আমাদের ইংরেজি স্যার বলতেন সময় সব বেদনার সফল ঔষধ । আসলেই তাই । কিন্তু এখন ও আকাশে মেঘ ডাকলে ওর কথা মনে পড়েই যায় ।
ও বারান্দার গ্রিল ধরে বৃষ্টি দেখতে খুব পছন্দ করত । প্রায় ই দেখতাম গ্রিলের মধ্যে হাত দিয়ে ও বৃষ্টির পানি নিয়ে খেলা করছে । আমি সুযোগ পেলেই দেখতাম ওকে । মুখোমুখী বাসা হওয়ার ওর বাবান্দা টা খুব ভাল করেই দেখা যেত আমার জানালা থেকে । প্রথম প্রথম আমাকে দেখলেই ও ঘরের ভিতর চলে যেত । কিন্তু একদিন দেখলাম আমাকে দেখেও ও বারান্দা থেকে চলে গেল না । আপন মনে বৃষ্টির জল নিয়ে খেলতে থাকলো । সে দিন আল্লাহর কাছে বারবার দোয়া করছিলাম যেন বৃষ্টি না থামে । তারপর থেকে প্রায়ই চলতে থাকলো আমাদের চোখাচোখির খেলা । মাঝে মাঝে এক চিলতে হাসিও দিত আমাকে দেখে ।
এক দিনের কথা । রাত তখন একটা দেড়টা হবে । আমি পড়ছিলাম । হঠাৎ দেখি আমার ঘরের মাঝে লাল লাল কিছু আলো বিন্দু খেলা খেলছে । প্রথমে ভয় পেলেও পরে বুঝলাম আলো টা আসছে সামনের বারান্দা থেকে । দৌড়ে গিয়ে দাড়ালাম জানালার কাছে । গিয়ে দেখি প্রিন্সেস দাড়িয়ে আছে বাড়ান্দায় ।
আজ আর কোন লুকচুরি নয় । সরাসরি তাকিয়ে ছিলাম ওর চোখের দিকে । ও ঠিক একই ভাবে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে । কোন কথা নাই কেবল দুই জোড়া চোখ একে ওপরের দিকে তাকিয়ে আছে অপলক । কতক্ষন তাকিয়ে ছিলাম জানি না । এক সময় ও কথা বলে উঠল
-ঘুমিয়ে পড় , বেশি রাত জাগতে নেই ।
ব্যস এইটুকুই । তারপর ও ঘরের ভিতর চলে যায় । একটু পর লাইট বন্ধ হয়ে যায় ওর ঘরে । এভাবেই চলতে থাকে দিনের পর দিন । কোন কথা নাই কেবল নির্বাক চেয়ে থাকা একে ওপরের দিকে ।
তারপর একদিন ঘটল সেই অবিশ্বাস্য ঘটনা । যার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না মোটেই ।
সেদিন সকালবেলা স্কুলে যাচ্ছিলাম । সকাল বেলা । স্কুলের সামনে নেমে রিক্সা ভাড়া দেওয়ার জন্য টাকা বের করছি এমন সময় আমার চোখ গেল স্কুলগেটের পাশের কড়ই গাছটার নিচে । একটা স্কুল ড্রেসপরা একটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে জড়সড় হয়ে । মেয়েটার দিকে ভাল করে তাকাতেই .....
OMG!!!
এতো..... ও ।
ও মানে আমার সামনের বাড়ির মেয়েটা ।
ও এখানে ??
মনের মধ্যে হাজার টা প্রশ্ন এক সাথে উকি দিলো ।
ও এখানে কি করছে ?
কি চায় ?
এখানে কি কারো সাথে দেখা করতে এসেছে ?
আমার সাথে নাকি ?
এরকম হাজার টা প্রশ্ন । যার কোন টারই উত্তর আমার জানা নাই । খানিকটা দুরুদুরু হৃদয় আর কাঁপা কাঁপা হাতপা নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে গেলাম । মেয়ে সেই একই ভাবে নির্বাক চোখ নিয়ে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে ।
কাঁপা গলায় বল্লাম "এখানে ?"
ও কিছু বল্লো না । বইয়ের ভিতর থেকে একটা খাম বের করে আমার দিকে এগিয়ট দিল । আমার কি মনে হচ্ছিল বলতে পারব না । কিন্তু যা হচ্ছিল তা আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না কিছুতেই ।
তাই খানিক টা বেকার মতই প্রশ্ন করলাম
"কি এটা ? আমার জন্য ?"
প্রশ্ন করার পর মনে হল কি গাধা আমি ! কি বলব আর কি বললাম । ও খানিকটা গম্ভীর মুখ নিয়ে বল্লো
-এপ্লিকেশন লেটার । তোমার হেড স্যারের জন্য ।। গাধা কোথাকার ! বোঝ না কি ?
তারপর ও পেছন ঘুরে হাটা ধরল । একবার মনে হল ডাক দেই । দিলাম না ।
কিন্তু দেখলাম ও নিজেই ঘুরে তাকাল । এক বার । পরে আরো একবার ।
ওর যাওয়া দেখতে দেখতেই খাম টা খুল্লাম । A4 সাইজের অপসেট পেপার । পুরো পৃষ্টায় কেবল একটা বাক্যই লেখা ।
"আমি তোমাকে ভালবাসি"
ব্যস আর কিছু না । অবশ্য আর কিছুর দরকার ও নাই । চিঠি থেকে মুখ তুলে ওর দিকে তাকালাম । ততক্ষনে ও অনেক দুর চলে গেছে । খুব ইচ্ছা করছিল দৌড়ে গিয়ে ও কে বলি "আমিও তোমাকে ভালবাসি" । কিন্তু স্কুলের ঘন্টা পড়ে যাওয়ায় আর যাওয়া হল না । অন্য রকম এক ভাল লাগা নিয়ে স্কুলে ঢুকলাম । মন তখন অসম্ভব ভাল ।
কিন্তু মন বেশিক্ষন ভাল থাকে নি সেদিন । প্রথম পিরিয়ড যাওয়ার আগের বাসা থেকে খবর আসে যে আব্বা গাড়িতে করে অফিস যাওয়ার সময় এক্সসিডিং করেছে । স্কুল থেকে হাসপাতালে চলে যেতে হয়েছিল । তারপর কিভাবে দিন চলে গেল টের ই পেলাম না । আব্বা একটু সুস্থ হলে তারপর আসি বাসায় । তাও প্রায় ৭/৮ কেটে গেছে । বাসায় এসে প্রথমেই ওর কথা মনে পড়ল ।
অনেক্ষন জানালার কাছ দাড়িয়ে থাকলাম । বিভিন্ন ভাবে জানান দেওয়ার চেষ্টা করলাম যে আমি এসেছি । কিন্তু তার কোন খবর নাই । ভাবলাম হয়তো রাতের বেলায় আসবে । কিন্তু রাতের বেলাও সে এল না । তারপর দিনও না । এমন কি তারপর দিনও না ।
তারপর ই সেই খবর পেলাম তার । ৫ দিন আগেই নাকি তারা বাসা ছেড়ে চলে গেছে । ওর বাবার হঠাৎ করে বদলির নির্দেশ আসায় নাকি এমন টা করতে হয়েছে ।
হায়রে কপাল আমার ! আমার প্রেম কাহিনী শুরুর আগেই শেষ হয়ে গেল । ও চলে যাওয়ার পর আমার দিন গুলো কষ্টে কাটতো । কিচ্ছু ভাল লাগতো না । বেঁচে থাকাটা বড় অর্থহীন মনে হত । মনে হত মরে যাই ।
তারপর আর আমার জীবনে প্রেম আসে নি । সময় গড়িয়েছে । স্কুল পেরিয়ে কলেজ তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি তবুও তার কথা ভূলতে পারি নি কিছুতেই । তাকে হারানোর ক্ষত হয়তো শুকিয়েছে কিন্তু সেই দাগ মুছে যায় নি । এভাবেই দিন চলে যাচ্ছিল ।
তারপর……… তারপর ঘটলো আবার এক অবিশ্বাস্য ঘটনা । ও আবার এল আমার জীবণে । এমন ভাবে যা আমি কল্পনাই করি নি ...
সেদিন আমাদের ডিপার্টমেন্টে নবীণ বরণ অনুষ্ঠান ছিল । স্যারদের সাথে ভাল সম্পর্ক থাকার কারনে মোটামুটি সব দায়িত্বই ঘারে এসে পড়ল । অনুষ্ঠান শুরু হবার পর থেকেই আমার কেন কেন জানি মনে হতে থাকে কেউ যেন আমাকে দেখছে । আমার দিকেই তাকিয়ে আছে । এই ফিলিংসটা আমার খুব স্ট্রং । কেউ আমার দিকে কিছুক্ষন তাকালেই আমি বুঝে ফেলি ।
খুব বেশি আমলে নিলাম না । কারন এতো ছেলে মেয়ে যে কেউ তাকাতেই পারে ! অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে সব নতুন ছেলে মেয়ে দের দাড়িয়ে নাম ঠিকানা বলতে বলা হল । সবাই একে একে বলতে থাকে । কে কোথা থেকে এসেছে ইতাদি । আমরা বন্ধুরা যারা অনুষ্ঠানে ছিলাম সবাই ই ব্যস্ত ছিলাম ।
তবুও একটা নাম শুনে আমার বুকটা ধক করে উঠল । আমি ফুল ঠিকঠাক করছিলাম নতুন শিক্ষার্থীদের দেবো বলে ।
এমন সময় একজন তার নাম ঠিকানা বলছিল । "আমি রেহনুমা নাহিদ । এসছি যশোর থেকে ...."
আমি চড়কির মত ঘুরে দাড়ালাম । কন্ঠ টা আমার খুব চেনা । এতো বছর পরও একটুও ভূলি নাই সে স্বর । আর রেহনুমা নাহিদ ওর নাম ।
আমার যেনো বিশ্বাসই হচ্ছিলো না যা ও হতে পারে । তাকালাম ওর দিকে । আমি কত দিন পর আবার ঐ মুখ খানি দেখলাম ।
সেই নির্বাক চোখ জোড়া একই ভাবে তাকিয়ে আছে আমার দিকে । এরপর যতক্ষন অনুষ্ঠান চলল আমাদের সেই চোখাচোখির খেলা চলল । এমনকি নবীন বরণের ফূলটাও আমি নিজে হাতে ওকে দিলাম ।
অনুষ্ঠান শেষ হতেই আমি তাড়াতাড়ি বের হতে চাইলাম । কিন্তু স্যার আটকে দিলেন । সব কাজ শেষ করে বের হতে হতে আরো ঘন্টা খানেক পাড় হয়ে গেল । ততক্ষণে পুরো ভার্সিটি ফাঁকা হয়ে গেছে । ও এতোক্ষন নিশ্চই অপেক্ষা করবে না । মনটা খানিক খারাপ হল । তবুও ওকে তো আবার ফিরে পেলাম ।
মাই গড ! আমার এখনও বিশ্বাসই হচ্ছে না । ও কে আবার দেখতে পাবো ভাবিনি । ভাল লাগছে মনের ভিতর ।
কিন্তু আজ আর একবার দেখা হলে ভাল লাগতো !
গেট দিয়ে বের হবার সময় ....
আবার একই দৃশ্যের পুনরাবূত্তি হল । দেখলাম সেই সেদিন কার মত ও গেটের কাছে জড়সড় হয়ে দাড়িয়ে আছে ।
আমার জন্য !
আবারও সেই দুরুদুরু বুক নিয়ে ওর সামনে দাড়ালাম । কত কিছু বলার ছিল ওকে ! কত কিছু জানার ছিল ওর কাছ থেকে । কি বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না । কিন্তু আমার স্বভাব যা । আবারও বোকার মত জানতে চাইলাম
-তোমার কোন বয়ফ্রেন্ড নেই তো ?
প্রশ্নটা করেই মনে হল এটা কি বললাম !!
ও গম্ভীর হতে গিয়ে হেসে ফেলল । বলল
-বয়স বেড়েছে বুদ্ধি বাড়েনি । অন্য কোন বয়ফ্রেন্ড থাকলে আমি দুঘন্টা ধরে তোমার জন্য এখানে দাড়িয়ে থাকতাম না । গাধা কোথাকার ।
(সমাপ্ত)
বিঃদ্রঃ এটা আমার ব্লগ জীবনে লেখা প্রথম গল্প । অপরিপক্ক হাতের লেখা । অবশ্য এখনও অপরিপক্কই আছি । সবার প্রথমে পোষ্ট করেছিলাম এই গল্পটা । আজ কেন জানি আবার দিতে ইচ্ছে হল । অনেকে হয়তো পড়েছেন । আবারও পড়েন । টাটা
গল্পটা এখানে আছে
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে এপ্রিল, ২০১২ রাত ১০:৩২