বারবার মনে হল মেয়েটায় মনে এতো কিসের কষ্ট ? তারপরের সারাটা রাত আমি কেবল এই ভেবে কেটে গেল যে মেয়েটার মনে এতো কিসের কষ্ট ?
পরদিন আমি আবার গেলাম ঐ বাড়িটার সামনে । কিন্তু মেয়েটা বের হল না । পরের দিনও না ।
কিন্তু পরদিন এক পুলিশ কনেস্টেবল বের হল । আমার দিকে তাকিয়ে বলল “কি ভাই সাহেব এদিক ওদিক তাকান ক্যান” ?
“তা কিছু না । আপা মনি আমাকে বলছে আপনাকে চলে যেতে । আর যদি আপনাকে এখানে দেখি তাহলে ঘেডিঘুডি একদম ভাঙ্গাইয়া দিবো” ।
আমি ভয় পেলাম । বেশ ভয় পেলাম । পুলিশের ভয় সবাই পায় আর আমি তো গাও গ্রামের ছেলে । ভয়তো পাবোই । ওখান থেকে চলে এলাম । আর যাই নি ।
আর কাল মোবারক সাহেবের ঐ কাগজ আর আজ আমি এখানে ।
একটু একটু ভয় ভয় করছিল এখানে বসে থাকতে । চারিপাশে সব কেমন হাইফাই লোক জন । আর আমি এখানে কোন গ্রামের গ্যাল । নিজেকে কেমন জানি বেমানান লাগছে ।
পপকর্ন চিবাচ্ছি আর চারিপাশের মানুশ জন দেখছি এমন সময় মেয়েটা কাচের দরজা ঠেলে ভিতর ঢুকল । সরাসরি আমার দিকেই এগিয়ে এসে বসল আমার আমার সামনে । ওর সব কিছুই যেন চেনা ।
“কিছু অর্ডার দেন নি” ? আমি হাসলাম ।
“আপনার জন্য ওয়েট করছিলাম” । তারপর ও অর্ডার দিল । খেতে খেতেই আমরা কথা বলছিলাম । হালকা কিছু কথা বলার পর মেয়েটা খানিকক্ষন চুপ করলো । আমি বুঝলাম ও খানিকটা প্রস্তুতি নিচ্ছে ওর কথা বলার জন্য ।
"খুব অবাক হয়েছেন না" ?
আমি হাসলাম । সত্যি খুব অবাক হয়েছি ।
"আপনাকে আজ কেন ডেকেছি জানেন ! আমার কিছু কথা বলার জন্য । জানি না আপনাকে কেন বলছি । তবা আমার মনে হচ্ছে আপনাকে বল্লে হয়তো আপনি বুঝবেন ।
আমি কোন কথা বলি না । মেয়েটা আরো কিছুটা সময় নেয় ।
তারপর শুরু করে ।
“জানেন আমার বাবা আমার বাবা আমার মাকে খুব ভালবাসতেন । আমি যখন জন্মাই তখন আমার মার শরীরে অনেক কমপ্লিকেশন দেখা দেয় । আমাকে জন্ম দিতে গিয়ে আমার মা মারা যান ...... । বাবা আম্মুকে অনেক ভালবাসতেন তো তাই মার মৃত্যটা তিনি সহজ ভাবে মেনে নিতে পারেন নি । আমাকে জন্মদিতে গিয়ে আম্মু মারা গেছে তো তাই বাবা মনে করতেন আমি আম্মুর মৃত্যুর জন্য দায়ী” ।
“আরে এটা কেমন লজিক হল” ? আমি মুখ ফসকে বলে ফেললাম ।
মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওর চোখের পানি টলমল করছে । আমি বললাম “জন্ম মৃত্যু তো আল্লাহর হাতে । এতে আপনার দোষ কোথায়” ?
“না বাবাকে দোষ দিই কিভাবে বলুন ? বেঁচে থাকার জন্য মানুষের ভালবাসার দরকার । আমাকে ঘৃনা করে উনি বেঁচে আছেন” । মেয়েটা কিছুক্ষন সময় নিলো ।
“আমি যখন ছোট ছিলাম তখন না আমি ঠিক বুঝতাম না । বাবা কেন আমার সাথে এমন আচরন করছে । আমার আরো এক ভাই এক বোন আছে । তাদের কে উনি কি আদরই না করতো । আমি বুঝতাম না কেন আমার সাথে বাবা এমন করে । একটু বড় হলে আমি একটু একটু বুঝতে শিখি । একদিন বাবার ডায়রি পড়ে সব কিছু জানি । কিন্তু বাবা আম্মুকে এতো ভালবাসেন এটা জেনে বাবার উপর আমার কোন রাগ নেই” । মেয়েটা আবার চুপ করল ।
আসলেই মেয়েটার মনে কত কষ্ট । কত অভাগা মেয়েটা । জন্ম হতেই মাকে হারিয়েছে । আর বাবার আদরও পাইনি । এটা সহ্য করা এক জনের জন্য কতটা কষ্টের হতে পারে !
“আপনাকে একটা কথা জিঞ্জেস করি” ?
আমি বললাম “বলেন” ।
“আপনি সেদিনের আগে কোন দিন আমাকে দেখেন নি । তাহলে আপনি কিভাবে বললেন আমার কথাটা” ?
“আমি জানি না । আপনি সে দিন যখন হাসলেন আপনার হাসিতে কেমন জানি একটা বিসন্নতা ছিল । আপনার চোখে কিসের যেন একটা কষ্ট ছিল” ।
মেয়েটা আবার হাসলো । “এতো দিনে এই জিনিসটা কেউ বুঝতে পারি নি । আমার কত শত পরিচিত বন্ধুবান্ধব । কেউ না । আপনি একজন অপরিচিত হয়ে কিভাবে বুঝলেন” ?
আমি কিছু বলতে পারলাম না । কেবল হাসলাম ।
“জানেন আমি প্রথমে ভেবেছিলাম আপনার সাথে আর দেখা করবো না । যে মানুষের ভিতরটা চট করে ধরে ফেলে তার কাছ থেকে দুরে থাকাই ভাল । তাই সেদিন হামিদ কে পাঠিয়েছিলাম । আপনাকে চলে যেতে বলার জন্য” ।
আমি হাসলাম ।
“হামিদ কি বেশি কিছু বলেছে” ।
“না না বেশি কিছু বলেনি” ।
“কিন্তু তারপর মনে হল না আপনার সাথে শেয়ার করা যায় । তাই মোবারক সাহেবকে পাঠালাম । আপনি বলেছিলেন আপনি কাজীর গলিতে টিউশনীতে আসেন । তাই উনি ওখানে আপনার জন্য ওয়েট করতেন । তারপর আপনাকে পাওয়া গেল । আচ্ছা আপনার নামটা আমি এখনও জানি না” ।
আমি আমার নাম বললাম ।
“অপু” ! নামটা ও উচ্চারন করলো । বলল “সুন্দর নাম । আমি ঈশিতা” ।
কিছুক্ষন চুপ করে থেকে ঈশিতা বলল “অপু সাহেব মেইনলি আপনাকে এই কথা গুলো বলার জন্য আমি এখানে ডেকেছি । আমি সারাটা জীবন বড় একা একা ভালবাসা শুন্য একটা পৃথিবীতে বড় হয়েছি । বাবা যেমন আমাকে ঘৃণা করতো আমার বড় দুই ভাই বোনও ব্যাপারটা বুঝে গিয়েছিল । তাই তারাও আমাকে খানিকটা ইগনোর করতো । একটু বড় হয়ে অনেক ফ্রেন্ডস আমি পেয়েছি কিন্তু আমাকে বোঝার মত কাউকে পাইনি । নিজের কথা বলার মত কাউকে না । আপনি চট করে সেদিন আমাকে ধরে ফেললেন এমনটা কেউ পারে নি । আপনার কাছে বলতে পেরে ভাল লাগল । আমি আরো কথা বলতে চাই । আমি জানি আপনি বুঝবেন । আপনি কি শুনবেন আমার কথা গুলো” ?
মেয়ে্টার এই আবেদন টা আমার মন টা খারাপ করে দিল ।
আমি যখনই মিন্টু রোডের বাড়ি গুলোর দিকে তাকাতাম মনে হত আহা কত সুখেই না আছে যারা এই বাড়িগুলোতে থাকে ।
কিন্তু হায় । সুখ কি এতোই সহজ ! সব কিছুর পরিপুর্ণতা থাকা সত্তেও এই মেয়েটা কত অসুখী ! কত টা বিষন্ন ! কতটা ভালবাসা শুণ্য জীবন কাটাচ্ছে । ঈশিতার জন্য সত্যি আমার খুব খারাপ লাগতে লাগলো ।
(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুন, ২০১২ সকাল ১১:৪২