সুতরাং পারার ছেলেদের কাছে আমাদের বাড়ির সামনের জায়গাটা একটা সুপরিচিত স্থান হয়ে উঠেছে । বিশেষ করে স্কুল শুরু আর ছুটি হবার সময়ে ।
গরমের ছুটিতে বাড়ি এসেছি । খাওয়া দাওয়া ঘুম ছাড়া আর কোন কাজ নেই । সেই সাথে যুক্ত হয়েছে আরো একটা কাজ ।
ইভ টিজিং !
দাড়ান ভাই এখনই পুলিশে খবর দিয়েন না । এটাকে ঠিক ইভ টিজিং বলে না । মেয়েদের সাথে টাংকি মারা বলতে পারেন ।
যাই এই করে সময় কাটছিল । একদিন আমি আর আমার বন্ধু মোমিন বাড়ির সামনে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম ।
ঠিক তখনই মেয়েটাকে দেখলাম ।
কাধে ব্যাগ নিয়ে মাথা নিচ করে হেটে যাচ্ছে । এই মেয়েটাকে তো আগে দেখি নি । মমিনকে বললাম
-কে রে মেয়েটা ? আগে তো দেখি নি ?
-এইটা লিটনের শালী । সীমান্ত স্কুলে নাইনে পড়ে ।
আমি বললাম
-ডাক দে তো ।
মমিন ডাক দিল ।
-ভাল আছেন মমিন ভাই ?
মেয়েটা খুব নরম ভাবেই জানতে চাইল । মেয়েটার চেহারা আহামরি সুন্দর তা বলবো না কিন্তু একটা মোলায়েম একটা ভাব আছে যা আমার ভাল লাগল ।
মমিন আরো কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করল । মেয়েটি মাথা নিচ করেই জবাব দিলো ।
আমি মেয়েটার দিকেই তাকিয়ে আছি । হঠাৎ মেয়েটা চোখ তুলে চাইল । সরাসরি আমার দিকেই ।
আবার সঙ্গে সঙ্গেই চোখ নামিয়ে নিল । মেয়েটা চলে যাবার পরে মেয়েটার সম্মন্ধে জানতে চাইলাম । মমিন বলল
-মেয়েটার নাম সাথী । লিটনের বড় শালী । ওদের একায় স্কুল অনেক দুরে বলে এখানে এসে পড়ছে । পাড়ার ছেলেরা এর পেছনে খুব ঘোরছে । কিন্তু সাথী কাউকে পাত্তা দিচ্ছে না । রকি তো একদম পাগল হয়ে গেছে ।
পরদিন সকালবেলা আবারও সাথীর জন্য বসে ছিলাম বাড়ির সামনে । আজ মমিন নেই ।
তাই একটু চিন্তায় ছিলাম । সাথীকে ঠিক মত ডাকতে পারবো তো ? একটু পরেই সাথীকে আসতে দেখতে পেলাম ।
মাথা নীচ করে এগিয়ে আসছে । আমি কেন জানি ইচ্ছে থাকা সত্তেও সাথীকে ডাকতে পারলাম না । কেমন যেন একটা সংকোচ কাজ করছিল । সাথী চলে যাবার পর নিজেকে ধিক্কার দিলাম ।
ঐটুকু একটা মেয়েকে ডাকতে ভয় পেলাম !
পরদিন সকালেও আমি একই ভাবে সাথীর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম । আজ মেয়েটার সাথে কথা বলতেই হবে । একটু পরেই দেখলাম মহারানীর আগমত । মাথা নীচ করে হেটে যাচ্চে আমার সামনে দিয়ে । আমি ডাক দিলাম
-এই মেয়ে শোন ।
সাথী সঙ্গে সঙ্গে দাড়িয়ে গেল । আমার কেন জানি মনে হল আমার ডাকার জন্যই বোধহয় মেয়েটা অপেক্ষা করছিল ।
-এদিকে এসো ।
সাথী আমার দিকে এগিয়ে এল । ঐ দিন তো সাথী নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল । কেমন একটা মোলায়েম ভাব ছিল । কিন্তু আজ সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে ।
আর কি সেই চোখের দৃষ্টি । আমি বললাম
-কি নাম তোমার ?
সাথী একটু যেন হেসে উঠল । বলল
-আমার নাম জানার জন্য কি আমাকে ডেকেছেন ? আমার তো মনে হয় আমার নাম আপনি জানেন !
-আমি যার নাম তার কাছ থেকে শুনতে পছন্দ করি ।
সাথী আবার হাসল । বলল
-আমার নাম সাদিয়া নুসরাত ।
-ভাল নাম ।
-শুধু নামই ভাল আমার ?
আমি এই কথাটা শুনে খানিকটা বিভ্রান্ত হলাম । মেয়েটা কি বলতে চায় ? তারপর কি বলবো ঠিক খুজেই পেলাম না । আসলে আজ সাথীর চাওনীর মধ্যে কিছু একটা রয়েছে । আমার সব কিছু কেমন অলটপালট হয়ে যাচ্ছে । সাথী বলল
-আচ্ছা অপু ভাই আমার স্কুলের দেরী হয়ে যাচ্ছে । আমি যাই ?
-আচ্ছা ।
সাথী স্কুলের দিকে হাটা দিল । আমি ওর পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম । সাথী পেছন ফিরে তাকাল ।
একবার ।
দুবার ।
তিনবার । তিনবারের বার হাত নাড়ল ।
সাথী চলে যাবার পর আমার এই খেয়াল হল যে মেয়েটা আমার নাম জানল কিভাবে ?
আশ্চর্য !
এভাবেই দিন কাটতে লাগল । প্রতিদিন সকাল বেলা সাথীর সাথে কথা বলি । যাবার সময় ও পিছন ফিরে তাকায় । একটু হাসে । হাত নাড়ে ।
তারপর আমার ঢাকায় যাবার সময় চলে এল । আমার কিছু বলতে হল না । সাথী কোথা থেকে যেন খবর পেয়ে গেল ।
ঐ দিন সকালবেলা আমাকে বলল
-আপনি কাল চলে যাবেন ?
-হুম ।
-আর আসবেন না ?
-আসবো না কেন ?
-আমার একটা কথা রাখবেন ?
-বল ।
-আজ বিকেলে পুলিশ পার্কে আসবেন একটু ।
-বিকেল বেলা ?
-কখন ?
-এই পাঁচটার দিকে ।
-আচ্ছা ।
-আসবেন কিন্তু । আমি অপেক্ষা করবো । আমি যা ভেবেছিলাম তার থেকে তো দ্রুত হয়ে গেল । এই মেয়ে তো দেখি এক ধাপ এগিয়ে ।
বিকেলবেলা পুলিশ পার্কে গিয়ে দেখি সাথী আগেই গিয়ে হাজির । ওকে নিয়ে পার্কের একদম শেষের দিকে বসলাম ।
-একা এসেছ ?
বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলাম ।
-নাহ । স্বপ্না আপুর সাথে এসেছি ।
-কি সব্বনাশ বল কি ?
আমি একটু ভয় পেলাম । স্বপ্না আমারই ক্লাস মেট । আমাদের বাড়ির কাছেই ওর বাড়ি । ও যদি জানতে পারে যে সাথীর সাথে আমি এখানে এসেছি তাহলে পুরো গ্রাম জানতে আর বাকি থাকবে না ।
-কোথায় ও ?
সাথী হাসল ।
-ভয় পাবেন না । আপু তার বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে ব্যস্ত আছে । এদিকে আসবে না ।
বলেই সাথী হাসতে লাগল । কতক্ষন বসে ছিলাম জানি না । তবে ওর সাথে বসে থাকতে ভাল লাগছিল । যাওয়ার সময় হলে সাথী বলল
-আপনার মোবাইল নম্বরটা দিবেন আমাকে ?
-তাহলে তোমার নাম্বরটাও দাও ।
-আমার তো মোবাইল নেই ।
-তাহলে নম্বর নিয়ে কি করবে ?
-যদি সুযোগ পাই ফোন করবো । আমি জানি আপনি আমার কথা আপনার মনে থাকবে না । মাঝে মাঝে ফোন করে মনে করিয়ে দেবো ।
আমি আমার মোবাইল নম্বর দিলাম ।
যাওয়ার সময় সাথী হঠাৎ করেই আমার হাতটা ধরল । বলল
-আমার কথা মনে রেখেন ।
সাথী চলে গেল ।
তারপর দিনই ঢাকা চলে আসি ।
ভেবেছিলাম দুয়েক দিনের মধ্যেই ও ফোন দিবে । কিন্তু একমাস পেরিয়ে গেলেও সাথী আর ফোন দিল না ।
ঈদের ছুটিতে যখন বাড়ি গেলাম খবর নিয়ে জানতে পারলাম সাথী আর এখানে থাকে না । এখান কার ছেলেগুলো নাকি খুব বেশি বিরক্ত করছিল । তাই ওকে আবার ওদের বাসায়ই পাঠিয়ে দিয়েছে ।
দেখতে দেখতে তিন বছর পার হয়ে গেল কিন্তু সাথীর ফোন আর এল না । ঐ দিন যাবার আগে ও বলেছিল আমার কথা মনে রেখেন । আমি তো ঠিকই মনে রেখেছি । কিন্তু ও মনে রাখে নি আমার কথা ।