পৃথিশা আমার উপর খুব রাগ করার চেষ্টা করছে । কিন্তু পারছে না । আমার দিকে না তাকিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে ।
পৃথিশার এই আচরনটা আমার কাছে খুব পরিচিত । ও যখন কারো উপর রাগ করতে চায় কিন্তু রাগটা বেশিক্ষন ধরে রাখতে পারে না । তখন ওর চোখে পানি চলে আসে । আর পানি টা আটকানোর ও আপ্রান চেষ্টা করে ।
আমি জানি কিছুক্ষনের মধ্যেই ওর চোখ থেকে পানি পরতে আরাম্ভ করবে । আমি ঐ সময়টার জন্য অপেক্ষা করি । আমার মনে হয় পৃথিবীতে আমিই একমাত্র প্রেমিক যে তার ভালবাসার মানুষটির চোখের জল দেখতে ভালবাসে । তার মানে এই না যে আমি ওকে কষ্ট দিতে ভালবাসি !
আসলে ওর চোখ দুটো দিয়ে যখন জল গড়িয়ে পরে ওকে ঘিরে যেন অভাবনীও এক দৃশ্যের সৃষ্টি হয় । আমার কাছে মনে হয় ……... আসলে কি যে মনে হয় আমি সেটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না ।
আমি কেবল তখন ওর দিকে মন্ত্র মুগ্ধের মত তাকিয়ে থাকি ।
“কি ব্যপার অন্য দিকে তাকিয়ে কথা বলছ কেন ? আমাকে দরকার নাই ভাল কথা তাই বলে আমার দিকে তাকিয়েও কি কথা বলা যাবে না এটা কেমন কথা” ? পৃথিশা আমার দিকে তাকাল । ওর চোখ দিয়ে ততক্ষনে অশ্রু পরতে শুরু করেছে । আমি কিছুক্ষনের জন্য অন্য জগতে হারিয়ে যাই । সম্মোহনের মত ওর দিকে তাকিয়ে থাকি ।
“আমার চোখের জল দেখতে অনেক মজা লাগে , না” ? ওর কথায় সম্মোহন ভাঙ্গে ।
“কি বললে” ?
“এখন আমার কথা তুমি ঠিক মত শুনছো ও না । শুনবে কেন” ? ওর গলায় এখন রাগের কোন চিহ্নও নাই । সেখানে জমা হয়েছে একরাশ অভিমান । পৃথিশা আবার বলল “কেন শুনবে ! আমি কে তোমার ! আমি একটা খোড়া মেয়ে । আমাকে কি কেউ ভালবাসে” ?
আমি ওর কথার উত্তর দিলাম না । এখন এ নিয়ে কথা বললেই ও আরো হাজারটা অভিযোগ করবে । আমি ওর কাছে গিয়ে বললাম “রাত বাড়ছে । ঘুমাও এখন” ।
“আমি কেন তোমার কথা আমি কেন শুনবো ? আমার যখন ইচ্ছা আমি ঘুমাবো” ।
“আচ্ছা আমার কথা শুনতে হবে না । তোমাকে বিছানায় তুলে দেই” !
“আমি বলেছি না তোমার সাহায্যের আমার দরকার নাই” । এই বলে পৃথিশা হুয়িল চেয়ারটা নিজেই বিছানার কাছে নিয়ে গেল । ওর সচল পা টা দিয়ে একটু ভর দিয়ে দাড়াল । একটা হাত হুয়িল চেয়ারের হাতলে রেখে চাপ দিয়ে অচল পা টাকে তুলতে চাইল । তখনই বিপত্তি ঘটল । হুয়িল চেয়ারটাতো আর স্থির না । সচল । ওর চাপ পেয়ে সরে গেল । পৃথিশা ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলল । আমি প্রস্তুত ই ছিলাম । ওকে ধরে ফেললাম ।
প্রথমে ও নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করল । কিন্তু আমি ওকে ছেড়ে দিলাম না ।
ওকে বললাম “পৃথু তুমি আমাকে যত যাই কিছু বল না কেন আমি কখনই তোমাকে ছেড়ে যাবো না । যদি আমাকে দুর দুর করে তাড়িয়েও দাও তবুও আমি তোমার পিছে আসবোই” ।
এবার ওকে খানিকটা শান্ত হতে দেখলাম । বললাম “আমার হাতটা ভাল করে ধরো” ।
পৃথিশা আমার হাতটা ধরল । ধরার সময় ওর হাতটা যেন একটু কেঁপে উঠল । ও যতবার আমার হাত ধরতে যায় ততবারই দেখি ওর হাতটা কেমন যেন কেঁপে ওঠে ।
হাত ধরে ওকে বিছানায় বসালাম । তারপর ওর পা টাকে বিছানায় তুলে দিলাম । বালিশ ঠিক করে ওকে শুইয়ে দিলাম । বললাম “এখন চোখ বন্ধ করে ঘুমাও , ঠিক আছে ! সকালবেলা তোমাকে বেড়াতে নিয়ে যাবো । লক্ষি মেয়ের মত ঘুমাও । আর কোন কিছু দরকার হলে আমাকে ডাক দিও । আমি তোমার পাশের রুমেই আছি । গুড নাইট” ।
পৃথিশাও গুড নাইট বলল । আমি লাইট বন্ধ করে নিজের রুমে চলে এলাম ।
পৃথিশার সব কাজ করার জন্য আলাদা আলাদা লোক আছে । কিন্তু ওর এই কাজ গুলো আমার নিজেই করতে ভাল লাগে । খুব বেশি ভাল লাগে । আর লাগবেই না কেন সেই ছোট বেলা থেকেই পৃথু আর ওর বাবা ছাড়া আমার আপন বলে আর কেউ ছিল না ।
আমি যে একটা এতিম ছেলে তা আমি এই দুইজনের মাঝে কোন দিন অনুভুব করি নি । পৃথুর বাবা আমাকে একটা এতিম খানা থেকে তুলে এনেছিল । পৃথু একজন খেলার সঙ্গী দরকার ছিল । ছোট বেলা থেকে পৃথিশার বাম পায়ে সমস্যা । বাম পায়ে হাটুর নীচ টার উপর ওর নিয়ন্ত্রন নেই । তাই ও স্বাভাবিক বাচ্চা দের সাথে খেলাধুলা করতে পারতো না । ওর সর্বক্ষনিক খেলার সঙ্গী হিসাবেই আমাকে ওর বাবা আমাকে নিয়ে এসেছিল । তারপর থেকেই ওর সাথে ছায়ার মত আমি ছিলাম । সব জায়গায় ।
আজ এতোটা বছর আমি সব সময় ওর সাথে আছি । আসতে আসতে কথন যে ওকে ভালবাসতে শুরু করেছি আমি নিজেই জানি না । পৃথুর বাবাও ব্যাপারটা ধরতে পেরেছিল মনে হয় । উনি যেদিন মারা যায় সেদিন আমাকে ডেকে বলে “বাবা তুই কোন দিন পৃথুকে ছেড়ে যাস না । তুই ছাড়া আর ওর আপন বলে কেউ নাই । ওকে দেখে রাখিস” ।
তাহলে আমি ওকে একা কিভাবে রাখি ? কিন্তু পৃথিশা আমাকে ভুল বুঝে বসে আসে । যখন আমরা হাইস্কুলে পড়ি পৃথু আমাকে ভালবাসার একটা ইঙ্গিত দিয়েছিল । মুখ ফুটে কিছু বলে নি অবশ্য । কিন্তু স্পষ্টই বুঝিয়ে দিয়েছিল যে ও আমাকে ভালবাসে । কিন্তু আমি কোন উত্তর দিয়ে ছিলাম না ।
সত্যি কথা বলতে আমি কোন উত্তর দিতে পারি নি । যদিও পৃথুর বাবা কোন দিন আমাকে আলাদা করে দেখেন নি কিন্তু আমি তো আমার সীমাবদ্ধতা জানি । আমি ওদের দয়ার উপর বেঁচে ছিলাম । কিভাবে ওকে ভালবাসার মত দুষ্সাহস করতে পারি !
কিন্তু পৃথিশা ভেবে বসল যে ওর ডিজএবিলিটির জন্য হয়তো আমি ওর ভালবাসা গ্রহন করি নি । কিন্তু সেটা মোটেই ঠিক না । তারপর আসতে আসতে আমি টের পাওয়া শুরু করলাম এই মেয়েটার জন্য আমার অসম্ভব একটা মায়া রয়েছে । ওকে ছেড়ে একটা মুহুর্তও আমার ভাল লাগতো না । সারাটা ক্ষন কেবল ওর আসে পাশে থাকতে ইচ্ছা করত । কিন্তু ঐ একই কারনে আমার মনের কথাটা আমি পৃথিশা কে বলতে পারি নি ।
শুতে যাবো এমন সময় মোবাইল টা বেজে উঠল । স্ক্রিনে দেখি পৃথিশার নাম্বার ।
“কি হল” ?
“ঘুম আসছে না” ।
কি আর করা আবার ওর রুমে গেলাম । লাইট অন করে দেখি ও আগে থেকেই উঠে বসেছে । ওর পাশে গিয়ে বসি ।
আবার বলি “কি হয়েছে” ?
“জানি না । ঘুম আসছে না” ।
“ঘুম আসছে না কেন” ?
“আমি কিভাবে বলব কেন ঘুম আসছে না কেন” ?
আমি বললাম “এখন যদি তুমি লক্ষি মেয়ের মত ঘুমুতে যাও তবে কাল সকালে তোমাকে বেড়াতে নিয়ে যাবো” ।
“ আমি বেড়াতে যাবো না” ।
আমি অবাক হলাম । বললাম “কেন সকাল বেলা যখন তোমাকে নিয়ে হাটি তোমার ভাল লাগে না” ?
“হাটো আর কোথায় ? একটা বোঝাকে ঠেলে ঠেলে নিয়ে যাও” ।
“কি বললে তুমি ? বোঝা” ?
কথাটা আমাকে খুব আহত করে ।
“আমি বোঝাইতো” । আমি কিছুক্ষন চুপ করে থাকি ।
তারপর বলি “পৃথু আচ্ছা তোমার কি কখনও মনে হয়েছে যে আমি তোমার সাথে বাধ্য হয়ে থাকি কিংবা ঠ্যাকায় পড়ে থাকি ? অথবা আমি তোমার কাজ গুলো করি লোক দেখানোর জন্য ? তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া আমার কাছে বিরক্তির কাজ ? মনে হয়েছে এমনটা” ?
পৃথিশা মাথা নিচ করল । মাথা ঝাকাল । “না । কথনও মনে হয় নি” ।
“তাহলে এই কথাটা কেন বললা ? আমি খুব কষ্ট পেলাম” ।
“শোন প্লিজ যেও না । আমি ঐ মিন করে বল নি । বিশ্বাস কর” । ও আমার হাত চেপে ধরল । “প্লিজ যেও না” ।
“আমি যাচ্ছি না । তোমাকে আমি বলি নি যে যত যাই হোক আমি তোমাকে ছেড়ে কখনও যাবো না” । ও একটু হাসল ।
আমি আবার বললাম “তবে ঐ রকম কথা তুমি আর কোন দিন বলবা না । ঠিক আছে” ?
“আচ্ছা বাবা ঠিক আছে” ।
ওর ধরে থাকা হাতটার উপর আমার অপর হাতটা রাখলাম । বললাম “তুমি কখনও আমার কাছে বোঝা নও । কখনও না” ।
আমার এই কথাটা শুনে পৃথিশা খুব খুশি হল । ওর চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল । কিছুক্ষন আমার দিকে একভাবেই তাকিয়ে থাকল ।
আমি বললাম “এবার ঘুমাও । রাত জাগলে শরীর খারাপ করবে” ।
ও মাথা নাড়াল । “উহু । ঘুমাবো না” ।
“তাহলে এই রাত দুপুরে কি করবা” ?
“ছাদে যাবো” ।
“এই সময়” ?
“হুম” ।
“ছাদে কিন্তু ভুত আছে” ।
“থাকুক । তুমি তুমি আছো না সাথে ! ভয় পাই না” ।
আমি হাসলাম । বললাম “আচ্ছা চল” ।
আমি ওর জন্য হুইল চেয়ারটা ঠিক করতে যাই ।
পৃথিশা বলল “হুইল চেয়ারে উঠব না” ।
“কেন ? ছাদে যাবে” না ?
“যাবো তবে ওটাতে উঠবো না” ।
“তাহলে কিভাবে যাবে” ?
পৃথিশা আদুরে গলায় বলল “তোমার কোলে চড়ে যাবো” ।
আমি হেসে ফেললাম । “তুমি একটা পাগল” ।
এর আগেও ওকে বেশ কয়েক বার কোলে নিয়েছি । প্রথম ওকে কোলে নিয়েছিলাম কলেজে পড়ার সময় । প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা ছিল পাচ তলায় । কি কারনে সেদিন কলেজের লিফট চলছিল না । লিফটের কাছে এসে পৃথিশা অসহায় ভঙ্গিতে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল ।
এক সময় বলল “অপু আমি পরীক্ষা দেবো না” ।
আমি বললাম “পরীক্ষা দেবে না মানে” ?
দুজন বন্ধুকে বললাম হুইল চেয়ারটা পাঁচ তলায় নিয়ে যেতে । তারপর ওকে কোলে তুলে নিলাম ।
সিড়ি দিয়ে ওঠার সময় সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল । একটু লজ্জা লজ্জা লাগছিল । কিন্তু ভালও লাগছিল খুব । পৃথিশা লজ্জায় একে বারে লাল হয়ে গেছিল ।
কিন্তু ওর মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল লজ্জা পেলেও ও খুশি হয়েছে অনেক ।
“কই নিবা না” ? ওকে কোলে তুলে নিলাম ।
ছাদে যাবা সময় বললাম “যদি এখন কেউ দেখে ফেলে কি ভাববে বলতো” ?
“যে যা ভাবে ভাবুক । কিচ্ছু যায় আসে না তাতে । আমার কাছে ইম্পর্টেন্ট কেবল তুমি কি ভাবো” ?
আমি হাসলাম ।
ছাদে গিয়ে বসলাম দুজন । আকাশে বেশ বড় একটা চাঁদ । চারিদিকে আলো থৈ থৈ করছে । বেশ ফুরফুরে বাতাশ দিচ্ছে ।
পৃথিশা আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল । বলল “আজকে আমি এখানে ঘুমাবো । একটা গল্প বল” ।
“গল্প ? এই বুড়ি বয়সে গল্প শুনে ঘুমাবে” ।
পৃথিশা আরো একটু আদুরে গলায় বলল “বল না প্লিজ” ।
“আচ্ছা শোন । গল্পটা একটা সামান্য প্রজা আর এক রাজকুমারীর গল্প । একদেশে এক রাজা ছিল তার একটা পরীর মত মেয়ে ছিল । কিন্তু সেই রাজ কুমারীর একটা অসুখ ছিল” ।
“কি অসুখ” ?
“কি অসুখ ছিল সেটা ইম্পর্টেন্ট না ।অসুখ ছিল । তাই তার সাথে কেউ খেলতে চাইতো না । এই জন্য রাজকুমারীর মনে অনেক দুঃখ ছিল । তাই দেখে রাজা একদিন একটা এতিম ছেলেকে নিয়ে এল রাজকুমারীর খেলার সঙ্গী হিসাবে । তারপর ...”
পৃথিশা বলল “আমি এই গল্প শুনবো না” ।
“কেন” ?
“আমি এ গল্প জানি” ।
“কিন্তু আমিতো আর কোন গল্প জানি না । থাক আর গল্প বলতে হবে না । তুমি আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও । আমি একটু ঘুমাই” ।
আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকি । পৃথিশা ঘুমিয়ে গেল কিছুক্ষনের মধ্যেই ।
আমি অতি সাবধানে ওর কপালে একটা চুম খেলাম ।
তারপর ফিসফিস করে বললাম “আমার রাজকুমারী, এই ক্ষুদ্র প্রজা তোমাকে সারা জীবন আগলে রাগবে । সারা জীবন তোমাকে ভালবাসবে । আমি থাকতে তোমার কোন কিছুর জন্য চিন্তা করতে হবে না” ।
আমি ওর ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকি । এক রাশ চাঁদের আলো পড়ছে ওর মুখটার উপর । কি পবিত্র আর কোমলই না লাগছে ওকে দেখতে !
আমি তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে । মনে হল এমন ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে সারাটা জীবন পার করে দিতে পারবো !!
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০১২ দুপুর ১২:০২