কে ডাকে ? আমি এদিক ওদিক তাকালাম । আশেপাসে হাজার খানেক লোকজন । কার দিকে তাকাবো ?
অবশ্য কণ্ঠটা খুবই পরিচিত । আমি ঐ পরিচিত মুখটাকে দেখার জন্য আবারও এদিক ওদিক তাকালাম । কিন্তু কোথায় ? কোথাও দেখতে পেলাম না ওকে !
-এই সুমন ! দাড়াও বলছি !
আমি এবার শব্দের উৎস লক্ষ্য করে তাকালাম । সামনে দাড়িয়ে থাকা বাসটার থেকে মনে হল আমাকে ডাক দিলো ।
সত্যিই তাই । একটু ক্ষনের মধ্যে নিশির মুখটা দেখতে পেলাম ।
হাসি মুখ । আমার দিকে তাকিয়ে হাসল ।
তারপর হাসলো । হাত নেড়ে বলল
-হাই !!
আমিও হাত নাড়লাম ।
-হাই !!
হাতের ইশারায় আমাকে দাড়াতে বলল ।
আমি বললাম
-আরে নামতে হবে না । নামতে হবে না ।
কিন্তু নিশি আমার কথা শুনলো না । তাড়াহুড়া করে বাস থেকে নেমে পড়ল ।
আমার সামনে দাড়িয়ে আর একবার হাসি দিল । ভুবন ভূলানো হাসি । আমি খানিকটা অস্বস্তিতে পড়লাম । অবশ্য অস্বস্তির কারনও আছে ।
আজ রবি বার । ঠিক বৃহস্পতিবারে আমি ওকে প্রোপজ করেছিলাম ।
মুখে বলার ঠিক সাহস হয় নি । একটা চিঠি লিখে দিয়েছিলাম ।
গত বৃহস্পতিবারে যখন চিঠিটা দিয়েছিলাম ও বলল
-কি এটা ?
আমি অস্বস্তি নিয়ে বললাম
- কিছু না । বাসায় নিয়ে পড় ।
নিশি হাসি মুখেই নিল ।
-এখন খুলবো না?
-না না এখন না । বাসায় গিয়ে !
নিশি হাসলো । আর কিছু বলল না ।
তারপর দুদিন পার হয়ে গেছে । নিশি আমাকে একবারও ফোন দেয়নি । আমি ও দেই নি । আমি অনেকবার দিতে চেয়েচিলাম । কিন্তু কেন জানি দিতে পারি নি । বারবার মনে হয়েছে না জানি নিশি কি বলবে ?
আমি ভেবেছিলাম ও নিজেই আমাকে ফোন করবে ! ভাবছিলাম ঐদিন রাতেই ও ফোন দিবে ! বলবে যে আমিও তোমাকে পছন্দ করি ।
কিন্তু সব কিছু তো আর আমি যেভাবে ভাববো ষেভাবে হবে না ।
নিশি আর ফোন করে নি । কাল পর্যন্ত আমি আশায় ছিলাম । কিন্তু আজ জানো সেটা আর বে না । তারমানে ও আমার প্রোপজ গ্রহন করছে না ।
অস্বস্তিটা বেড়েই চলছে । একবার মনে হল কি দরকার ছিল এমন একটা গাধামী করার ।
নিশির সাথে কি সহজ সম্পর্কই না ছিল ! দেখা হত । কথা হত । দিন তো খারাপ যাচ্ছিল না । তাহলে এতো তাড়াহুড়ার কি দরকার ছিল ?
আর কয়দিন অপেক্ষা করলে কি এমন ক্ষতি হয়ে যেত !!
এখন হয়তো আর কোনদিন ওর সাথে থিক মত কথাই বলতে পারবো না অস্বস্তির জন্য ।
বাস থেকে নেমে আমার দিকে এগিয়ে এল ও হাসিমুখে । আমর অস্বস্তিটা আরো এক ধাপ বেড়ে গেল । বললাম
-এখানে নামলে কেন? একবারে ক্যাম্পাসে গিয়ে নামতে !
-সমস্যা নাই ! বেশিতো দুর না । টোমার সাথে গল্প করতে করতে যাই ।
সমস্যা তো তোমার নাই । কিন্তু সমস্যাতো আমার । এখন আমি তোমার পাশাপাশি হাটবো কেমন করে ! বললাম
- না মানে একটু হাটতে হবে তো !!
-আহা!! হোক না !! সমস্যা তো নাই । তাই না? নাকি আমার পাশে হাটতে তোমার সমস্যা আছে ?
-না সমস্যা থাকবে কেন ? কি যে বল না !!
আমি হাসার চেষ্টা করলাম । নিশি কেমন চোখে যেন আমার দিকে তাকাল । তারপর হাসলো । ওর হাসি দেখে আমার মনটা আরো একটা কেমন করে উঠল ।
বার বার মনে হচ্ছিল নিশি যদি এখন চিঠির প্রসঙ্গ তোলে !! তাহলে লজ্জার সীমা থাকবে না । যদি বলে -আবির তোমার কাস থেকে আমি এটা আশা করি নি । আমি তোমাকে কেবল বন্ধু মনে করতাম ।
দুঃখের বিষয়টা এখানেই । মেয়েরা কেবল আমাকে বন্ধুই মনে করে । উপকারি বন্ধু ।
-এই নাস্তা করছো ?
- না এখনো করি নি । ক্যান্টিনে গিয়ে করি ?
-ঐখানে খুব ভীড় থাকে । ঢুকতে ইচ্ছা করে না । আসো এই হোটেল টাতে ঢুকি !
-চল ।
ওকে হোটেলে ঢুকে পড়লাম নাস্তা করার জন্য । কোনার দিকে একটা টেবিল নিলাম ।
নাস্তা আসতে আসতে নিশি আমাকে বলল
-সুমন
-বল ।
-আজকে একটা বিশেষ দিন জানো ?
- কি বিশেষ দিন ?
-এখন বলবো না । পরে ।
-পরে কেন? এখনই বল ।
-না এখন বললে মজা নষ্ট হয়ে যাবে । পরে ।
না জানি কি বলবে । আমার মনের ভীতর কু ডাকতেই থাকে । বারবার ঐ একই কথাই মনে হতে থাকে । কি দরকার ছিল ? কি দরকার ছিল ওকে প্রোপজ করার ।
আজ নিশিটাও কেমন জানি রহস্যময় আচরন করছে । আগে তো আমার সাথে এমন করে কথা বলতো না । যা মনে আসে বলে ফেলতো । হাসতো আমাকে হাসাতো । আমিও ওর সাথে মজা করতাম । কিন্তু আজ কিছুই করতে পারছি না ।
মোট কথা ওর সাথে সহজই হতে পারছ না ।
মোটামুটি চুপচাপই নাস্তা খেলাম দুজনে । তবে নাস্তা খাওয়ার সময় দেখলাম ও বারবার আমার দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছে । আর কেমন একটা অদ্ভুদ হাসির রেখা ফুটে উঠছে ওর মুখে । ঐ হাসির রেখটাই আমার অস্বস্তিটা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে ।
ক্যাম্পাসে ঢুকতে ঢুকতে নিশি বলল
-আজ ক্লাস কখন শেষ ?
-আজ একটু দেরি হবে ।
-কত দেরি ?
-এই তিনটা !
-এতো দেরি ??
- হুম এক্সেম আছে ।
-ও !
ওকে খনিকটা হটাশ মনে হল । আমি বললাম
-তুমি বাসায় চলে যেও কেমন ! কাল কথা হবে আবার । এই বলে আমি ডিপার্টমেন্টের দিকে হাটা দিলাম । ও চলে গেল ওর ডিপার্টমেন্টের দিকে ।
আসলে আমি চাইছিলাম ওর সাথে আর আমার দেখা না হোক ! খুব লজ্জা লাগছিল ওর সামনে দাড়াতে !
ছি! কি লজ্জার একটা বিষয় !!
ওকে কেন যে প্রোপজ করতে গেলাম !
নিশি সব সময় আমাকে বলতো যে এই ঢাকা শহরে আমি নাকি ওর সব থেকে ভাল বন্ধু । সব থেকে কাছের মানুষ । তাই ও সব সময় আমার সাথে সব কিছু শেয়ার করতো । আর আমি কি করলাম !!!
গাধার মত ওকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়া বসলাম !!
কি এমনটা প্রয়োজন ছিল !
নিশি কখনই আমাকে ঐ রকম কিছু ইঙ্গিত দেই নি । ভার্সিটিতে আসতো আমার সাথে দেখা করতো । আড্ডা মারতো এই । তবে এটা সত্যি যে আমি ছাড়া ওর আর কোন ভাল বন্ধু নেই । নেই মানে ওকে আর কখনও অন্য কারো সাথে আমি কথা বলতে দেখি নি । এর যা কথা বার্তা সব কিছু আমাকে ঘিরেই । একেবারে ভার্সিটির ভর্তির প্রথম দিন থেকেই ।
ওর সাথে পরিচয় হয় খানিকটা অদ্ভুদ ভাবেই । ঐ দিন ভর্তির শেষ দিন ছিল । টাকা পয়শা ব্যাংকে জমা দিয়ে যখন বের হব ঠিক তখন দেখলাম একটা মেয়ে ব্যাংকের এক কোনায় দাড়িয়ে আছে চুপচাপ । এমনি সাধারন ভাবেই পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলাম । ঠিক তখনই মেয়েটার চোখের দিকে আমার দৃষ্টি গেল । কি মায়াময় একটা চোখ ! আর ঐ মায়াময় চোখদুটোতে পানি টলমল করছে । যে কোন সময় পানি গড়িয়ে পড়বে । কৌতুহল কিছুতেই দমাতে পারলাম না । কাছে গিয়ে বললাম
-কি হয়েছে ?
মেয়েটা আমাকে একবার দেখল । একবার মনে হল হয়তো বলবে না । কিন্তু একটা পর মুখ খুলল । যা বলল তার সারমর্ম হল আজ টাকা জমা দেবার শেষ সময় । কিন্ত বাসে আসার সময় ওর ব্যাগ হারিয়ে গেছে । ব্যাগের ভিতর ওর মোবাইল আর ভর্তি ফি ছিল ! বলতে বলতে মেয়েটা চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল ।
আমি বললাম
-ঢাকায় কোন আত্মীয় আছে ?
মেয়েটা মাথা নাড়াল ।
আমি বললাম
-বাসায় ফোন কর আমার মোবাইল দিয়ে ?
-বাসায় ফোন করে লাভ নাই । আজকের মধ্যে টাকা পাঠানো সম্ভব হবে না ।
মেয়েটা নিরবে কাঁদতে লাগল । আমার কেন জানি খুব মায়া লাগলো ।
বুদ্ধি দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে এসব ঝামেলায় নিজেকে জড়ানোর কোন দরকারই নাই । কিন্তু মন সাই দিলো না কিছুতেই । মেয়েটাকে ছেড়ে আসতে পারলাম না কিছুতেই । উপকার করলামই!
প্রথম প্রথম ঢাকায় এসেছি বলে বাবা বেশ মোটা অংকের টাটাই দিয়ে ছিল ।
মেয়েটার টাকা জমা দিয়ে দিলাম । ঐ দিনই জানলাম মেয়েটার নাম নিশি । তারপর থেকে নিশির সাথে আপনা আপনি বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে । আর এখন আমার মনে হচ্ছে সেই বন্ধুত্বের সমাপ্তির সময় চলে এসেছে ।
পরীক্ষা শেষ করতে করতে প্রায় সাড়ে তিনটা বেজে গেল । পরীক্ষা খুব বেশী ভাল হয় নি । তাই মেজাজটা একটু খারাপ ই ছিল । কিন্তু যখন ডিপার্টমেন্ট থেকে বের হলাম দেখলাম সামনের মাঠটাতে নিশি বসে আছে । বেশ খানিকটা অবাকই হলাম । এই মেয়েটা এতোক্ষন বসে আছে কেন ?
আমাকে বের হটে দেখে এগিয়ে এল ।
-বাব্বাহ !! বের হলে শেষ পর্যন্ত ?
আমি বললাম
-তুমি এতোক্ষন বসে আছো কেন? কোন দরকার ছিল নাকি ? আশ্চর্য !
কাল বলা যেত না??
নিশির মন যেন একটু খারাপ হল । ও আমার দিকে না তকিয়া অন্য দিকে তাকাল ।
-কি হল কথা বলছো না কেন ? এটার কোন দরকার ছিল ? -এটার কি কোন দরকার ছিল ? তিন ঘন্টা কি কেউ এমনি এমনি বসে থাকে ?
নিশি এবার আমার দিকে তাকাল !।
-তুমি বুঝবে না । আমি এতোক্ষন ধরে তোমার জন্য বসে আছি আর তুমি কিনা.............!!!
নিশি কথা শেষ করলো না । ঠিকই তো । মেয়েটা এতোক্ষন ধরে আমার জন্য বসে আছে, নিশ্চই জরুরী কিছু । সকাল বেলাতেই বলেছিল যে আজ একটা বিশেষ দিন । আমি ভেবেছিলাম অন্য কিছু । আমার চিঠি বাদ দিয়েও তো অনেক কিছু থাকতে পারে !
আমি বললাম
-আচ্ছা ! সরি । বল । কসের জন্য বসে আছো ? আজ কি বিশেষ দিন ?
-বলব না ।
-আরে বলবা না কেন? প্লিজ বল । প্লিজ ! আচ্ছা আমি সরি তো বলেছি ।
নিশি কি যেন ভাবলো ! তারপর একটা ঘাসে ভরা জায়গা দেখিয়ে বলল
-আসো ঐ খান টাতে বসি
দুজন বসলাম । খানিক্ষন চুপ থাকলাম দুজন । তারপর নিশি বলল
-তোমার চিঠি আমি পড়েছি।
আমার অস্বস্তিটা আবার ফিরে এল । না জানি কি বলবে !! আমি খুব আসতে করে জিজ্ঞেস করলাম
-তো তোমার কি .......... কথা শেষ করতে পারলাম না ।
-তোমার চিঠি দেওয়া দেখেই আমি বুঝে গেছিলাম যে ওর মধ্যে কি আছে । আমি ঐদিন হ্যা বলতাম কিন্তু.।
ও হ্যা বলত !!! ও মা্ই গড !!
আমি বললাম
-কিন্তু....?
-আজ একটা বিশেষ দিন বলছিলাম না?
-হুম । কি বিশেষ দিন ?
-আজ আমার জন্মদিন । আমি চাচ্ছিলাম এই দিনে তোমার প্রোপজটা এক্সেপ্ট করি ।
-ভাল করেছ । এক গিফট দিয়া দুটা অকেশন পার হয়ে যাবে ।
নিশি হাসলো ।
এতোক্ষন যে টেনশনে ছিলাম তা দুর হয়ে গেল ।
যাক বাবা!! বাঁচলাম।
গল্পটা এখানে আছে