাসলে আমাকে ভাল দেখায় না ?
আমি কোন উত্তর দেই না । নিশির আচরন আমার কাছে খুব অদ্ভুদ মনে হয় মাঝে মাঝে ।
একবার মনে হয় আমি যে ওকে পছন্দ করি এটা ও নিজে জানে এবং ও নিজে এটা পছন্দ করছে আর একবার মনে হয় এটা ও পছন্দ করছে না । নিশি আমাকে জিজ্ঞেস করল
-আপনি কিন্তু সত্যি কথাটা বললেন না ?
-কোন কথাটা ?
-এই যে কেন এলেন এতো দুর ? আমি কিন্তু লক্ষ্য করেছি ঢাকা থেকে আসার পথে আপনার গাড়িটা সবসময় আমাদের পিছন পিছন ছিল । ইচ্ছা করলেই আপনি আগে চলে যেতে পারতেন কিন্তু যান নি । কারনটা বলবেন কি ?
-তুমি জানো না কারনটা কি ?
খানিকটা সাহস নিয়ে কথাটা বলে ফেললাম ।
নিশির আমার দিকে তীক্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষন । বলল
-জানি । তবুও বলেন ।
-নিশি সব কথাটা কি মুখ ফুটে বলার দরকার আছে ? কিছু কথা বুঝে নিতে হয় ।
-আমি অত কিছু বুঝতে চাই না । আমি শুনতে চাই ।
নিশির কণ্ঠস্বর আর একটু দৃঢ় হল । মনে মনে বললাম এই হল সুযোগ । আজ বলতেই হবে ।
-আমি ...
-সুমন ভাইয়া আমার একটা ছবি তুলে দেন না !!
ঐশী ক্যামেরাটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল । নিশির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও অন্য দিকে তাকিয়ট আছে ।
হাহ!!!
বলা হল না । ভাল সুযোগ ছিল । রাতে খানিকটা মন খারাপ নিয়েই ঘুমাতে গেলাম ।
আজ কিছু একটা নিশ্চয় হয়ে যেত ! আজ যদি ওকে প্রোপজ করতাম ও নিশ্চয় রাজি হয়ে যেত ! অন্তত ভাব চক্করে তো তাই মনে হচ্ছিল । কিন্তু
ঐশী !
শালীর শালী আসার আর টাইম পেলি না ।
শালীর শালী !!
অবশ্য ঐশী আমার শালীই হয় সম্পর্কে ! দেখি কালকে আবার চেষ্টা নিতে হবে ।
কিন্তু কে জানে কাল আবার সুযোগ আসবে কিনা ।
-এখনও ঘুমাচ্ছ ?
-হুম ।
-উঠো জলদি ।
-কে ?
এতো রাতে আবার কে উঠতে বলে আমাকে । ঘুমের ঘোরেই বিরক্ত লাগে । ফোন কেটে দেই । কিন্তু পর মুহূর্তেই ঘুম চটে যায় ।
কে ফোন দিল ? রিভিস কল চেক করে দেখি নিশি ?
সময় দেখলাম পাঁচটার মত বাজে । অল্প অল্প আলো ফুটেছে কেবল । এতো সকালে নিশি কেন ফোন দিবে ? আর সব থেকে বড় কথা ও আমাকে তুমি করে কেন বলছে ?
বলতে বলতে আবার ফোন এসে হাজির ।
-ফোট কেটে দিলে কেন ?
-আসলে ঘুমের ঘোরে টের পাই নি ।
-তোমার ঘুম বের করছি ! পাঁচ মিনিটের মধ্যে হোটেলের সামনে হাজির হও ।
আমি আর কিছু বলি না । তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে হাজির হই । বাইরে হালকা শীত পরেছে তবে কুয়াশা নেই একদমই । আর চারিদিকটা এখনও অন্ধকার ।
দেখলাম সেই অন্ধকারের মধ্যেই আলো করে নিশি দাড়িয়ে আছে । পাতলা একটা চাদর জড়ানো গায়ে । আমি সামনে আসতেই বলল
-এতোক্ষন লাগে ?
-কই পাঁচ মিনিটের বেশিতো লাগে নি ।
-হয়েছে এসো ।
এই বলে নিশি হাটতে লাগল । আমার মনে কেন জানি একটু সন্দেহ হল ।
নিশি সত্যিই নিশি তো ?
অন্য কিছু না । আমি খানিকটা সংকোচ নিয়ে ডাক দিলাম
-নিশি ।
-হুম ।
-তুমি নিশিই তো ?
-মানে ? কি বলছো ?
-না এই সকাল বেলা আমার ঘুম ভাঙ্গালে , আমাকে তুমি করে বলছ , এমন বিহেব করছ যেন ...
-যেন কি ?
-না মানে ঠিক মেলাতে পারছি না ।
-শোন এতো কিছু মেলাতে হবে না । এখন জলদি চল । সূর্যোদয় দেখতে যাবো ।
হোটেলেই বাইরেই ভ্যান পেয়ে গেলাম । ভ্যানে যাওয়ার নিশি বলল
-তোমার কি মনে হচ্ছে আমি নিশি না ? কোন পেত্নী ? যে তোমাকে ...
এই কথা বলে খুব হাসতে লাগল । আমার সন্দেহ দুর হল । এই রকম সুন্দর করে কেবল নিশিই হাসতে পারে ।
যখন ভ্যান থেকে নামলাম তখন চারিদিক বেশ আলোকিত হয়ে গেছে । এখনই সূর্য উঠবে ।
পূর্ব দিগন্ত কেমন উজ্জল লালচে রং ধারন করেছে ।
নিশি ঐ দিকে তাকিয়ে আছে আর আমি অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি ।
আস্তে আস্তে সূর্য উঠছে আর চারিদিকের উজ্জলতা বাড়ছে । আর সেই আলো পরছে নিশির মুখের উপর ।
ক্ষনে ক্ষনে সেই আলো পরিবর্তন হচ্ছে । আর আমি তাকিয়েই আছি ওর মুখের দিকে মুগ্ধ হয়ে ।
কিছুক্ষন পর নিশির আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আমার দিকে তাকিয়ে আছো কেন ? সূর্যোদয়ের দিকে তাকাও ।
-কি হবে ?
-কি হবে মানে ? কুয়াকাটায় কেন এসেছে ?
-আমিতো তোমাকে দেখতে এসেছি !
-আমিতো পালিয়ে যাচ্চি না ।
-সূর্যোদয়ও পালিয়ে যাচ্ছে না ।
নিশি যেন একটু খুশি হল আমার কথা শুনে । এই আবার সুযোগ এসেছে ।
আমি আরো খানিকটা সাহস যুগিয়ে নিশির হাতটা ধরলাম । বললাম
-এই সূর্য যেমন পৃথিবীকে আলো দিয়ে বাচিয়ে রেখেছে, ওই ভাবে আমিও কেবল তোমার ভালবাসায় বাঁচতে চাই । আমাকে ভালবাসবে কি?
নিশি দেখলাম আমার দিকে তাকিয়ে আছে । এক ভাবে । কিছুক্ষন পর লক্ষ্য করলাম ওর চোখে জল জমতে শুরু করেছে । সকালের শুভ্র সূর্য কিরন সেই জলে প্রতিফলিত হয়ে আশ্চার্য দূত্যি ছড়াচ্ছে ...
ফেবু লিংক