কয়দিন থেকেই ফারিয়া ব্যপারটার লক্ষ্য করছে । সকালের ঠিক নির্দিষ্ট একটা সময়ে ওর ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে । তাও আবার সকাল ছয়টার আশেপাশে । আগে যেখানে সাড়ে নয়টা দশটার আগে ঘুমই ভাঙ্গত না । সেখানে কোন এলার্ম ছাড়া এতো সকালে ঘুম ভাঙ্গা একটু আশ্চর্যের বিষয় ।
আজ থেকে ঠিক ১৯ দিন আগে ফারিয়ার প্রথম এমনটা হয় । প্রথমে চোখ খুলে ওর মনে হল যে হয়তো এখন অনেক বেলা । কিন্তু মোবাইলে দেখে মাত্র ছয়টা বাজে । খানিকটা বিরক্ত হয়েছিল । এতো সকালে কেন ঘুম ভাঙ্গল ! ও পাশ ফিরে শুল আর ঠিক কখনই ওর কাছে মনে হল জীবনের সব থেকে সুন্দর দৃশ্যটা ও দেখল ।
আকাশ কাত হয়ে শুয়ে আছে । মুখটা ওর দিকে ফেরানো । কেমন বাচ্চাদের মত জড়সড় হয়ে শুয়ে আছে । সকালের শুভ্র আলো আকাশের মুখের উপর পড়ছে । ফারিয়া কিছুক্ষন ওর দিকে তাকিয়েই থাকল ।
কি নিঃপাপ লাগছে ওকে ! দৃশ্যটা কি সুন্দরই না লাগছে ! ওর মনে এমন একটা দৃশ্য দেখেই ও ওর সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে । সেদিন যতক্ষন আকাশ ঘুমিয়ে ছিল ততক্ষনই ফারিয়া ওর দিকে এক ভাবেই তাকিয়ে ছিল । কি অদ্ভুদ একটা ভাল লাগার অনুভুতি যে ওকে ঘিরে রেখেছিল তা ও বলতে পারে না ।
তারপর থেকে প্রতিদিন ঘুমুবার সময় আল্লাহর কাছে কেবল এই একটা দোয়া করে যেন সকালে আকাশের আগে ওর ঘুম ভাঙ্গে । আজকেও ওর ঘুম সকাল সকালই ভেঙ্গেছে । প্রতিদিন ঘুম ভেঙ্গে প্রিয় মুখটা দেখতে পাওয়া বড় ভাগ্যের একটা ব্যাপার ।
হঠাত্ ও দেখল আকাশের ডান গালটাতে কেমন জানি একটু লাল লাল । ও খুব সাবধানে আলতো করে ঐ জাগাটা স্পর্শ করল । হুম জায়গাটা কেমন ফোলা ফোলা । মশা কামড় দিয়েছে ।
ফারিয়ার খুব রাগ হল । “বেটা ফালিজ মশা” ! ও মনে মনে বলল । “তুই কেন আমার আকাশের গালে কামড় দিলি ? ঐখানে কেবল আমি কামড় দিবো” । মনে মনে কথা বলেই ও লজ্জায় পড়ে গেল । নিজের কাছেই লজ্জা । মনে মনে বলল “এ কি বললাম” ! লজ্জায় একটা লাল আভা ওর পুরো মুখে ছেয়ে গেল ।
কিছুক্ষন পর ও নিজেকেই বলল “আমি ভুল কিছু বলি নি । আমার স্বামীর সব কিছুর উপর কেবল আমার অধিকার । অন্য কেউ কেন তাতে ভাগ বসাবে” !
“ আচ্ছা এখন যদি ওর গালে একটা চুম খাই ও কি রাগ করবে” ?
“কেন রাগ করবে” ?
“আমি ওর বিয়ে করা বউ না” ? তবুও ফারিয়া খানিকটা ইতস্তত করল ।
“কি হয়েছে ? রাগ করবে কেন ? আর করলে করুক । তাছাড়া ওর ঘুম বেশ গাঢ় । ও টের পাবে না” ।
তারপর খুব আল্তো ঠোটে ফারিয়া আকাশের গালে একটা চুম খেল । এতো যে ভাল লাগল ওর । ঠিক করল এবার থেকে প্রতিটি দিন ও এভাবে আকাশ কে চুম খাবে । ও যদি রাগ করে করুক ।
ফারিয়া মনে মনে বলল “আকাশ সাহেব শুনতে পাচ্ছেন ? আমি কিন্তু আপনাকে অনেক ভালবাসি” ।
কথাটা বলার পর ফারিয়ার মনটা খারাপ হল । ফারিয়া খুব ভাল করে জানে আকাশ ওকে ভাল বাসে না । আকাশ ঐ মেয়েটাকে ভালবাসে । এই জন্য আকাশ ওকে প্রথমে বিয়ে করতে চায় নি । বলা যায় ফারিয়ার আগ্রহেই বিয়েটা হয়েছ । ফারিয়ার মনে বিশ্বাস ছিল যে একদিন না একদিন আকাশ ওকে ভালবাসতে শুরু করবেই । ফারিয়া কেবল ঐ দিনটার জন্যই অপেক্ষা করছে ।
আকাশের সাথে ফারিয়ার পরিচয় ওর বড় চাচার অফিসে । ফারিয়া তখন সবে পড়ালেখা শেষ করে চাচার অফিসে যোগ দিয়েছে । একে ফারিয়া দেখতে সুন্দর , শুধু সুন্দর বলতে খানিকটা কম বলা হয় , তার উপর বসের ভাতিজি অফিসের মোটামুটি সব ব্যচেলর ফারিয়ার জন্য পাগল প্রায় । বিয়ে করার জন্য সদা প্রস্তুত । এসব নিয়ে ফারিয়া কিছু মনে করতো না । কারন স্কুল জীবন থেকে মানুষের কাছ থেকে ও এই রকম ব্যবহার পেয়ে আসছে । ও মনে করতো এমনই হবে । এটাই ওর কাছে স্বাভাবিক ছিল ।
আকাশও ওর সাথে কথা বলত । কিন্তূ অহেতুক কোন কথা না । তারপর একদিন ওর চাচাই ফারিযাদের বাসায় হাজির হল । ফারিয়া বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে । বড় চাচা যখন ওর বাবা মার সাথে কথা বলছিল ফারিয়া তখন আড়াল থেকে শুনছিল । বড় চাচা আকাশের কথা বললেন । বললেন যে ছেলেটা খুব ভাল । তোমরা বললে আমি ছেলেটার সাথে কথা বলতে পারি । ফারিয়ার বাবা মাও রাজি হল । আজ কাল ভাল ছেলে আর পাওয়া যায় কোথায় ? ফারিয়া অমত করেনি । খারাপ কি !
কিন্তু যেদিন বড় চাচা বললেন যে ছেলেটা বিয়ে করতে চাচ্ছে না ফারিয়ার বাবা মা বেশ অবাক হয়েছিল । এমন প্রস্তাব মানুষ ফিরিয়ে দেয় কিভাবে । কিন্তু সব থেকে বেশি অবাক হয়েছিল ফারিয়া নিজে । কোন ছেলে যে ওকে রিজেক্ট করতে পারে এটা ও বিশ্বাস করতে পারল না !
প্রথমে খুব মেজাজ খারাপ হল । কিন্তু মেজাজ খারাপটা ক্রমেই মন খারাপের দিকে । বার বার মনে হল ছেলেটা কেন ওকে রিজেক্ট করল ?
কেন করল ? ও দেখতে খারাপ হয়ে গেছে ? ও কি আর দেখতে সুন্দর না ? সারাটা দিন কেবল এই কথাটা ওর মনে হতে লাগল । ফারিয়া কিছুতেই এটা থেকে মুক্তি পেল না । অবেশেষে ও ঠিক করল যে আকাশের সাথে কথা বলবে ? কারনটা জিঞ্জেস করবে । তা না হলে ও শান্তি পাবে না ।
অফিস গিয়ে সরাসরি কথাটা জিঞ্জেস করল । আকাশের চেহারা দেখে কেন জানি মনে হল ও যেন জানতো ফারিয়া এমন কিছু একটা কথা একদিন না একদিন বলবে ।
ঐ দিন আকাশ অনেক কথা বলেছিল । একটা মেয়েকে ও ভালবাসে । যদিও মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে তবুও তার প্রতি বিন্দু মাত্র ফিলিং পরিবর্তন হয় নি । এখন একজন কে মনের মধ্যে রেখে অন্য জন কে বিয়ে করা কি ঠিক ? যদি বিয়েটা হয় তাহলে তো ফারিয়ার প্রতি অবিচার করা হবে ।
আকাশ যুক্তি দেখা বিয়ে হলে সে না পারবে ঐ মেয়েটা ভুলতে না পারবে ফারিয়াকে ভালবাসতে । নতুন করে তখন জটিলতা তৈরি হবে । কি দরকার বলুন ? ফারিয়া কোন জবাব দিতে পারে নি ।
বাসায় এসে ওর মন টা আরো খারাপ হয়ে গেল । কি একটা না পাবার আফসোস রয়ে গেল । ফারিয়ার মনে এর আগে কখনও কোন জিনিসের জন্য আফসোস হয় নি । তবে আজ ওর মনে হল ইস এমন একটা ভালবাসার মানুষ ওর থাকতো ! জীবনে আর কিছু চাইবার থাকতো না !
ঐ দিন রাতে ফারিয়া তার মা বলে দিল যে সে আকাশকেই বিয়ে করবে ? ও ছাড়া আর কাউকে না । এরপর আকাশ আর অমত করে নি ।
বিয়ের আগে কেবল ফারিয়া বলেছিল যে সব কিছু জানার পরেও যখন তুমি বিয়ে করতে চাইছ তখন আমি আপত্তি করবো না । স্বামী হিসাবে আমার যা দায়িত্ব তা আমি পালন করবো কিন্তু এর বেশি কিছু তুমি আশা করবে না । আর অবজেকশন দিতে পারবে না ।
তারপরই ওদের বিয়ে হয়ে যায় । তাও প্রায় মাস খানেক ।
ফারিয়া উঠে পড়ল । একটু পরই আকাশে ঘুম ভেঙ্গে যাবে । ওর জন্য চা বানাতে হবে । আগে কাজটা বুয়া করত । ওর নিজের কাজটা করতে খুব ভাল লাগে । শুধু চা না আকাশের জন্য প্রত্যেকটা কাজ করতে ওর খুব ভাল লাগে । এখন মনে হয় কেন যে ভাল করে রান্নাটা শেখেনি !
চা নিয়ে এসে দেখে আকাশের ঘুম ভেঙ্গে গেছে । চা টা বাড়িয়ে দিয়ে ফারিয়া একটু হাসল ।
বলল “ঘুম ভাল হয়েছে” ? আকাশও হাসল । আস্তে করে পেয়ালাতে চুমুক দিল ।
আকাশের চায়ে চুমুক দেওয়ার স্টাইলটা বেশ সুন্দর । বাচ্চাদের মত । বাচ্চাদের মত একটু একটু করে খায় ।
ফারিয়া তাকিয়েই থাকে । চোখ ফেরাতে পারে না । চা খাওয়া শেষ হলে আকাশ বাধরুমে গেল ফ্রেস হবার জন্য ।
ফারিয়া কাপ নেওয়ার পর দেখল আজও একটু চা রয়ে গেছে । এই ছেলেটা না ! কোন কিছুই সম্পুর্ন খায় না ।
প্রথম যেদিন এমনটা দেখলো ফারিয়া বলল “চা ভাল হয় নি” ? উত্তরে আকাশ বলল “না না ভাল হবে না কেন ? ভাল হয়েছে” ।
“তাহলে খাও নি যে” ?
“ও ! খেয়েছি । আসলে আমার এটা একটা বদ অভ্যাস । কোন কিছুই আমি পুরোপুরি খেতে পারি না” ।
সত্যি তাই । এ কয়দিনে ফারিয়া লক্ষ্য করল আকাশ সবকিছুই নষ্ট করে ।
আকাশের রাখা চা টুকু খেয়ে ফেলে এক চুমুকে । এর স্বাধ টাই আলাদা । আগে ফারিয়া কখনও কারো এতো করা কিছু খায় নি এমন কি ছুয়ে পর্যন্ত দেখতো না আর এখন আকাশের এটো করা জিনিস ও কি আনন্দের সাথেই না খায় । মানুষ প্রেমে পড়লে কত কিছুই না পরিবর্তন হয় !