আগে যখন করতো খুব একটা খারাপ লাগতো না । কিন্ ঐ ঘটনার পর আর আর ভাল লাগে না । মেজাজটা খারাপ হয় ।
একবার মনে হল ক্যান্টিন থেকে চলে যাই । অন্যান্য দিন যেমন পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলাম আজও যাই ! কিন্তু তারপর মনে হল আমি কেন পাশ কাটাবো ? আমার লুকানোর মত কিছু নাই ! আজ এর একটা দফারফা করতে হবে ।
সরাসরি ছেলেটার টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলাম । ছেলেটা আরাম করে চা খাচ্ছিল । আমাকে দেখে চা খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল । কিছু যেন বলতে চায় কিন্তু বলতে পারছেনা এমন অবস্থা ।
-আপনি এখানে কি করছেন ?
-চা খাচ্ছি ।
-চা খাচ্ছি মানে ? এখানে কেন ?
-না মানে এখানে কি চা খাওয়া নিষেদ নাকি ?
-দেখুন বেশি চালাকি করবেন না । আপনার অফিস মতিঝিলে আর আপনি এখানে এসে প্রতিদিন চা খাচ্ছেন ! ফাজলামো পেয়েছেন ?
ছেলেটা কোন কথা বলল না । এমন সময় সুমনকে আসতে দেখলাম । আমার মুখ দেখে নিশ্চই কিছু বুঝতে পেরেছে । কাছে এসে বলল
-কি হয়েছে রে নীলু ?
-কিছু হয় নি ।
-আমাকে বল কি হয়েছে ?
-আরে বললাম তো কিছু হয় নি । তুই যা ।
সুমন ছেলেটার দিকে বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে চলে গেল । আমি বললাম
-আপনি আর কখনও এখানে আসবেন না । সুমনকে দেখলেন না ? ওর মাথা কিন্তু খুব গরম । ওকে বললে কিন্তু আপনার হাতপা সব গুড়ো করে দেবে ।
ছেলেটা তবুও চুপ করে থাকল । এই ছেলেটা এমন নির্বিকার কেমন করে থাকে ? আর কিভাবে আমার সামনে আবার আসে আমি ভেবে পাই না । আবার বললাম
-কথা গুলো কি বোঝাতে পারলাম আপনাকে ? আপনি আর আসবেন না ।
অনেকক্ষন পর ছেলেটা মুখ খুলল
-আমি তোমার সাথে অল্প কয়েকটা কথা বলতে চাই ।
ছেলেটার কণ্ঠে কেমন যেন একটা আকুতি ছিল । একবার মনে হল শুনি কি বলতে চায় ! কিন্তু পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিলাম । খুব কঠিন করে বললাম
-আপনার সাথে আমার কোন কথা থাকতে পারে না ।
ছেলেটা কেমন জানি আহত হল । তবে আর কিছু বলল না । মাথা নিচু করে ছেলেটা চলে গেল ।
আমি ছেলেটার চলে যাওয়া দেখলাম । চোখের আড়াল হতেই কেন জানি আমার বুকের মধ্যে কেমন জানি তোলপাড় শুরু হল । আমার মনে হল আমার সব কিছু যেন আমার কাছ থেকে দুরে চলে যাচ্ছে ।
কেন জানি আমার খুব কান্না পেতে লাগল ।
বারবার মনে হল ছেলেটার সাথে এতো খারাপ ব্যবহার কেন করলাম ? ছেলেটার তো কোন দোষ নেই । ছেলেটাতো আমাকে পছন্দই করেছিল ।
আমি নিজে ছেলেটার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখেছি ওখানে কেবল আমার জন্য ভালবাসাই ছিল । অন্য কিছু না । তাহলে কেন খারাপ ব্যবহার করলাম ছেলেটার সাথে ?
ক্যান্টিনের কোনার টেবিলটায় বসে পড়লাম ও যেখানে বসে ছিল ।
সজিব মতিঝিলের একটা ব্যাংকে চাকরি করে । সজিবকে প্রথম দেখি মানে ও আমাকে দেখে ওরই অফিসে । নাবিলার কি একটা কাজে গেছিলাম ঐ ব্যাংকে ।
আমরা যখন ওর কাছে গেলাম প্রথম কিছুক্ষন কেন যেন একটা ঘোর লাগা চোকে সজিব আমার দিকে তকিয়ে থাকল ।
আমি দেখতে কোন কালেই খুব বেশি সুন্দর ছিলাম না । কিন্তু সজিবের এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আমার নিজের কাছে মনে হল হয়তো আমি খুব সুন্দর হয়ে গেছি । ঐ দিন বাসায় এসে আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেকে অনেক বার দেখলাম ।
তারপর থেকেই সজিব আমার আসে পাশে ঘোরাফেরা করা শুরু করে দিল । আমমি কখন ভার্সিটিতে যাই কখন আসি সব যেন ওর মুখস্ত ছিল । মাঝে মাঝে ভাবতাম এই ছেলেটা কি কোন কাজ কাম নাই । ব্যাংকের চাকরি ফেলে মেয়েদের পিছনে
ঘোরাঘুরি করছে । কিন্তু আমার ব্যাপারটা খারাপ লাগতো না ।
আমার দিকে ও যখন তাকাত অদ্ভুদ এক ভাল লাগার দৃষ্টি তাকাত । সত্যি কথা বলতে কি সজিবকে আমার খুব একটা খারাপ লাগত না । দেখতে সুদর্শন । ভাল জব করে আর সব থেকে বড় কথা সজিবের চোখ গুলো খুব সুন্দর ছিল । যখন আমার দিকে তাকাত কেমন যেন একটা দুত্যি ছড়াত ! সজিবের ঐ দৃষ্টি আমার খুব ভাল লাগত ! একদিন তো সোজাসুজি আমার সামনে এসে হাজির ।
বাসায় যাচ্ছিলাম । রিক্সায় উঠতে যাবো ঠিক এমন সময় আমার সামনে এসে হাজির ।
-আপনার সাথে কিছুক্ষন কথা বলা যাবে।?
- কেন আপনার সাথে কথা বলব? আপনাকে কে কি আমি চিনি ?
-চিনেন না । চিনবেন । সমস্যা তো নাই ।
-সমস্যা আছে ।
-আমার মা অপরিচিত মানুষের সাথে কথা বলতে মানা করেছে । আর আমি মা বাবার বাধ্য সন্তান ।
সজিব খুব হাসলো আমার কথা শুনে । বলল
-আচ্ছা । যান তাহলে । তবে গুড বাই বলবো না । আপনার সাথে খুব জলদিই দেখা হবে ।
আমি তখনও সজিবের ঐ কথার মানে বুঝতে পারি নি ।
ঠিক দুদিন পরে ও আমার বাসায় হাজির । একা আসে নি ওর মাকে নিয়ে এসেছে ।
আমার এক পরিচিত চাচার মাধ্যমে এসেছে । আমার মা বাবাও জানতেন কিন্তু আমাকে বলেন নি । সজিবই নাকি মানা করেছিল ।
আমি খানিকটা অবাক হয়েছিলাম । কিন্তু নিজের মনের মধ্যে খুব ভাল লাগছিল । অদ্ভুদ এক আনন্দ হচ্ছিল ।
কিন্তু তবুও মুখ যথাসম্ভব গম্ভির করে সজিবের মার সামনে গেলাম । ভদ্রমহিলা অনেকক্ষন আমাকে দেখলেন । কথা বার্তা জিজ্ঞেস করলেন । যাওয়ার সময় আমাকে ৫০০ টাকাও দিয়ে গেলেন । আর বলে গেলেন পরে জানাবে । এটা আমার কাছে কেমন যেন লাগল ।
দুচার দিন পার হয়ে গেল তবুও ঐ দিক দিয়ে কোন খবর পেলাম না । নিজের কাছেই খুব অস্বস্থির লাগছিল । শেষে লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে নিজেই মার কাছে জিজ্ঞেস করলাম ।
কিন্তু মা যা বলল তার জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না ।
সজিবের মার নাকি আমাকে পছন্দ হয় নি । আমার গায়ের রং নাকি ফর্সা না । সজিবের সাথে আমাকে মানাবে না ।
ঐ দিন রাতে অনেক কেঁদে ছিলাম আমি । নিজের সৌন্দর্য নিয়ে আমার কখনই কোন আক্ষেপ ছিল না । কিন্তু ঐ দিন নিজে কে বড় হীন মনে হল । বড় ক্ষুদ্র মনে হল ।
তরপর থেকেই সজিব কে আবার আমার আসে পাশে ঘোরাফেরা করতে দেখলাম । কিন্তু খুব কঠিন ভাবেই ওকে এড়িয়ে চললাম ।
ক্লাসক্লাস থেকে বের হতে হতে বেশ খানিকটা দেরি হয়ে গেল । প্রায় বিকেল হয়ে গেছে । মনটা খারাপই ছিল সকালের ঘটনার জন্য ।
গেটের কাছে আসতেই সজিবকে আবার দেখলাম । আমার ভার্সিটির গেটের কাছে একটা এটিএম বুথ আছে । এটিএম বুথের সিড়ির এক কোনায় পা ছড়িয়ে চুপচাপ বসে আছে ।
মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে । অপেক্ষা করতে করতেই মনে হয় এমনটা হয়েছে । আমার এবার সত্যি সত্যিই খুব মায়া লাগল । আমাকে দেখেও এগিয়ে এল না । কেবল তাকিয়ে থাকল আমার দিকে । নিজের কাছেই খুব খারাপ লাগছিল ।
এমন করে খারাপ ব্যবহার টা না করলেই চলত । আমি নিজেই এগিয়ে গেলাম ।
-আপনি এখনও কেন বসে আসেন ?
-এটিএম বুথে টাকা আছে কিনা চেক করতে এসেছি । তোমার সাথে দেখা করতে আসি নি ।
এতো মন খারাপের মধ্যেও আমার হাসি পেয়ে গেল । বললাম
-আপনি কোন ব্যাংকে চাকরি করেন আর এটা কোন ব্যাংকের এটিএম ?
সজিব কি বলবে বুঝতে পারল না ।
-অজুহাত দেখাবেন একটু ভাল করে দেখান ।
আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে সজিব বলল
-আমার অল্প কয়টা শুনবে না নীলু ?
সজিবের আকুতিটা কিছুতেই ফেলতে পারলাম না । ওকে নিয়ে এলাম ক্যান্টিনে । বললাম
-বলুন আপনার কথা ।
সজিব প্রথমেই কি বলবে কিছু বুঝতে পারল না । নিজের পকেটে হাত দিয়ে একটা আংটি বের করল । আমার দিকে আংটিটা এগিয়ে দিয়ে বলল
-এটা আমি তোমার জন্য কিনেছিলাম ।
-কিন্তু এটাতো আমার না । এই অধিকার তো আপনার মা আমাকে দেয় নি । আমি কেন নিবো ?
-নীলু আমি .... আমি ....
-আপনি কি ?
-নীলু আমি আমার সবটুকু ভালবাসা নিয়ে তোমার জন্য এই আংটিটা কিনেছিলাম । কেবল তোমার জন্য । পরিস্থিতি যাই হোক না কেন এটা সব সময় তোমারই থাকবে ।
-যদি আমি এটা না নেই ?
-হ্যা সেইটা আলাদা কথা । তুই ইচ্ছা করলেই আমাকে রিফিউজ করতে পারো ?
সজিব আর কিছু বলল না । চুপ করে বসে থাকল কিছুক্ষন । একটুপর বলল
-নীলু আমার কথা গুলো আমি বললাম । সিদ্ধান্ত নেবার দায়িত্ব তোমার । আমি আর তোমার সামনে আসবো না । তবে আমি বিশ্বাস করি তুমি একদিন এই আংটিটা পড়বে । আমি ঐ দিনটার জন্য অপেক্ষা করবো । দিনটা আজ হতে পারে কাল হতে পায়ে অথবা ...
সজিব কথা শেষ করল না
-অথবা ?
-আমি অপেক্ষা করবো নীলু । আমি অপেক্ষা করবো ।
সজিব আর দাড়াল না ।
আমি আংটিটার দিকে তাকিয়েই রইলাম ।
গল্পটা এখানে আছে
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০১২ বিকাল ৩:১৫