তারপর ইরার সাথে আমার আর দেখা হয় নি । কয়দিন পরেই ওরা আমাদের এলাকা ছেড়ে চলে যায় । আর S.S.C পরীক্ষার পর আমিও চলে আসি ঢাকায় । তারপর আর যাওয়া হয়নি খুব বেশি ।
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে কালকের কথা গুলো মনে পড়ল । আজ ইরার সাথে আবার দেখা হবে এটা ভাবতেই মনের ভিতর কেমন একটা আনন্দের অনুভূতি বয়ে গেল । আমি ভেবে অবাক হই এতো দিন ইরার উপর কেবল মিথ্যা রাগ করেছি অথবা বলা যায় মিথ্যা রাগের অভিনয় করেছি । কালকে ওর সাথে দেখা হবার পর আমার সব রাগ কোথায় উড়ে চলে গেল । সত্যি তাই পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ থাকে যাদের উপর রাগ করে থাকা যায় না কিছুতেই ।
সকাল এগারটার দিকে রবীন্দ্রস্বরবরে দেখা করার কথা ছিল । গিয়ে দেখি ও আগেই এসে হাজির । আজ ও হালকা নীল রংয়ের একটা চুড়িদার পরেছে । আমি এমনই আশা করেছিলাম । এটাও আমার পছন্দের রং । সত্যি বলতে কি ওকে নীল চড়িদারে নীল পরীর মত সুন্দর লাগছে । সকাল বেলা লোক সমাগম কম । আমরা নিড়িবিলি একটা জায়গা দেখে বসলাম ।
আমি কিছু বলার আগেই ও বলল “সারা রাত খুব ভয়ে ছিলাম” ।
“ কেন ? ভয়ে ছিলে কেন” ? আমি অবাক হলাম ।
“না মানে যদি তুমি না আসো” । তারপর আমার হাতটা ধরে বলল “তুমি আমার উপর অনেক রেগে আছো না” ?
“ইরা আজ এতো দিন পর এসব কথা তুলে কি লাভ বল ? তোমার উপর রাগ ...!” বলতে গিয়ে থেমে যাই । আমি খানিকটা হাসি ।
“রাগ থাকলে কি এখানে আসতাম ? রাগ হয়তো নেই কিন্তু সেদিনকার সেই আচরনে আমি খুব বেশি অবাক হয়েছিলাম আর খুব বেশি কষ্ট পেয়েছি যার ক্ষত এখনও সুকায় নি” ।
ইরা খানিকক্ষন চুপ করে থাকল । কি বলবে তাই হয়তো গুছিয়ে নিচ্ছে ।
“আচ্ছা তোমার কি মনে এই কথাটা একবারও হয়নি আমি এমন একটা কাজ কেন করলাম” ?
“আমি জানি না । কিন্তু পরিস্থিতি এমন ছিল যে ঐ ভাবনাটা মাথায় আসতে দেইনি । সত্যি কেন করেছিলে এমনটা” ? “আব্বুর জন্য । তুমি জানো আমি আব্বুকে অনেক ভয় পেতাম । সেদিন যখন আব্বু তোমাকে ধরল আমি ভয়ে আধমরা হয়ে গিয়েছিলাম । আমার মাথায় ভয় ছাড়া আর কিছুই কাজ করছিল না । আব্বু কিছু আচ করতে পেরেছিল । রাতে বাসায় এসে আমাকে জিঞ্জেস করে তোমার কথা । বলে যে তোমার সাথে আমার কোন যোগাযোগ আছে কিনা । আমি কেমল একটু মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলেছি আব্বু এমন জোড়ে একটা চড় মারল । আমি তাল সামলাতে না পেরে দুতিন হাত দুরে গিয়ে পড়লাম । তারপর কি পরিমান ....”
কথাটা বলতে বলতে ইরা কেঁদে ফেলল । কাঁদতে কাঁদতে বলল “আমি আর সহ্য করতে পারি নি । ঐ টুকু বয়সে আমার আর সাহসে কুলাই নি আব্বুর বিরুদ্ধে যাবার । সেই শক্তি আমার ছিল না । তাই আব্বু যা যা বলতে বলেছিল আমি তাই বলেছিলাম” ।
আমি হাত দিয়ে ওর চোখের জল মুছিয়ে দিলাম ।
“থাক কেঁদো না আর । এখন আর কাঁন্নাকাটি করে কি লাভ” !
“ বিশ্বাস করো সেদিধ যখন তোমার বাবা তোমাকে মারছিল প্রতিটা আঘাত যেন আমার গায়ে লাগছিল । কি যে একটা অপরাধ বোধ আমি বয়ে বেড়াচ্ছিলাম এই ছয় বছর ! একটা রাত যদি আমি শান্তিতে ঘুমাতে পারি ! এমন কোন দিন নেই যে আমি তোমার কথা ভাবি নি” !
কিছুক্ষন ইরা নিরবে কাঁদল । আমি ওকে কাঁদার সময় দিলাম । এতোক্ষন ও আমার হাত জড়িয়ে ছিল এখন আমি ওর হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিলাম ।
বললাম “দেখো যা হয়ে গেছে সে তো আর ফেরানো যাবে না । ঐ কথা ভেবে আর লাভ নাই” ।
কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললাম “এখনও কি তোমার আব্বুকে ভয় পাও” ?
ইরা মাথা নাড়াল । বলল “ঐ দিনের পর আমি আব্বুর সাথে কথা বলি না” ।
“সত্যি” ? আমি খানিকটা অবাক হলাম । “একই বাসায় থাকো অথচ কথা বল না ? জানো ঐ দিনের পর আমার বাবা আর আমার মুখ পর্যন্ত দেখে নি । কথা বলা তো দুরে থাকুক” ।
দেখলাম ইরার মুখটা আবার মলিন হয়ে গেল । বল্ল “আমার জন্য তোমার আজ এই অবস্থা । আমি কিভাবে নিজেকে ক্ষমা করবো” ?
“বলেছি না যা হবার হয়ে গেছে । ঐ কথা চিন্তা করে কি লাভ” !
ইরা আমার কথা শুনে খানিকটা প্রশন্ন হল । বললাম “জানো তোমার সাথে দেখা হবার আগ পর্যন্ত আমি ভাবতাম যে তোমার উপর আমার অনেক রাগ । কিন্তু তোমার সাথে দেখা হবার পর বুঝতে পারলাম আসলে তুমি যাই কর না কেন তোমার উপর রাগ করার ক্ষমতা আমার নাই ই । আমি হাজার চেষ্টা করেও তোমার উপর রাগ করে থাকতে পারি নি” ।
ইরা এক মনে আমার কথা গুলো শুনছিল । কথা শেষ হলে বলল “এখন আমার কি করতে ইচ্ছা হচ্ছে জানো” ?
“কি” ?
“তোমাকে জড়িয়ে চুম খেতে । খাবো” ?
“আরে মাথা খারাপ নাকি’ ? আমি আতকে উঠলাম । “পাগল হয়েছ ? চারিপাশে লোকজন দেখছো না” ?
ও অদ্ভুদ চোখে তাকাল আর কেবল হাসল । বুঝলাম সুযোগ পেলে ও কাজটা ঠিকই করবে ।
আমি আর কিছু ভাবি না । এক দিকে ইরার প্রতি ভালবাসা আর এক দিকে বাবা । ইরার উপর তো রাগ করা ঠিক হবে না । ও তো এমনটা ইচ্ছা করে নি । আমি পারবো ও না রাগ করে থাকতে । আর বাবা আমার কোন কথা না শুনেই সে আমাকে ত্যাজ্জ করে দিয়েছে । কি করবো আমি জানি না । জীবন যেমন চলছিল চলুক । মাঝ খান দিয়ে যদি ইরার ভালবাসা আসে ক্ষতি কি?
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০১২ বিকাল ৫:২৬