তারপর থেকে জয়িতা যেন কেমন বদলে গিয়েছিল । আমার দিকে যখন তাকাত কেমন যেন একটা বিষন্নতা ওর চেহারায় ফুটে ওঠত । মনে হত ওর কাছ থেকে কি যেন একটা হারিয়ে যাচ্ছে । আর ও সেই জিনিসটাকে ধরে রাখার জন্য কিছুই করতে পারছে না । আমি কত কথা বলতাম । ও কিছু বলত না । আমি আর থাকতে পেরে ওকে বললাম
-তুই এমন কেন করছিস ?
-কেমন করছি ?
-এমন মন খারাপ করে কেন থাকিস ?
জয়িতা কোন জবাব দিল না । আমি বললাম
-আমি তোকেই বিয়ে করবো ! কে রাজি হোক বা না হোক ! তুই বুজলি আমার কথা ?
জয়িতা হাসল । বিষন্নতার হাসি !
-আবীর ! আমি তোকে বিয়ে করবো না । তুই কি জানিস মানুষের জীবনে মা বাবা কতটা ইম্পর্টেন্ট ! তাদের কাছে থাকাটা কত বেশি জরুরী ! অনেক বেশি জরুরী ।
-কিন্তু ..
-কোন কিন্তু না । তোর মা তোকে ২৪ বছর ধরে ভালবাসে । বুকের একটু একটু ভালবাসা দিয়ে তোকে বড় করেছে । আমার ২৪ মাসের ভালবাসা ঐ ২৪ বছরের ভালবাসার কাছে কিছুই না । তোর মাকে কিছুতেই কষ্ট দিস না । আমি হলে দিতাম না । তোরও দেওয়া উচিৎ না ।
তারপর থেকে জয়িতা আমার সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিল । আমি যোগাযোগ করতে চাইলেও ও করতো না ।
আবার বললাম
-তোমার মেয়েটা এতো মিষ্টি হয়েছে ! একদম তোমার মত । দেখতেও হয়েছে একদম তোমার মত ।
জয়িতা হাসল । এর চোখ দুটোতে কেমন যেন একটা রহস্য দেখলাম । ও বলল
-সবকিছু কিন্তু আমার মত না । চোখ দুটো হয়েছে একদম ওর বাবার মত ।
আমি শশীর চোখের দিকে তাকালাম । আসলেই শশীর চোখ দুটো জয়িতার মত না । কেন জানি চোখ দুটো আমার বড় পরিচিত মনে হল । কার মত এই চোখ দুটো ! তবে যার মতই হোক বড় পরিচিত মনে হল ।
শশী এখনও আমার কোল থেকে নামে নি । আমাকে কেমন জড়িয়ে ধরে রেখেছে । হঠাৎ জয়িতা ওর মোবাইল দিয়ে আমাদের ছবি তুলল । বেশ কয়েকটা । আমি বললাম
-কি করছো ?
-আমার মেয়ের জন্য ছবি তুলছি ? তুমি যখন থাকবে না এই ছবি ওকে তোমার কথা মনে করাবে ।
আমি ঠিক মানে বুঝলাম না । কেবল হাসলাম । জয়ি শশীকে বলল
-মামনি তুমি একটু ভিতরে যাও ! আমি একটু আবীরের সাথে কথা বলি !
-আমি থাকি না আম্মু ! বাবার সাথেতো আর থাকতে পারবো না ।
কথাটা শুনে আমি ধাক্কার মত খেলাম । শশী কি বলল ! বাবা !!
আমার ঠিক তখনই মনে পরে গেল শশীর চোখ দুটো কেন এতো পরিচিত মনে হচ্ছিল । আয়নার দিকে চোখ পড়লে যে ঐ দুচোখ প্রতিদিন আমি দেখি ।
আমার বুকের মধ্যে কেমন একটা অনুভুতি শুরু হল । আমি জয়িতার দিকে তাকালাম । জয়িতার চোখ দুটো কেমন যেন অস্বস্থির । এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করছে ।
জয়িতার খোজ পাচ্ছিলাম না কিছুদিন থেকেই । কোথায় যেন ডুব মেরেছে । ওর ফোনও বন্ধ । একদিন হঠাত্ করেই আমার বাসায় এসে হাজির । ঐ দিন বাসায় একলা ছিলাম । মা গ্রামের বাসায় গেছিল । রাত তখন প্রায় এগারটা বাজে । এমন সময় জয়িতা এসে হাজির । ওকে এতো রাতে আসতে দেখে খানিকটা অবাক না হয়ে পারলাম না ।
-এতো রাতে ? এতো দিন কোথায় ছিলি ? আর তোর এই অবস্থা কেন ?
জয়িতাকে কেমন জানি এবনরমাল মনে হচ্চিল । একটু যেন টলছিল । জয়িতা বলল
-ড্রিংক করেছি ।
-মানে ? কেন?
আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম । কি বলে এই মেয়ে ? খানিকটা ধরেই ওকে ঘরের ভেতরে নিয়ে এলাম । ওর কেমন জানি হুস নাই মনে হল । আমাকে বিড় বিড় করে বলল
-খুব ঘুম আসরে আবীর । একটু ঘুম পাড়িয়ে দিবি ?
-আয় ।
ওকে নিয়ে শোবার ঘরের দিকে গেলাম । যাওয়ার পথেই ও আমাকে জড়িয়ে ধরলে । যখন ওকে বিছানায় শুইয়ে দিলাম জয়ি তখনও আমাকে ছেড়ে দিলো না । ঘোলা চোখ নিয়ে আমাকে বলল
-একটু আদর করবি আবীর ?
আমার প্রথমে মনে হল ওর হয়তো হুস নেই তাই কি করছে না করছে তার ঠিক নেই । কিন্তু ওর চোখের দিকে যখন ভাল করে তাকালাম আমার পুরো শরীরটা কেমন যেন কেঁপে উঠল । আমি নিজেকে আর সংবরন করতে পারলাম না ।
সেদিন আমার কি হয়েছিল জানি না কিন্তু মনে হয়েছিল জয়িতাকে এর আগে কথনও এতো আপন করে ভালবাসি নি । রাতে ঘুমানোর আগে কেবল এই কথাটা মনে হল এই জয়িতাকে ছাড়া আমার চলবে না কিছুতেই ।
কিন্তু সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে জয়িতাকে আর দেখতে পেলাম না । কেবল আমার মোবাইলের নিচে চাপা দেওয়া এক টুকরো কাগজ পেলাম ওর । এলোমেলো হাতে লেখা অল্প কয়েকটা লাইন
আর কয়েক ঘন্টা পরেই আমার ফ্লাইট । বাবা কাছে যাচ্ছি । তোকে ছেড়ে যাচ্ছি । কাল এ কথাটাই বলতে এসেছিলাম । যেন বলতে পারি তাই খানিকটা ড্রিংক করে এসেছিলাম । তবুও বলতে পারি নি । তারবদলে কি হয়ে গেল দেখ ! যাগ গে তুই টেনশন নিস না । যা হয়েছে ভালই হয়েছে । তুই ভাল থাকিস । আর আমার কথা মনে রাখিস । তোকে অনেক ভালবাসি ।
আমি কোন মতে বললাম
-শশী কি বলল আমাকে ?
জয়ি চুপ করে থাকলো অনেকক্ষন ।
- কি ব্যাপার কথা বলছো না কেন?
তারপর হঠাৎ করেই জয়ি কথা বলা শুরু করলো ।
-যখন বাবার কাছে পৌছালাম তখনও আমি ভেবে পাই নি আমি কিভাবে বেঁচে থাকবো । কিন্তু ওখানে যাবার কিছুদিনের মধ্যেই আমি টের পেলাম আমার মধ্যে কিছু একটা হয়েছে । যখন সিওর হলাম কি যে আনন্দ লাগছি আমার কাছে ! তুমি নেই তবুও তোমার অস্তিত্ব আমার কাছে আছে । আমার বাঁচার অবলম্বন ।
-আমাকে তুমি একবার জানাতে পারতা না ?
জয়িতা হাসলো !
-তাহলে তোমাকে আটকানো বড় কঠিন হয়ে যেত ।
অনেক কিছু বলতে চাইলাম । কিন্তু তারপর মনে হল কি দরকার ? কি লাভ এখন এসব জিজ্ঞেস করে !
আমি কেবল শশীকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম । আমার মেয়েকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম । জয়িতা বলল
-শশী জন্মাবার পর থেকে আমার পুরো জীবনটাই যেন বদলে গেল । আমার পুরোটা সময়ই কাটতো ওকে নিয়ে । জানে ওকে যখন জয়িয়ে ধরতাম মনে হত যেন তোমার গন্ধ আমি পাচ্ছি ওর গা থেকে ।
আমি বললাম
-কোন অসুবিধা হয় নি তোমার ? না মানে তুমি একা একটা মেয়ে হয়ে .... !
জয়িতা হাসল ।
-নাহ ! তেমন কোন সমস্যায় পরতে হয় নি । বোঝই তো ওখানকার কালচারটা মোটামুটি এরকম । অবশ্য বাবা প্রথম প্রথম একটু নাখোস ছিল । কিন্তু পরে আর কিছু বলে নি ।
আমি বললাম সব
-তো ভালই চলছিল । তাহলে দেশে কেন এলে ?
-গত বছর শশী ওর বাবাকে দেখার জন্য খুব চিত্কার চেচামিচি শুরু করে দিল । স্কুলে সবার বাবা আসে ওর বাবা কেন আসে না । বাবা কই ? বাবা কই ? এই নিয়েই সারাদিন কান্নাকাটি চলত । তাই ওকে প্রমিজ করেছিলাম যে সামনের জন্মদিনে তোমার বাবাকে এনে দিবো ।
আমি কিছু বললাম না । শশীর দিকে তাকিয়ে রইলাম । কি শান্ত ভঙ্গিতেই না ও আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে । জয়িতা আবার বলল
-আমি ভেবেছিলাম ওর হয়তো মনে থাকবে না । কিন্তু শশী ওর বাবার কথা ভুলে যাই নি । এই বার আর কিছুতেই ওকে সামলাতে পারছিল না । তোমার মেয়ে না ? তোমার মতই হয়েছে । একবার কিছুতে হ্যা বললে আর না বলার উপায় নাই ।
আমি শশীকে কোলে নিয়েই বসে রইলাম অনেকক্ষন । কোন কথা বললাম না । কেবল বসেই রইলাম । খুব ইচ্ছা করছিল শশীর সাথে কথা বলি কিন্তু কোথা থেকে যেন একটা বাঁধা আসছিল বারেবার ।
যখন আমার ফেরার সময় হল শশীকে কোল থেকে নামালাম । শশী বলল
-তুমি কি এখন চলে যাবে ?
আমি কথাটার জবাব দিতে পারলাম না । কেন জানি মনে হচ্ছিল এখনই আমার চোখে পানি চলে আসবে । পকেটে যা টাকা ছিল প্রায় সবটুকু শশীর হাতে তুলে দিলাম । ওকে বললাম
-মামনি তোমার যা ইচ্ছে কিনে নিও ।
জয়িতা বলল
-কেউ কিছু দিলে থ্যাঙ্কিউ দিতে হয় !
-থ্যাঙ্কিউ ।
মা মেয়ে দুজনেই একদম নীচ পর্যন্ত এল আমাকে এগিয়ে দিতে । যাবার আগে জয়িতা আমাকে বলল
-আবীর তুমি মনে কখনও যেন কোন অপরাধ বোধ রেখো না । কেমন ! হয়তো তোমার সাথে থাকলে আমি আরো একটু ভাল থাকতাম । তবে এখন কিন্তু আমি খারাপ নেই । বরং অনেক ভাল আছি । তুমিও ভাল থেকো কেমন ।
আমি রিক্সায় উঠে পড়লাম । শশীকে বললাম
-ভাল থেকো মামনি ।
-তুমিও ।
মিষ্টি একটু হাসল । শশীর ঐ হাসিটুকু দেখে সত্যি বুকের মধ্যে কেমন যেন এক অজানা শূন্যতার সৃষ্টি হল । জয়িতা যখন আমাকে ছেড়ে গেছিল তখন যেমন ওর প্রয়োজনীতা অনুভব করতাম । আজও ওর অভাব অনুভুত হচ্ছে । ওদের দুজনের অভাব !
-ছার আপনে কানছেন ক্যান ?
-হুম কি বললে ?
রিক্সায়ালার কথায় বাস্তবে ফিরে এলাম । চোখে হাত দিয়ে দেখলাম সত্যিই আমার পানি পরছে ।
-না ঠিক কাঁদছি না । চোখের মধ্যে কি যেন এসে পরেছে তাই পানি পরছে ।
রিক্সা এগিয়ে চলছে টুংটাং শব্দ করে । আমিও এগিয়ে চলেছি এক জীবনকে পিছনে ফেলে অন্য এক জীবনের কাছে ।
(যদি প্রথম খন্ডটার লিংক কাজ না করে তবে একটু কষ্ট করে আমার প্রোফাইলে গিয়ে প্রথম অংশ টুকু পড়ে আসুন)
গল্পটা এখানে আছে
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মে, ২০১২ রাত ১২:১৪