আমি ঈশিতার দিকে চট করে তাকিয়ে নিলাম । পৃশিতার কথায় বেশ বিরক্ত মনে হল । আমি বললাম
-আমি তো নাচি না । গিটার বাজাই । আর ডাক্তারী করি ।
- উহুহুহুন !! নাচবো !!
ঈশিতা এবার বেশ বিরক্ত হল । বোনকে বলল
-পৃশু খুব পেকেছিস না । বাসায় চল । তোর পাকামো বের করছি । আমি পৃশিতা কে বললাম
-পৃশু তোমাদের বাসায় ফ্যান চলেতো সব ঘরে ?
-কেন ভাইয়া এই কথা কেন বলছো ?
-না মানে যা গরম পরেছে আর তোমার আপার মাথা যা গরম ! ফ্যান না চললে তো সমস্যা । গরমে গরমে না পৃথিবী গরম হয়ে যায় ! দেখবে উত্তর মেরুর সব বরফ গলে গেছে এই গরমের ঠ্যালায় ।
পৃশিতা খিল খিল করে উঠল । বলল
-ঠিক বলেছ ভাইয়া । সারাক্ষন গরম থাকে ! আমার জান ঝালাপালা করে দেয় ।
-পৃশু একটা কাজ করা যেতে পারে ।
-কি ভাইয়া ?
-এখনতো গ্যাস সংকট চলছে । গরম মাথার উপর যদি রান্না বসিয়ে দেওয়া হয় তাহলে কেমন হবে ।
-খুব ভাল হবে ভাইয়া !
ঈশিতা আসতে আসতে গরম হচ্ছে বুঝতে পারছিলাম । আমাদের সাথে আর না বসে উঠে চলে গেল । ছাদের ঐ পাশটাতে গিয়ে বসল ।
ঈশিতা যেখানে গিয়ে বসল এখান থেকে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে । আগে তো পৃশুর পাশে বসে ছিল । ওখে দেখতে হলে মাথা ঘুরাতে হচ্ছিল । এখন আর মাথা ঘুরাতে হচ্ছে না । ওকে এখান থেকে ভাল ভাবেই দেখা যাচ্ছে ।
ঈশিতা সব সময় খুব গম্ভীর থাকে । কদিন আগে আমার সাথে টুকটাক কথা বলতো । কথা বলত মানে কথা জানতে চাইলে উত্তর দিতো । ইদানিং তাও দেয় না ।
আমি পৃশুকে জিজ্ঞেস করলাম
-তোমার অপুর কি হয়েছে ?
-আপুর ?
হঠাৎ পৃশুর মুখটা কেমন জানি কালো হয়ে গেল ।
-কই কিছু হয় নি ।
পৃশু যেভাবে বলল আমার মনে হল সত্যি সত্যি কিছু না কিছু হয়েছে ।
-ভাইয়া তোমাকে একটা কথা বলবো ?
-বল ।
- প্রোমিজ কর আপুকে বলবা না ।
-আচ্ছা বলবো না ।
-আপু না তোমার গিটার বাজানো অনেক পছন্দ করে । তুমি যখন রাতের বেলা বারান্দায় বসে গিটার বাজাও আপু খুব মন দিয়ে শোনে ।
কথাটা শুনে কেন জানি খুব অবাক হলাম । খুব ভাল লাগল । পৃশু বলল
-আপুর কাছে যাই ? আপু অনেক ক্ষন একা একা বসে আছে ।
বললাম
-চল আমিও যাই ।
পৃশুকে নিয়েই ঈশিতার কাছে গেলাম । ও গম্ভীর মুখে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে । অন্য দিকে ।
-আচ্ছা পিশু তোমার আপা কি দাত ব্রাস করে না ?
-করে তো ভাইয়া ।
-কেন বলছো ?
-না আমি তো কখনও তাকে হাসতে দেখলাম না । ভাবলাম হয়তো দাতে কোন সমস্যা ।
-না ভাইয়া আপুর দাত অনেক সুন্দর । হাসিও অনেক সুন্দর ।
-পৃশু চাপ থাক । তুই কিন্তু বেশি কথা বলছিস ? আর আপনি ?
ঈশিতা আমার দিকে তাকাল ।
-আমার পেছনে কেন লেগেছেন ।
-আরে আমি কখন লাগলাম আপনার পিছনে । আমি তো কেবল আপনার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছি ।
-কেন ? কেন চেষ্টা করছেন ?
-আপনি বোঝেন না কেন চেষ্টা করছি ?
ঈশিতা তীব্র চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষন । আসতে আসতে লক্ষ্য করলাম চোখের দৃষ্টিটা নমনীয় হয়ে এল । ঈশিতা চোখের দৃষ্টি নামিয়ে নিল ।
এই মেয়ে গুলে এমন কেন হয় ? কখন যে কি করে বোঝা বড় মুশকিল ! পৃশু বলল
-জানো ভাইয়া আপার শরীরটা না ভাল না । এই জন্য আপু সবার সাথে এমন করছে । তাছাড়া আপুটা এমন করে না ।
-পৃশু তোকে না বললাম চুপ থাকতে । এতো কথা কিসের ?
-কি হয়েছে ?
-আমি বলতে পারবো না । আমাকে বকবে ।
এবার আমি ঈশিতাকে বললাম
-কি হয়েছে ?
-কিছু হয় নি ।
-প্লিজ বলেন । বললাম না কিছু হয় হয় নি । আপনি কেন বার বার এমনটা করছেন ? দেখুন প্রিতম সাহেব আপনি যা চাচ্ছেন আর হবে না ।
হবে না মানে কি ? ঈশিতা আমার কথার জবাব না দিয়ে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে । শেষ বিকেলের এই আলোতে ঈশিতাকে কেমন জানি বড় বিষন্ন মনে হল ।
রাতে পড়া শুনা করছিলাম হঠাত্ একটা এসএমএস আসলো মোবাইলে । পৃশু পাঠিযেছে । মেসেজে পৃশু লিখেছে ভাইয়া আপু ছাদে গেছে । এতো রাতে ঈশিতা ছাদে কি করছে ? আমিও ছাদে উঠে এলাম চুপিচুপি । দেখলাম ঈশিতা বিকেল বেলা যেখান টাতে বসে ছিল এখনও সেই খানে বসে আছে । ওর পাশে গিয়ে বসলাম । কিছুক্ষন চুপচাপই রইলাম দুজনে ।
হঠাৎ ঈশিতা বলল
-কিছু বলছেন না যে !
-কি বলবো ! তোমার পাশে বসে থাকতেই ভাল লাগছে ।
ঈশিতা আমার দিকে ফিরে তাকাল । আমি ভেবেছিলাম আপনি থেকে তুমি বলাতে হয়তো ঈশিতা একটু আরগু করবে । কিন্তু দেখলাম কিছু বলল না । আরো কিছুক্ষন চুপ থাকার পর ও বলল
-পৃশু আপনাকে এসএমএম পাঠিয়েছে তাই না ?
-কই না তো । আমি এমনিই ছাদে এসেছি ।
হঠাৎ ঈশিতা হেসে উঠল । বলল
-কেন মিথ্যা কথা বলছেন ?
-না ও পাঠায় নি ।
ঈশিতা হাসতে হাসতে বলল
-আপনি ঠিকই বলেছেন ও পাঠায় নি । এসএমএস টা আমি পাঠিয়েছি ।
-কি ?
আমি খানিকটা অবাক হলাম ।
-সত্যি ?
-হুম ।
-কেন জানি আপনার সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছা করছিল ।
-আচ্ছা ।
কথাটা শুনে কেন জানি খুব ভাল লাগল ।
-কাল রাতে আপনি গিটার বাজাচ্ছিলেন । শুনছিলাম ।
-তাই ?
-হুম । আপনি খুব সুন্দর বাজান ।
বলেই ঈশিতা চুপ করে গেল । তারপর হঠাৎ বলল
-আপনারা ডাক্তার রা খুব নির্দয় হন, তাই না ?
কিসে মধ্যে কি ? অবাক না হয়ে পারলাম না । বললাম
-এই কথা কেন বললেন ?
-আপনারা কিভাবে একটা প্রানকে মেরে ফেলেন ! কাটাকুটি করেন । খেলা করেন ।
-ছি ! এমন কথা কেন বলছ ? ডাক্তাররা কখনই এমন হয় না । তারা সবসময় চেষ্টা করে মানুষকে বাঁচানোর জন্য । সর্বাত্তক চেষ্টা ।
-তাই .....না ?
ঈশিতার কন্ঠ কেমন যেন লাগল !
-আমি যাই !
-মাত্রই তো এলে ।
-যাই । শরীরটা ভাল লাগছে না ।
-ঈশিতা তুমি কিন্তু বললে না তোমার কি হয়েছে ?
ঈশিতা হাসল । বলল
-আপনি না ডাক্তার । রোগীর রোগ ধরতে পারলেন না ?
ঈশিতা আর দাড়াল না । আমি ঠিক বুঝলাম না ও হঠাৎ এমন অদ্ভুদ আচরন কেন করল । নিজেই আমাকে আসতে বলল । আবার কিছু না বলে চলে গেল । এতো হেয়ালীর কোন মানে হয় । মাঝে মাঝে মনে হয় ওর পেছনে আর ঘুরে লাভ নাই । নতুন কোন প্রোজেক্ট হাতে নেই । কিন্তু বেশ খানিকটা পছন্দ করি । আর পারিবারিক ভাবেও কথা বার্তা চলছে । তাই অন্য দিকে আর যেতে ইচ্ছা করে না ।
এভাবেই চলছিল । দুতিন দিন পর দুপুর বেলা । দুপুর বেলা শুয়ে ছিলাম । এমন সময় পৃশু ছুটতে ছুটতে আমার ঘরে এল । ওকে এভাবে হাপাতে দেখে বললাম
-কি হয়েছে পৃশু এভাবে হাপাচ্ছ কেন ?
-ভাইয়া জলদি চল । আপা না মাথা ঘুরে পড়ে গেছে । প্লিজ চল ।
প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র নিয়ে দৌড়ালাম পৃশুদের ফ্লাটের দিকে । গিয়ে দেখি ঈশিতা মেঝেতে কেমন ভাবে পড়ে আছে ।
ঈশিতার বাবা মা দুজনই চাকরি করে । তাই এসময় কেউ থাকে ওদের বাসায় । দুজন মিলে বিছানায় তুললাম ওকে ।
হাতের পালস দেখলাম । চোখ দেখলাম । সব কিছুই দেখলাম । আমার মনে কেন জানি সন্দেহ হল । পানি ছিটিয়ে ওর জ্ঞান ফেরালাম । বললাম
-ঠিক আছেন আপনি ?
-হুম ।
ঈশিতা আমার দিকে তাকাল না । কেমন জানি একটা লুকানো লুকানো ভাব দেখলাম । যেন আমার দিকে তাকালে আমি কিছু একটা বুঝে ফেলবো ।
-কি হয়েছিল ?
-হঠাৎ মাথাটা ঘুরে উঠল ।
-কদিন থেকেই এমন হচ্ছে ?
ঈশিতা কিছু বলল না । পৃশু বলল
-হ্যা ভাইয়া কদিন থেকেই এমন হচ্ছে । আর আজ সকাল থেকে বেশ কয়েক বার বমিও হয়েছে ।
আমি ঈশিতার চোখের দিকে তাকালাম । ওর চোখ দুটো কেমন জানি অস্থির মনে হল । বারবার এদিক ওদিক নড়াচড়া করতে দেখলাম । আমি পৃশুকে বললাম
-একটু পানি গরম করে নিয়ে আসো তো আপু ।
-আচ্ছা !
পৃশু চলে গেলে আমি ঈশিতার হাত ধরলাম । ও ঠিক তখনই আমার চোখের দিকে তাকাল । যাও একটু সন্দেহ ছিল ওর চোখের দিকে তাকিয়ে তাও দুর হয়ে গেল । আমি কিছুক্ষন কোন কথাই বলতে পারলাম না । এতো খারাপ লাগছিল নিজের কাছে ।
যে মেয়েটাকে এতো দিন ধরে পছন্দ করে আসছিলাম সে কোন দিন আমার ছিলই না ।
বললাম
-কবে থেকে সিওর হলে ?
আর লুকিয়ে লাভ নেই জেনে বলল
-এই মাস খানেক ।
-এই জন্য সেদিন কথাটা বলেছিলে ! ডাক্তাররা কেন এতো নির্দয় হয় ?
ঈশিতা কোন কথা বলল না ।
-ঈশিতা আমরা কখনও কোন প্রানকে মেরে ফেলতে চাই না । কখনই না । আর এই অনাগত প্রানটাকে কে মেরে ফেলছে ? তুমি নাকি ডাক্তাররা ?
আমি হাসলাম । আবার বললাম
-তা এবোশন করার ব্যাপার কেন আসছে ?
-আসিফ এখন বাবা হতে প্রস্তুত না ।
-আসিফ ?
তাহলে ভদ্রলোকের নাম আসিফ । আদোও সে ভদ্রলোক কি না ।
-বলেছিলে তাকে ?
-হুম ।
আমি কি বলবো আর বুঝতে পারলাম না । একটু পর বললাম
-কোথায় করাবে ঠিক করেছ ?
-অসিফ ঠিক করেছে ।
-ও । আচ্ছা তাহলে আমি যাই ?
আমি চলে যাবো এমন সময় ঈশিতা পেছন থেকে বলল
-প্রিতম ।
আমি ঘুরে দাড়ালাম ।
-হুম ।
-আমি কি ঠিক করেছি জানেন ?
-কি ?
-আমি আমার সন্তানকে মেরে ফেলবো না । ওকে আমি এই পৃথিবীকে নিয়ে আসবো ।
আমি অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম ।
কি বলছে এই মেয়ে ? মাথা ঠিক আছে তো ? কিন্তু ওর চোখদুটো কেমন জানি খুব দৃঢ় মনে হল ।
আমি আর দাড়ালাম না । আমার আর দাড়ানোর কোন মানে নাই । কেন জানি কষ্ট বুকের ভিতর কেমন একটা চিনচিন ব্যাথা করতে লাগলো
এখানে আছে গল্পটা
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ১১:০৭