"আগামী কাল বিকাল সাড়ে চারটার সময় বেইলীরোডের AL-BAIK এ আসবে । বামদিকের কোনার টেবিলে বসবে "
ব্যস এইটুকুই । আর কোন কথা নাই । গতকাল মোবারক সাহের যখন আমাকে কাগজটা দিল আমি সত্যিই খুব অবাক হয়েছিলাম । আমার বিশ্ময় এখনও কাটেনি । আমি কথনও ভাবি নি সে আমার সাথে এমন নাটকীয় ভাবে দেখা করতে চাইবে ।
আর সব থেকে অবাক করার বিষয় হল আমি তার নাম পর্যন্ত জানি না । আর তার সাথে দেখা করতে চলে এসছি । তাও আবার এমন একটা জায়গায় ।
কাঁচ ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়লাম । ভিতরের পরিবেশটা অন্য রকম । মনে হল যেন অন্য জগতে চলে এসেছি । আসলে এর আগে এমন আমি এরকম কোন জায়গায় আসি নি তো তাই অন্য রকম লাগছে । হয়তো এটাই স্বাভাবিক ।
ভিতরে ঢুকে বাকদিকটা কোনদিক তাই ভাবছি এমন সময় কোটটাই পরা এক ইয়াং লোক আমার দিকে এগিয়ে এল ।
“গুড আফটারনুন স্যার” ! আমি হাসার চেষ্টা করলাম । আসলে এরকম ভাবে কেউ আমাকে সম্বোধন করেনি তো তাই অস্বস্থি লাগছে ।
“আপনি আসুন আমার সাথে” ।
আমি অস্বস্থি নিয়ে লোকটার পিছু নিলাম । লোকটা একদম কোনার দিককার একটা টেবিলে আমাকে বসতে বলল । আমি বসে পড়লাম গোবেচারার মত । আল্লাহই জানে আজ কপালে কি আছে ?
“কি খাবেন স্যার” ?
“আসলে একজনের আসার কথা । ও আসলে তারপর বলি” ?
“জি । ম্যাডামের আসতে আসতে হালকা কিছু খান । উনি আমাকে খুব ভাল করে বলে গেছেন আপনার দিকে লক্ষ্য করতে” ।
মনের মধ্যে অস্বস্থিটা আরো বেশি করে জানান দিলো । জানি না আমাকে এরা কার সাথে গুলিয়ে ফেলছে ।
কপালে আজ কি আছে কে জানে ?
“পপকর্ন আনি ? ম্যাম আসা পর্যন্ত সময় কাটান” ।
“আচ্ছা” ।
“এসিটা কি আর একটু বাড়াবো” ?
“না ঠিক আছে । আপনার এতো ব্যস্ত হতে হবে না” ।
লোকটা হাসল । বলল “আমি আসেপাশেই আছি । দরকার হলে ডাক দিবেন” ।
“আচ্ছা ঠিক আছে” ।
আমি পড়লাম আবারও চিন্তায় । সব কিছু ঠিক মত হচ্ছে তো ? অবশ্য ভুল হবার কথাও না ।
মেয়েটা মিন্টু রোডের বাংলোতে থাকে । তারমারে তার বাবা প্রশাসনের বড় কর্মকর্তা । প্রভাব তো থাকতেই পারে ! আমি ঠিক এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না যে সত্যি সত্যি আজ তার সাথে আমার দেখা হচ্ছে ।
কয়দিন আগে তারসাথে আমার পরিচয় । পরিচয় আমি কেবল জানি মেয়েটা মিন্টু রোডের চুয়াল্লিস নম্বর বাড়ির পাশের বাংলোতে থাকে । তার নাম পর্যন্ত আমি জানি না । কি ভাবে যে তার সাথে আমার কথা হয়েছে , হবার কোন সম্ভাবনাই ছিল না ।
সেদিন টিউশনির জন্য একটু আগে আগেই বের হয়ে গেছিলাম । তাই সময় কাটানোর জন্য মিন্টু রোডটাতে হাটতে লাগলাম । পুরো ঢাকার মধ্যে কেবল এই এলাকাটাই আমার পছন্দ । সরকারের সব বড় বড় লোকেরা এখানে থাকে । হাটতে খুব ভাল লাগে ।
আজও হাটতে হাটতে সেই বাংলোটার সামনে এসে দাড়ালাম । এই বাংলো টা আমার খুব পছন্দের । কিন্তু এই বাংলোটার কোন নম্বর দেওয়া নেই । ৪৪ নম্বর বাড়ির পাশের বাড়ি এটা ।
অনেকটা আমাদের এলাকার মত । বাড়ির সামনে বিশাল এলাকা । সবুজ ঘাসে ভরা । যেটা শহুরে পরিবেশের সাথে মিশে না । খুব ইচ্ছা হল একটু এই সবুজ ঘাসের উপর একটু খালি পায়ে হাটি । তাহলে খুব ভাল লাগতো ।
একটু সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে গেলাম গেটের দিকে । একজন পুলিশ পাহারায় রয়েছে । নেমপ্লেটে দেখলাম মোবারক ।
“ভাই সাহেব একটু শুনবেন” ! মোবারক সাহেব এগিয়ে আসলো ।
“কি চাই” ?
“একটু ভিতরে আসতে দিবেন ? একটু হাটতাম” ।
আমার কথা যেন ঠিক মত বুঝতে পারল না লোকটা । সরু চোখে তাকালো আমার দিকে ।
“কি বলতাছেন এসব ? হাটবেন মানে কি ? হাটার জন্য এতো জায়গা রয়েছে এর মধ্যে কি” ?
আমি জানি আমি যা বলব এ লোক তা বুঝবে না । বললাম "একটু ঘাসের উপর বসতাম” !
লোকটা এবার বিরক্ত হল ।
“ঘাসের উপর বসবেন পার্কে গিয়া বসেন । জানেন এইটা কার বাসা । স্যার দেখলে আমার চাকরি থাকবে না” ।
“তাহলে ভাই দরকার নাই” । আমি হাটা দিলাম । মনটা একটু খারাপও হল ।
একটু দুরে গেছি তখন পিছন থেকে কে যেন ডাক দিল মনে হল । যদিও ঢাকা শহরে পিছন থেকে ডাক দেওয়ার মত আমার কেউ নাই তবুও পিছন ফিরে তাকালাম । দেখলাম মোবারক সাহেব আমাকেই ডাকছেন । আমি এগিয়ে গেলাম ।
মোবারক বললেন “বেশি বাড়ির দিকে যাবেন না । এই দিকটায় হাটা হাটি করেন” ।
তাৎক্ষনিক এই মত পরিবর্তনের কারন বুঝলাম না । তবে আমি অনেক খুশি হলাম । তাই মত পরিবর্তনের আগেই ঘুকে পড়লাম । বেশি ভিতরের দিকে গেলাম না । পায়ের চপ্পলটা খুলে ঘাসের উপর হাটলাম খানিকক্ষন ।
সত্যিই কি চমৎকার । কোন কৃত্রিম কিছু নাই । একেবারে অরিজিনাল । একেবারে প্রাকৃতিক । কতদিন এরকম তাজা ঘাসের উপর হাটি নি । একটু হাটার পর হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়লাম ।
ইস যদি একটু শোয়া যেত ! কিন্তু এটা করা যাবে না । মোবারক সাহেব নিশ্চয় চেয়ে আছে । সারা দিনের সব ক্লান্তি দুর হয়ে গেল এখানে এসে । যদি প্রতিটা দিন এখানে আসা যেত !
হঠাৎ পিছনে পায়ের আওয়াজ পেলাম । নিশ্চই মোবারক সাহেব । এখন চলে যেতে বলবে । কিন্তু ঘুরে দাড়িয়ে দেখলাম অন্য কেউ । ধবধবে সাদা চাদর গায়ে একজন মেয়ে দাড়িয়ে । মেয়েটার চেহারার মাঝে কি জানি একটা মায়া ছিল । একটা বিষন্নতা ছিল ।
আমি মুখের কথা হারিয়ে ফেললাম । কি বলব বুঝতে পারছিলাম না ।
আমার বিব্রত আবস্থা দেখে মেয়েটা বলল “আপনি দাড়ালেন কেন” ?
“না মানে এখন মনে হয় আমার চলে যাওয়া উচিত্” ।
“কেন ? আমি এসেছি বলে” ?
আমি কিছু বললাম না ।
মেয়েটা বলল “কোন সমস্যা নাই । বরং আমি মোবারক সাহেব কে বলেছি আপনাকে এখানে ঢুকতে দিতে” ।
আমি খানিকটা কৌতুহলী হলাম ।
“আচ্ছা । ধন্যবাদ” । মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন জাগলো যে কেন এমন ইচ্ছা হল তার । প্রশ্নটা করতে হল না । মেয়েটা বলল “আপনি যখন মোবারক সাহেবের সাথে কথা বলছিলেন আমি এখন ঐ পাশটায় ছিলাম । আপনার কথা শুনে খুব মজা লাগলো । কেউ ঘাসের উপর হাটতে চাইবে কেন ? খানিকটা কৌতুহল হল । তাই আপনাকে ভিতরে আসতে বললাম । আচ্ছা কারনটা বলবেন” ?
আমি হাসলাম । বললাম “আসলে আমি গ্রামের ছেলেতো । এই রকম তাজা ঘাসের উপর দৌড়াদৌড়ি করে বড় হয়েছি । ঢাকা শহরে সেই পরিবেশ কোথায় পাবো বলুন ? মাঝে মাঝে তাই দম বন্ধ হয়ে আসে । আপনাদের এই এলাকাতে আসলে একটু শান্তি লাগে” ।
মেয়েটি হাসল । তখনই আমার মনের মাঝে কেমন যেন একটা ধাক্কা লাগলো । মেয়েটার হাসিতে কেমন যেন একটা বিষাদের ভাব আছে । কেমন যেন একটা বিষন্নতা আছে । আমি অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম । মেয়েটার চোখের মধ্যেও কি এক দুঃখ আর বিষন্নতার ছায়া ।
এমন সময় আজান দিয়ে দিল । টিউশনীতে যেতে হবে ।
“আমি আজকে যাই ! টিউশনীতে যেতে হবে” ।
“কোথায় আপনার টিউশনী” ?
“এইতো কাজীর গলিতে । ভিএনএসের পাশে” ।
“আচ্ছা আপনার সাথে কথা বলে ভাল লাগল” ।
মেয়েটা আবার হাসল । আমি আবার সেই বিষন্নতা দেখতে পেলাম ।
কি মনে হল আমি জিঞ্জেস করলাম “আচ্ছা আপনার মনে এতো কিসের কষ্ট” ?
আমার কথাটা শুনে মেয়েটা যেন একটু চমকালো । মেয়েটা আমার প্রশ্নের জবাব দিলো না । খানিকক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল “ভাল থাকবেন” ।
তারপর চলে গেল । আমি বিষন্ন মন নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম ।
বারবার মনে হল মেয়েটায় মনে এতো কিসের কষ্ট ? তারপরের সারাটা রাত আমি কেবল এই ভেবে কেটে গেল যে মেয়েটার মনে এতো কিসের কষ্ট ?
(চলবে)