আমাদেয় বাড়ির গেটটা সব সময় বন্ধ থাকে । দারয়ান থাকলে তো কথা নাই । কিন্তু যখন দারয়ান থাকে না তখন বাড়ির লোকজন বেশ বিপদেই পরে । আমিও বিপদে পড়তাম । কিন্তু এখন আর পড়ি না ।
দুপুরের দিকে দারয়ান সাধারন থাকে না । সেদিনও ছিল না । ভাগ্যিস ছিল না । ছিল না বলেই আজ রাশিনের সাথে দেখা হল । রাশিন আমার পাশের ফ্লাটে থাকে । অল্প কথায় বলতে গেলে রাশিন দেখতে ভয়াভহ রকমের সুন্দর । আর সুন্দর বলেই সব সময় খুব মুডে থাকে । মুডে থাকে বলতে সবসময় মুখে একটা বিরক্তির ছাপ । যেন সব কিছুর উপর , সবার উপর সে বিরক্ত । আমি আজ পর্যন্ত রাশিন কে হাসতে দেখি নি । জানি না দেখবো কিনা ।
ক্যাম্পাস থেকে ফিরেছিলাম । বাড়ির সামনে এসে দেখি রাশিন দাড়িয়ে আছে গেটের সামনে । এজইউজাল বিরক্ত মুখে । পাশে এক রিক্সা ওয়ালা তার রিক্সা নিয়ে অপেক্ষা করছে । তবে রাশিন কে আজ অন্য দিনের থেকে যেন বেশি বিরক্ত লাগছে । বারবার কলিংবেল চাপছিল । আমি চুপচাপ দাড়িয়ে আছি একটু দুরে ।
“আফামনি আমার ভাড়াটা দিয়া দেন । চইলা যাই” ।
“আরে আশ্চর্য ভাড়া দেব কোথ্থেকে ? আপনাকে বলিনি আমার ব্যাগ ছিনতাই হয়ে গেছে । বাসা থেকে টাকা দিতে হবে” ।
“কিন্তুক গেট তো কেউ খুলে না । সারা দিন কি বইসা থাকবার পারি” ।
“বসে থাকেন । আপনার ভাড়া আপনি পেয়ে যাবেন” । রাশিন এবার আমার দিকে তাকাল । বলল “আমি অনেকক্ষন ধরে বেল বাজাচ্ছি । কেউ আসছে না । আপনি কি একটু দেখবেন আপনার বাসা থেকে কেউ আসে কি না” !
“মনে হয় কারেন্ট নাই” ।
“তাহলে” ? রাশিনকে আবার অস্থির মনে হল ।
“আর একটা উপায় কি আছে” ? আমি বলি ।
“ কি “?
“আপনি একটু সরে আসেন আমার কাছে চাবি আছে” ।
“আপনার কাছে চাবি আছে” ? রাশিন কে আমার উপর বিরক্ত মনে হল । “চাবি ছিল তো এতোক্ষন দাড়িয়ে ছিলেন কেন ? প্রথমে ফলা যেত না” ?
“আসলে আমি সুযোগই পাই নি । আপনি যেভাবে বিরক্ত মুখে কলিংবেল টিপ ছিলেন বলতে সাহস হয় নি” ।
আমার কথা মনে হল রাশিনের পছন্দ হল না । বলল “ঠিক আছে দরজা খুলুন” । খানিকটা হুকুমের মত শোনাল ।
আচ্ছা এখন যদি গেট না খুলি । একবার মনে হল বলি যে আমার চাবি আমি খুলব না । কিন্তু বলা হল না । গেট খুলে দিলাম । রাশিন ভিতরে চলে গেল ।
আমি রিক্সা ওয়ালাকে ভাড়া দিয়ে দিলাম । সিড়ি ঠেলে উপরে উঠল । দেখলাম রাশিন এখানেও ওদের ঘরের গেটের সামনে দাড়িয়ে বেল টিপছে । বিরক্ত মুখে ।
রাশিন আমাদের পাশের ফ্লাটেই থাকে । আমি দরজা খুলতে খুলতে ওর দিকে তাকালাম । দেখলাম রাশিন আমার দিকে কেমন বিরক্ত চোখে তাকিয়ে আছে । আমি তাড়াতাড়ি বললাম “দেখুন আপনার ঘরের চাবি কিন্তু আমার কাছে নাই । আগে থেকে বলে দিলাম” ।
রাশিন মনে ঠাট্টাটা পছন্দ করল না । সুন্দরীরা খুব একটা ঠাট্টা পছন্দ করে না । কিছু বলার আগেই আমি ঘরে ঢুকে পড়লাম । কিছুক্ষন পর দরজায় কড়া নড়ল । দরজা খুলে দেখি রাশিন ।
আমার দিকে ৫০ টাকা বাড়িয়ে দিয়ে বলল “আপনি রিক্সা ভাড়াটা দিয়েছেন । এই নিন” । আমি খানিকটা অবাক হলাম । ভান করলাম আর কি । বললাম “কই না তো । আমি দেইনি” ।
“দেখুন আমি জানি ভাড়াটা আপনিই দিয়েছেন । নিন । আমি কারো কাছে ঋনি থাকতে পছন্দ করি না” ।
আমি টাকা টা নিলাম । রাশিন ঘুরে যাচ্ছিল এমন সময় আমি ডাকলাম ওকে ।
“শুনুন” ।
রাশিন ঘুরে দাড়াল । “বলেন” !
“আপনি মানুষের কাছে ঋনি থাকেন না” ?
“না” ।
“তারমানে কেউ আপনাকে কিছু দিলে তা আপনি ফেরত্ দিয়ে দেন” ?
“জি” ।
“কিন্তু আমাকে তো দেন নি” ।
“মানে ? আপনি আমাকে কি দিয়েছেন যা আমি ফেরত্ দেই নি” ?
“কিছুতো একটা অবশ্যই আমি আপনাকে দিয়েছি । তা না হলে আমি এমনি এমনি বলতাম না” ।
রাশিনকে আবার বিরক্ত মনে হল । “দেখুন আমি হেয়ালি পছন্দ করি না । কি দিয়েছেন বলেন” ।
“ দেখুন রিক্সা ভাড়াটা যে আমি দিয়েছি তা আমি কিন্তু আপনাকে বলি নি । বলেছি বলেন ? তারপরও কিন্তু ভাড়াটা দিয়ে গেলেন” ।
রাশিন কিছু বলল না । ঘরের ভিতর চলে গেল ।
ঘরের ভিতর এসে মনে হল এমন কথা কেন বললাম ?
ও কি কিছু বুঝতে পেরেছে ?
নাকি বুঝবে ?
জানি না ।
বুঝলে বুঝবে ।
কত দিন আর চুপ করে থাকবো । এটা দিয়েই না হয় এক ধাপ এগিয়ে যাবো । আমার মনে ক্ষন আশা ছিল হয়তো রাশিনের মনে আমি কৌতুহল ঢোকাতে সক্ষম হয়েছি । এবার যখন দেখা হবে ও নিশ্চই আমার সাথে কথা বলবে । একবার হলেও জানতে চাইবে আমি আসলে ওকে কি দিয়ে ছিলাম । কিন্তু সেরকম কিছুই হল না ।
পরদিন যখন দেখা হল ওর চোখ মুখে সেই চিরো চেনা বিরক্তির ছাপ । আমাকে দেখে এমন একটা ভাব করল যেন আমাকে চিনেই না । খানিকটা খারাপই লাগল । একটু চেষ্টা করেছিলাম । কাজ হল না ।
নিজের মন কে বোঝালাম এ মেয়ে তোমার জন্য না । অন্য দিকে হাটো । কিন্তু মন থেকে সাপোর্ট পেলাম না ।
থাক না হয় । হয়তো কোন রাশিনকে কাছে পাওয়া হবে না । না হোক । চোখের সামনে সে আছে । এভাবেই দিন চলে যাচ্ছিল । তারপর আবার একদিন রাশিনের সাথে কথা বলার সুযোগ এল ।
রাতের বেলা । সেদিন রাতের বেলা কারেন্ট চলে গেছিল । গরম কাল । কারেন্ট গেলে ঘরে টেকা দায় । তাই ছাদে এসেছিলাম হাওয়া খেতে । কিন্তু হাওয়া খেতে এসে যে হাওয়া টাইট হয়ে যাবে বুঝতে পারি নি । যখনই ছাদে পা দিলাম ছাদের একেবারে কোনায় একটা .... । এই বিজ্ঞানের যুগে বলতে লজ্জা লাগছে । কিন্তু নিজের চোখ কে কিভাবে অবিশ্বাস করি । সাদা পোশাক পরে দাড়িয়ে আছে । আমি ভয়ে কাঠ হয়ে গেলাম । ঘুরে পিছনে যাবো তারও পারছি না । পা টা যেন ছাদের সাথে লেগে গেছে । কি করবো ভাবছি এমন সময় লক্ষ্য করলাম সাদা আয়োবয়টা এদিকে এগিয়ে আসতেছে । আকাশে চাঁদ নেই । চারিদিকে আলোর ছিটে ফোটা নাই । তবুও বোঝা যাচ্ছে ওটা এদিকেই এগিয়ে আসছে । আর একটু এগিয়ে আসলে বুঝতে পারলাম আয়বয়টা একটা মেয়ের ।
তারমানে পেত্নী !চিৎকার করতে যাবো এমন সময় পেত্নীটা বলে উঠল “ভয় পেয়েছেন” ?
চিৎকার গলাতেই আটকে গেল । এটা তো পেত্নী না । রাশিনের গলা ।
‘’না’’ ! কোন মতে বললাম ।
‘’ভয় পায় নি” ? কিন্তু নিজের আওয়াজটা নিজের কাছেই অদ্ভুদ শোনাল ।
রাশিন খিল খিল করে হেসে উঠল । ওর হাসির শব্দে রাতেই নিরবতা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল । আশ্চর্য এই গম্ভীর মেয়েটা কে এর আগে কোন দিন এভাবে হাসতে দেখিনি ।
“ভয় পান নি’’ ? কোন মতে হাসতে হাসতে বলল ।
“আসলে সত্যিই ভয় পেয়েছিলাম’’ । এবার স্বীকার করেই ফেললাম । “এভাবে আপনাকে এখানে আশা করি নি । তার উপর আবার এতো রাতে” ।
রাশিন বলল “ঘুম আসছিল না । তাই এখানে এসেছি । রাতেই এই নিরবতা আমার অনেক ভাল লাগে । তাছাড়া আমার মনটা খানিকটা অস্থির” ।
“কেন অস্থির ?
“একটা গাধার জন্য অস্থির” ।
গাধা মানে ! নিজের কাছেই প্রশ্ন করলাম । গাধা মানে নিশ্চই কোন ছেলে । কোন ছেলের জন্য রাশিনের মন অস্থির । কেন জানি মনটা খারাপ হল । মনে হল ঐ গাধা যদি আমি হতাম ! যদি আমার জন্য ওর মনটা অস্থির হত !
‘অপু সাহেব ! রাশিন হঠাৎ বলল ।
“বলুন” ।
“আপনার কি মনে আছে আমি আপনাকে একটা কথা বলেছিলাম” ?
“কি কথা” ?
“বলেছিলাম না আমি কারো কাছে ঋণি থাকি না” !
“হুম বলেছিলেন” ।
“কিন্তু আমি কয়েকদিন থেকে একজনের কাছে ঋণি” ।
“কার কাছে” ?
রাশিন কিছুটা সময় নিল । তারপর বলল “আপনার কাছে” ।
আমি কথা হারিয়ে ফেললাম । তারমানে ওর মনে আছে ! আশ্চর্য ।
“আপনার মনে আছে” ?
“হুম আছে” ।
“আপনি বুঝতে পেরেছেন’’?
“অপু আমি এতোটা স্টুপিড না” !
“সো” ?
“সো হোয়াট” ?
“ঋণমুক্ত হবেন না” ?
রাশিন আবার হেসে ফেলল । বলল “আপনি কি চান আমি ঋণ মুক্ত হই” ?
আমি কিছু বলতে পারি না ।
ও হাসতে হাসতে বলল “ আপনি আমাকে যা দেয়েছেন ঐ টা তো দিতে পারছি না । টবে ঐ রকম ই এক টা জিনিস দিলে চলবে” ? আমি কি বলব সত্যি ই বুঝতে পারছিলাম না ।
রাশিন বলল “অপু আপনার প্রোপজ করার ধরনটা আমার ভাল লেগেছে । তবে আমি খুব রগচটা টাইপের মেয়ে । এই জন্য মানুষের সাথে আমার ঠিক বনে না ঠিকমত । আপনাকে কিন্তু অনেক কিছু সহ্য করতে হবে” ?
……………………