পুলিশ বক্সের কাছে এসে নিশাত কে দেখতে পেলাম । ছাতি নিয়ে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে । কিন্তু বৃষ্টির যা অবস্থা খুব একটা লাভ হচ্ছে না । অর্ধেকের বেশি এরই মধ্যে ভিজে গেছে । আর একটু দাড়িয়ে থাকলে সম্পুর্ণ ভিজে যাবে । আমি রিক্সা দাড় করালাম ওর সামনে । রিক্সার ভিতর থেকেই ডাক দিলাম ওকে । আমার ডাক শুনে খানিকটা চমকালো ।
আমি বললাম রিক্সায় “উঠে আসো । ভিজে যাচ্ছ” ।
“ না ঠিক আছে” ।
“না ঠিক নেই । অর্ধেক অলরেডি ভিজে গেছ । এভাবে আরো কিছুক্ষন থাকলে পুরো ভিজে যাবে । ঠান্ডা লেগে যাবে । উঠে এস” ।
“না আমি ঠিক আছি । রিক্সা নিয়ে চলে যাবো” ।
“ আরে পাগল হয়েছে ? যে বৃষ্টি শুরু হয়েছে কোন রিক্সা যেতে চাইবে না । উঠে এস” ।
“না আমি আপনার সাথে যাবো না” ।
ও এই ব্যপার ! আমি রিক্সা থেকে নেমে এলাম । বললাম “আচ্ছা ঠিক । আমার সাথে যেতে হবে না । তুমি এই রিক্সা নিয়ে চলে যাও । ঠিক আছে ! নাকি তাও যাবা না” ।
নিশাত মনে হয় এটা আশা করে নি । আর কোন কথা না বলে রিক্সায় উঠে বসল । পলিথিন ঠিকঠাক করে নিল । তারপর কি মনে হল ওর ছাতিটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল ।
বলল “আপনি ভিজে যাচ্ছেন” ।
আমি বললাম “আমি ভিজলে সমস্যা নাই” । তবুও নিলাম ।
রিক্সা চলতে শুরু করল । আমি দাড়িয়ে আছি । নিশাতের ছাতাটা হাতে ধরা । মেলতে ইচ্ছা করছে না । কেন জানি ভিজতে ইচ্ছা করছে । হটাৎ করে মনের মধ্যে একটা অদ্ভুদ চিন্তা মাথায় এল ।
নিশাতের সাথে এমন ভাবে যদি বৃষ্টিতে ভেজা যেত ! মন্দ হত না ।
আমি নিশাতের রিক্সা করে চলে যাওয়াটা দেখছি । ঐ দিকেই তাকিয়েই আছি । আমার কেন জানি মনে হচ্ছে নিশাত রিক্সার পেছন পর্দা তুলে ও আমার দিকে তাকাবে । এক ভাবে তাকিয়েই থাকলাম । কিন্তু আমার ধারনা সত্যি হল না । নিশাত ফিরে তাকালো না । মন খানিকটা খারাপ হল ।
নিশাত মেয়েটা এমন কেন ! একবার ফিরে তাকালে কি হত ! এই মেয়েটা আসলেই এমন । প্রথম যেদিন নিশাতের সাথে দেখা হয় কি ব্যবহারটাই না করেছিল !
নিশাত আমার বাড়িয়ালার মেয়ে । প্রথম যে দিন ওর সাথে দেখা হল যে ঝাড়িটাই না আমাকে মারল । সকাল বেলা মালপত্র নিয়ে বাসায় উঠেছি । সারা দিন গোছগাছে ব্যস্ত ছিলাম । সন্ধ্যার দিকে একটু অবসর নিলাম । যদিও তখনও অনেক কাজ বাকি ছিল । মন বলছিল একটু বিরতি নিতে । আমার ফ্লাটটা ছিল ছয় তলায় । তার উপরেই ছাদ । ছতলা বেয়ে নিচে নামার চেয়ে ছাদে যাওয়া টাই শ্রেয় মনে করলাম ।
ছাদে উঠে হাওয়া খাচ্ছি এমন সময় পেছন থেকে খুব কঠিন গলায় কেউ বলে উঠল “আপনি ছাদে কেন উঠেছেন” ?
পিছনে ঘুরে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না । বিশ বাইশ বছরের একটা মেয়ে । গায়ের রং শ্যামলা । কিন্তু মুখে একটা মায়া মায়া ভাব ছিল । প্রথম দেখাতে যে কারো পছন্দ হবে । আমি ভাবতেই পারছিলাম না এই মায়া করা চেহারার মেয়েটা এতো কঠিন করে কথা বলতে পারে ।
মেয়েটা আবার বলল “আপনি কেন ছাদে উঠেছেন” ?
আমি ততক্ষনে সামলে নিয়েছি । বললাম “এমনি উঠেছি । হাওয়া খেতে বলতে পারেন” ।
“আপনি জানেন না ছাদে ওঠা নিষেদ ? বাবা আপনাকে বলে নি” ?
“কই আমি জানি না তো । আর ছাদে ওঠা নিষেদ এমন কোন সাইনবোর্ড ও লেখা নাই” ।
কোন জুটসই উত্তর না খুজে পেয়ে মেয়েটার মুখটা কেমন লাল হয়ে গেল । বলল “এখন বলছি এরপর থেকে আর ছাদে উঠবেন না । আরে কেন উঠবো না” ।
“এটা কোন কথা ? দেখেন আমি ছতলার বাপাসটা ভাড়া নিয়েছি । তারমানে ঐ ফ্লাটের সব কিছুই আমার আন্ডারে পড়ে । ছাদও পড়ে । সুতরাং আমি আসবো” ।
দেখলাম মেয়েটা মুখটা আরো লাল হয়ে গেল । ঘুরে যাওয়ার আগে বলে গেল “আপনি কিভাবে এ বাড়িতে থাকেন আমি দেখবো” ।
আমি বেশ মজা পেলাম । কি মেয়ে রে বাবা । বাসায় আসতে না আসতেই বাড়ি ছাড়ার হুমকি ! পরদিনই দেখলাম ছাদের দরজায় তালা মারা । আমার ছাদের ওঠার সমাপ্তি ঘটল । পরে খোজ নিয়ে জানলাম মেয়েটা বাড়ি য়ালীর মেয়ে । একমাত্র মেয়ে । নাম নিশাত । একটু বদমেজাজী । কি এক অজানা কারন বসত ছেলেদের একটুও দেখতে পারে না । কেন কে জানে !
বাসায় এসে গোছল সেরে ফ্রেস হয়ে নিলাম । নিশাতের ছাতাটা বারান্দায় মেলে দিলাম । ছাতা এই প্রথম খুললাম । ও যখন ছাতাটা আমাকে দিল কেন জানি খুব ভাল লাগল ।
আমি ভিজে যাচ্ছি বা ভিজে যাবো এই জন্য কি ছাতাটা ও দিল নাকি ওর জন্য রিক্সা ছেড়ে দিলাম তার প্রতিদান স্বরুপ আমাকে ছাতাটা দিল । দ্বিতীয়টা হবার সম্ভাবনাই বেশি । যাক তবুও তো মেয়েটার মাঝে কৃজ্ঞতা বোধ আছে । সে হিসাবে দেখতে গেলে মেয়েটা কিন্তু একেবারে খারাপও না । সবার সাথে ভাল ব্যবহার ই করে কেবর ছেলেদের উপরেই যত রাগ ওর । আমি এর আগেও লক্ষ্য করেছি ও ছেলেদের যথা সম্ভব এড়িয়ে চলে ।
কেন চলে ? নিশ্চই ওর জীবনে পুরুষ মানুষ নিয়ে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা রয়েছে । এবং ঘটনা ঘটেছে বেশ কচি বয়েসেই । আর তখন থেকেই ছেলে মানুষের প্রতি ওর এতো রাগ ।
সন্ধ্যার দিকে দেখলাম ছাদের দরজা খোলা । তারমানে নিশাত ছাদে উঠেছে । যাক একটু কথা বলা যাক । আজকে মনে হয় আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করবে না ।
নাকি করবে ? করতেও পারে । বিশ্বাস নাই ।
আমি আমার ছাতাটা নিয়ে ছাদে গেলাম । নিশাত ফুলের টবে পানি দিচ্ছিল । আমাকে দেখে সোজা হয়ে দাড়াল । মনে মনে আল্লাহ কে ধন্যবাদ দিলাম । যাক কিছু বলে নি ।
“ছাতা টা”।
নিশাত একবার ছাতার দিকে তাকাল । চোখে জিজ্ঞাসা । বলল “এটা তো আমার ছাতা না” ।
“হুম । তোমার না । আসলে তোমার ছাতাটা আসতে আসতে হারিয়ে ফেলেছি” ।
“হারিয়ে ফেলেছেন ? এই টুকু রাস্তা আসতে আসতে হারিয়ে ফেললেন” ?
“আসলে বাসে উঠেছিলাম তো । সিটের উপর রেখেছিলাম । নামার সময় আর নিতে মনে ছিল না” ।
নিশাত খানিক ক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে থাকল । তারপর বলল “আসলে মিথ্যা কথা বললে অনেক ভেবে চিন্তে বলতে হয় । তা না হলে ধরা পড়ে যেতে হয়” ।
“না । আমি মিথ্যা কথা কেন বলল বল” ?
“অপু সাহেব আপনি যখন রিক্সা করে বাড়ির সামনে নামলেন তখন আমি আমার ঘরের জানলার কাছে বসে ছিলাম । আর আমার ঘরের জানলা থেকে আমাদের বাড়ির গেটটা পরিস্কার দেখা যায় । কে আসল না আসল কার হাতে কি আছে কি নিয়ে বাসার ভিতর ঢুকছে সব পরিস্কার দেখা যায় । ঠিক আছে” ।
আমি বোকার মত হাসার চেষ্টা করলাম । নিশ্চই একটা ঝাড়ি মারবে এখন । কিন্তু দেখলাম ঝাড়ি মারল না ।
বলল “জানতে পারি কেন মিথ্যা কথাটা বললেন” ?
আমি আসলে কি বলব বুঝতে পারছিলাম না । বুঝতে পারি নি এভাবে ধরা খেয়ে যাবো ।
নিশাত বলল “আচ্ছা তার আগে আর একটা প্রশ্নের জবাব দিন । ভর দুপুর বেলা ঐ কাজটা কেন করলেন । ও রকম বৃষ্টির মধ্যে নেমে গিয়ে আমাকে রিক্সাটা দিয়ে দেওয়াটা কেমন যেন লাগল আমার কাছে” ।
আমি কিছুক্ষন চুপ করে থাকলাম ।
তারপর বললাম “আসলে আমি বোঝাতে চেয়েছিল জগতের সব পুরুষ মানুষ খারাপ না । তুমি যদি আমার সাথে তখন রিক্সায়ও উঠতে তোমার প্রতি কোন খারাপ আচরন করতাম না” ।
নিশাত কিছু না বলে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল । আমি বললাম “দেখ নিশাত, জগতে যেমন খারাপ মানুষ আছে ভাল মানুষও কিন্তু আছে । মানছি পুরুষ মানুষকে নিয়ে তোমার জীবনে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে তাই বলে তুমি জগতের সব পুরুষ মানুষ কে খারাপ ভাববা এটা কিন্তু ঠিক না । সবাই কে একপাত্রে ফেলাটা বোকামি” ।
নিশাত তীব্র কণ্ঠ বলল “আপনাকে কে বলল যে আমার সাথে অপ্রীতিকর কিছু হয়েছে” ?
“কেউ বলে নি ? বলার দরকার কেন হবে ? তোমার সাথে আমার যতবার কথা হয়েছে অথবা আমি তোমাকে যতবার দেখেছি ততবারই আমার জন্য তোমার চোখে আমি তীব্র ঘৃণা দেখেছি । কিন্তু আমি এমন কেন আচরন কখনও আপনার সাথে করি নি । তাহলে কেন এমন আচরন আমার সাথে ? তারমানে কি দাড়ায় বল” ?
নিশাত টবে পানি দেওয়া বন্ধ করে নিচে চলে গেল । আমি দাড়িয়ে রইলাম । কেন জানি আমার কষ্ট হতে লাগল । দুপুর বেলা যখন নিশাতের রিক্সার চলে যাওয়া দেখছছিলাম যখন দেখলাম ও একটা বারের জন্যও পিছন ফিরে তাকাল না তখনও আমার কেন জানি এই কষ্টটা হচ্ছিল । এখনও ঠিক তেমনি একটা কষ্ট হচ্ছে । কেন হচ্ছে ?
পরের অংশ