কিন্তু বড়মামার এই বাসায় আসলে ওর বিকাল বেলাটা এভাবেই কাটে । বারান্দায় বসে । আজও বারান্দায় বসে ছিল । মানুষ জনের আসা যাওয়া দেখছিল ।
ঠিক এমন সময় মীম ছেলেটা কে দেখলো । প্রথমে এজ ইউজাল দেখছিল । কিন্তু দ্বিতীয়বার ছেলেটার উপর চোখ পড়তেই মীমের মনে কেমন যেন এক অনুভূতি হল । তারপর আর একটু ভাল করে দেখে ওর সত্যি বিশ্বাস হচ্ছিল না , সত্যি সত্যি মীম ছেলেটাকে দেখছে কিনা ? চোখের ভুল না ।
যখন বুঝতে পারলো চোখের ভুল না আসলে ও ছেলেটাকে খুজে পেয়েছে ওর পুরা শরীর জুরে এক ধরনের শিহরোন বয়ে গেল । বুক ধরফর করতে লাগল । ইচ্ছা হল এখনই দৌড়ে নিচে নেমে যেতে ।
কিন্তু ও কোন তাড়াহুড়া করল না । এখন যদি ও নিচে নামতেও যায় হয়তো ও ছেলেটাকে হারিয়ে ফেলবে । তাই ওর বারান্দায় বসে দেখতে লাগল ছেলেটা কোন বাড়ির মধ্যে ঢোকে । সত্যি এতো দিন পর মীম এভাবে ছেলেটাকে খুজে পাবে তাও আবার এভাবে ? ও এমনটা ভাবতেই পারে নি ।
ছেলেটা আসতে আসতে হাটছে । মাথা নিচু করে । দুপকেটে হাত ঢুকিয়ে । সেদিন যাবার সময় ছেলেটা দুপকেটে হাত ঢুকিয়েই হাটছিল । হাটতে হাটতে ছেলেটা ঠিক অপজিট বিল্ডিং টায় ঢুকে পড়লো ।তাহলে সে এখানে থাকে ! মীম আর দেরি করলো না । মোটামুটি দৌড় দিল নিচে নামার জন্য । ওর আর কোন দিকে খ্যাল নাই ।
ড্রইং রুমে ওর মামাতো বোন তিথি বসে ছিল । ওকে এভাবে বের হতে দেখে বলল “কই যাস এভাবে?”
“আপু ওকে দেখেছি” ।
“ওকে ! কাকে ?”
“ ঐ ছেলেটাকে” ।
তিথি বেশ অবাক হল । তিথি তার শান্ত শিষ্ট বোনটাকে এর আগে কথনও এতো উত্তেজিত দেখেনি ।
“সত্যি দেখেছিস ? ভুল হয়নি তো” ।
“না আপু বিশ্বাস কর । আমার একটুও ভুল হয় নি” ।
“ কোথায় দেখেছিস” ?
“গলির মাথা ধরে হাটতে হাটতে আমাদের অপজিট বিল্ডিংটাতে ঢুকলো” ।
“আচ্ছা দাড়া । আমিও যাচ্ছি তোর সাথে । কিন্তু আগে তুই ড্রেস বদলা । এভাবে নিচে যাবি নাকি ?”
মীম নিজের পোশাকের দিকে তাকালো । খানিকটা লজ্জা পেল । কেবল একটা টপ আর লেগিংস । এভাবে নিচে যাওয়া যায় নাকি ? টপখুলে একটা কামিজ পরল । তারপর নিচে গেল ।
তিথি সামনের বাড়ির দারোয়ান কে চিনতো । তাকে গিয়ে বলল “একটু আগে যে একটা ছেলে ঢুকলো ছেলেটা কয় তালায় থাকে ?”
“ কালো ব্লেজার পরেছিল” ।
দাড়োয়ান বোধহয় চিনতে পারল । বলল “উনিতো এখানে থাকেন না” ।
“ তাহলে” ?
“পাঁচতলার সামাদ সাহেবের ছেলেকে উনি পড়ান” ।
“ ও । প্রতিদিন আসেন” ?
“প্রায় প্রতিদিন” ।
“ সন্ধ্যায় আসেন ?”
“বেশির ভাগ সময়েই আসেন এই সময়ে” ।
“কতক্ষন থাকেন” ?
“এই ধরেন দেড় দুই ঘন্টা” ।
তিথি বলল চল” দেড় ঘন্টা পরে আবার আসবো চল” ।
“ না আপু তুমি যাও । আমি এখানে ওয়েট করি “।
“আরে খামোখা এখানে বসে থাকবি কেন” ?
“না আপু আমি কোন চান্স নিতে চাই না” ।
তিথি খানিকটা অবাক হল । মীমের মুখের এক্সপ্রেশন দেখে আর কথা বাড়াল না । কেবল বলল “আচ্ছা আমাদের গেটের কাছে বসে থাকিস । ওখান থেকে তো এই গেট টা দেখা যাবে । চল ।“
মীম নিঃশব্দে এগিয়ে গেল । ওর এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে সত্যি সে ছেলেটার দেখা পেতে যাচ্ছে । আর তার থেকেও বেশি অবাক হচ্ছে যার নাম পর্যন্ত ও জানে না তার জন্য এতো টান দেখে ।
এই তো যেন সেদিনকার কথা । মীম ওর ক্যাম্পাসে ছিল । ক্লাস ছিল না । তাই নাট্য মঞ্চের পাশে বসে কি যেন একটা বই পড়ছিল । এমন সময় ছেলেটা ওর সামনে এসে দাড়াল । মীম মুখ তুলে চেয়ে দেখে শ্যামলা চিকন লম্বা একটা ছেলে । মোটামুটি সুদর্শন । প্রথম দেখাতে কারো খারাপ লাগবে না ।
“আমাকে কিছু বলবেন” ?
ছেলেটা মাথা ঝাকাল । কিন্তু ছেলেটার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল যে ছেলেটা খুব বিব্রত বোধ করছে ।
“আসলে যে কিভাবে কথাগুলো বলব । কিন্তু তার আগে প্লিজ আপনি কিছু মনে করবেন না” ।
“ বলুন” ।
“আমি আসলে এখানে পড়ি না । কিছু বন্ধুদের সাথে আপনাদের এই ক্যাম্পাসটা দেখতে এসেছি । ওদের সাথেই ঘুরছি লাম এমন সময় আপনাকে দেখি । আপনাকে দেখার পর কেমন জানি অদ্ভুদ এক অনুভুতি হতে লাগল আমার মনের মধ্যে । এই অনুভূতির ব্যাখ্যা আমি কিছুতেই করতে পারলাম না । এরকম টা আগে কথনও আমার সাথে হয় নি । আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল আপনার সাথে আমার কথা বলতেই হবে । না বললে আমি যেন ঠিক মত বাঁচবো না । দম আটকে মারা যাবো” ।
ছেলেটা আর কি বলবে যেন খুজে পেল না । মীমও কি বলবে খুজে পেল না ।
ছেলেটা একটা গোলাপ ফুল ইতস্তত এগিয়ে দিয়ে বলল যদি এটা নিন তাহলে আমার খুব ভাল লাগবে । মীম গোলাপফুলটা নেওয়ার সময় ছেলেটার দিকে তাকাল । ছেলেটার চোখের দিকে তাকাল । ছেলেটার চোখ দেখে মনে হল ছেলেটা যেন সত্যি কথা বলছে ।
“আমি এখন যাই” ? যাই বলেও ছেলেটা চলে গেল না ।
“আমি তাহলে যাই ? আর আপনেকে বিব্রত করার জন্য আমি সরি” ।
বলে ছেলেটা পিছন দিকে হাটা দিল । কিন্তু পিছন ফিরে তাকাল আবার । তারপর আবার । মীম গুনলো মোট ছয়বার ছেলেটা পিছন ফিরে ওকে দেখল ।
মীমের হয়তো ভুলে যাবা উচিত্ ছিল । কিন্তু মীম ভুলে গেল না । বলতে গেলে ভুলতে পারলো না । ছেলেটার ঐ ইনোসেন্ট চেহারা সে কিছুতেই ভুলতে পারলো না । আসতে আসতে ঐ ছেলেটার চিন্তা ওকে পেয়ে বসল ।
সেদিন রাতে ঘুমুবার সময় মীম লক্ষ্য করল ওর ঘুম আসছে না । ঘুরে ফিরে কেবল ঐ ছেলেটার কথাই মনে আসছে । একবার মনে হল কি সব ছাই পাশ ভাবছে ও । কোথাকার কে না কে ? কি না কি বলে গেল ? আর ও গাধার মত রাতের ঘুম কামাই করে ঐ ছেলেটার কথা ভাবছে । আর ঐ ছেলেটা হয়তো ওর কথা চিন্তাও করছে না । কত মেয়ের সাথে এমন ভাবে লাইন মেরেছে কে জানে ? কিন্তু এই কথা মানতে মীমের মন সায় দিল না । মীমের মনে হল যেন এখন ছেলেটাও ওর কথাই ভাবছে । ও যেমন জেগে আছে ছেলেটাও জেগে আছে । ঐ দিন পুরো রাত মীম ছেলেটার কথা ভেবে কাটাল ।
পরদিন সকাল বেলা ঐ নাট্যমঞ্চের কাছে ছেলেটার জন্য ওয়েট করল । হয়তো ছেলেটা আবার আসবে ভেবে । ছেলেটা আর আসে নি । কিন্তু মীম ছেলেটাকে কিছুতেই আর ভূলতে পারল না । মীমও কতটা অদ্ভুদ ভাবেই ছেলেটার প্রেমে পড়ে গেল ।
মীম পুরানো কথা গুলো ভাবছিল । বাস্তবে ফিরে এল । এমন সময় মীম দেখলো ছেলেটা আসছে । মীম গেটের কাছে গিয়ে দাড়াল । ছেলেটা প্রথমে ওকে একবার দেখল । কিন্তু ভাল করে খ্যাল করল না ।
কিন্তু পরক্ষনেই ওর দিকে আবার ফিরে তাকালো । এবার একরাশ বিশ্ময় ছেলেটার চেহারা জুড়ে দেখা দিল । কিছুক্ষন কেউ কোন কথা বলতে পারল না । কতক্ষন এভাবে দুজন দুজনার দিকে তাকিয়ে ছিল বলতে পারবে না । মীম নিজেই এগিয়ে গেল ছেলেটার দিকে ।
“হাই” !
“ হাই” ! ছেলেটা কোন রকমে বলল ।
তারপর আবার দুজনে কথা হারিয়ে ফেলল । কিছুক্ষন পর এবার ছেলেটা নিরবতা ভাঙ্গল । “সত্যিই কি তুমি” !
মীম হাসল । “বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি” ?
“সত্যি আমার বিশ্বাস হচ্ছে না” ।
“যখন তোমাকে প্রথম দেখলাম তখন আমারও বিশ্বাস হয় নি । কিন্তু এখন বিশ্বাস হচ্ছে” ।
মীম দেখল ছেলেটা এখনও ওর দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে আছে । ছেলেটার বিশ্ময় এখনও কাটে নি ।
“এসো হাটিঃ । গলির মধ্যেই ওর হাটতে লাগল ।
কিছুক্ষন হাটার পর ছেলেটা বলল “একটু সামনেই মিন্টু রোড । ঐ এলাকাটা আমার খুব পছন্দ । চল ওখানে যাই” ।
“ চল” ।
“ কোন সমস্যা হবে না তো” ।
“ না কোন সমস্যা নাই চল” ।
ওরা রিক্সায় উঠল । রিক্সায় যেতে মীম বলল “জানো তুমি আসবে এই আশায় আমি পরদিন ঐ নাট্যমঞ্চের কাছে গিয়ে ছিলাম” ।
“ সত্যি তুমি গিয়েছিলে” ? ছেলেটার মুখে একরাশ বিশ্ময় ।
“ হু” ।
“ আমি কি গাধা ! একটা বারও মনে হয় নি তুমি ওখানে যেতে পারো । তাহলে আরো কত তাড়াতাড়ি আমাদের দেখা হয়ে যেত”।
“তুমি গিয়ে ছিলে” ? মীমও অবাক হল ।
“ আমি তোমাদের ভার্সিটির প্রত্যেকটা ডিপার্টমেন্টের সামনে একেক দিন ওয়েট করতাম । মেয়েদের হলের সামনে ওয়েট করতে চেয়েছিলাম বাট ঐটা অশোভন মনে হয়েছে তাই হয় নি । যখন মনে হয়েছে আমার ভাগ্যে তোমাকে দ্বিতীয়বার দেখা হওয়া নেই , তখন চলে এসেছি” । মীম কোন কথা বলতে পারল না । কেবল চেয়ে থাকল ছেলেটার দিকে নিরবে ।
মিন্টু রোডটাতে পৌছানোর পর ছেলেটা বলল “জানো আমার অনেক দিনকার ইচ্ছা আজ পুরন হল” ।
“ কি ইচ্ছা” ?
“দেখো এই এলাকাটা ঢাকার অন্য এলাকা গুলোর মত না । আমার অনেক দিনের শখ এই রাস্তাটা ধরে আমার প্রিয় মানুষটার সাথে হাটবো । আজ সেটা পূরণ হল” ।
মীম হাসল । কিছুক্ষন ওরা নিরবে হাটল ।
এক সময় মীম বলল “আচ্ছা তুমি আমার নাম জানো” ।
ছেলেটা মাথা নাড়াল ।
“একজন মানুষের সম্মন্ধে তুমি কিছুই জানো না । এমন কি নাম পর্যন্তও না , তাহলে সে তোমার প্রিয় মানুষ হয়ে গেল” ? এবার ছেলেটা বলল “তুমি আমার নাম জানো” ?
“ না” ।
“ তাহলে” ?
“তাহলে কি” ?
“তাহলে আমার সাথে যখন তোমার দেখা হল তোমার চোখমুখে ওমন একটা আনন্দের আভা ছিল কেন ? আমার জন্য সেদিন ওয়েট কেন করেছিলে”? মীম কোন জবাব দিতে পারল না ।
ছেলেটা এতোক্ষন মীমের পাশাপাশি হাটছিল । এবার ও মীমের সামনে দাড়াল ।
ওর চোখে চোখ রেখে বলল “আমি তোমার সম্পর্কে কিছুই জানি না । কেবল এইটুকু জানি যে ঐ দিন তোমাকে দেখার পর থেকে আমার জীবনে ভালবাসার মানে হচ্ছ তুমি । তোমার সাথে যদি আমার আজ কিংবা কোন দিন দেখা নাও হত তাহলেও আমি তোমাকেই ভালবাসতাম । মেয়ে তুমি কি আমাকে ভালবাসো” ??
(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুন, ২০১২ সকাল ১১:২৪