আমি জানতাম ইরা আবার আসবে । সকাল বেলাতেই একবার নাকি এসেছিল । ম্যানেজার সাহেব বলল । আমার ডিউটি বিকালে থাকে তাই দেখা হয় নি । কালকে যখন ও আমাকে দেখল ওর আচরন অন্য রকম হয়ে গিয়েছিল । কাল ইরা আর কিছু বন্ধুরা মিলে এখানে এসেছিল বিকেল বেলা । আর আমার ডিউটিও ছিল বিকেল বেলাই । ওকে আমিই প্রথম দেখি । নিজেকে আড়াল করতে চাই । আল্লাহর কাছে দোয়া করি যেন ও আমাকে না দেখে । কিন্তু এই রেস্টুরেন্টের ক্যাস কাউন্টারে আমি বসি আমি । চাইলেই আড়াল হওয়া যায় না । বিল দিতে ও নিজেই এল । মনে হল যেন আমাকে দেখে খানিকটা শক খেল । দেখছিলাম টাকা দেওয়ার সময় ওর হাত কাপছিল । কোন মতে ও কাউন্টার ছেড়ে চলে গেল ।
আমি জানতাম ও আবার আসবে । ওকে আসতেই হবে । আমার সাথে ও যা করেছে সেই অপরাধ বোধই ওকে নিয়ে আসবে । আজ ওর কারনেই আমার জীবনটা এমন । আজ ওর কারনেই আমি সবার কাছ থেকে দুরে । আমার ফ্যামিলির কাছ থেকে দুরে । আমার বাবার কাছ থেকে দুরে ।
সন্ধ্যার কিছু আগে ও রেস্টুরেন্টে ঢুকল । খানিকটা অবাক হলাম ওর পোষাক দেখে । আমি সাদা রংয়ের সেলোয়ার কামিজ পছন্দ করি । ও জানতো আমার পছন্দের কথাটা । এমন কি আমি নিজেও নিজেও ওকে একবার গিফট করেছিল । আমার মনে খানিকটা সন্দেহ ছিল আজ ও তাই পড়ে আসবে । সত্যি তাই । আগে যখন ও এরকম ড্রেস আপ করতো আমার খুব ভাল লাগতো । আমার ভাল লাগার কথা ওকে বললে ও নিজেও খুব খুশি হত । আজকেও এই এতো দিন পর আমাকে খুশি করা চেষ্টা দেখে খানিকটা অবাক না হয়ে পারলাম না ।
সরাসরি ও কাউন্টারের দিকে ই এগিয়ে এল । ওর চোখদুটো গাঢ় কিছু বলতে চায় । কিন্তু আমি শুনতে চাই না ।
আমাকে কিছু বলার আগেই আমি বলি “বলুন ম্যাম কি খাবেন ?”
ইরা আমার কাছ থেকে এটা আশা করে নি নিশ্চই । এতো দিন পর দেখা ।
ও হয়তো ভেবেছিল আমি হয়তো সবকিছু ভুলে যাবো ।
কিভাবে ভুলে যাবো ?
প্রথমে ও ভেবে পেল না কি বলবে । নিজেকে সামলে নিয়ে বলল “আমি কি তোমার সাথে কিছুক্ষন কথা বলতে পারি ?”
“ জি ম্যাম অবশ্যই পারেন । আমি এখানে আছি আপনার কথা শোনার জন্য ।“
ওকে যেন একটু আহত মনে হল ।
“তুমি আমার সাথে এমন করে কথা বলছ কেন?”
“ ম্যাম আমি কি আপনার সাথে কোন খারাপ ব্যবহার করলাম ? দেখুন ম্যাম আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করলে আমার চাকরি থাকবে না ।“
“ অপু তুমি এমন কেন করছো আমার সাথে ? একটু স্বাভাবিক ভাবে কথা বল প্লিজ ।“
“ সরি ম্যাম আমি এখন ডিউটিতে আছি । ডিউটিতে পারসোনাল আলাপ করা নিষেধ ।“
“ আচ্ছা আমি তাহলে ওয়েট করি?”
“ সেটা আপনার ইচ্ছা ।“
“ তোমার ডিউটি শেষ কথন ?”
“ রাত সাড়ে এগারটায় ।“
ওকে একটু হতাশ হতে দেখলাম ।
“কালকে তোমার সময় হবে না ।“
“ জি না । আমার সময় নাই ।“
“ পরশু ?”
“ না ।“
“ তারপর দিন ? মাত্র অল্প একটু সময় !”
আমার খানিকটা মেজাজ খারাপ হল । “আমার সাথে তোমার কি কথা ? বল কি কথা ? আমি তোমার কোন কথা শুনতে চাই না । কোন কথা না । তোমার মত মেয়ের সাথে আমার কোন কথা থাকতে পারে না ।। বুঝছো তুমি ?”
এতো ক্ষন ও চোখের পানি আটকে রেখেছিল । আর পারল না ।
আমার খানিকটা মায়া হল । কি করবো ? মানুষের মন বড় অদ্ভুদ জিনিস । কখন যে কি হয় ? কখন মন কি যে চায় বোঝা বড় মুশকিল । মায়া টাকে একপাশে সরিয়ে রাখলাম । আর যাই হোক এই মেয়েকে আমি কিছুতেই ক্ষমা করবো না । কিছুতেই না ।
ইরা কাঁদতে কাঁদতেই বলল “অন্তত আমাকে কিছু বলার সুযোগ দাও ।“
ম্যানেজার স্যার মনে হয় কিছু একটা আচ করেছে । আমাদের দিকে এগিয়ে এল । ইরার দিকে তাকিয়ে বলল “কোন সমস্যা?”
টিসু দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ইরা মাথা নাড়াল ।
ম্যানেজার স্যার এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল “কি ব্যপার অপু উনি কাঁদছেন কেন?”
“আমি কিভাবে বলব স্যার ? উনাকেই জিগ্জেস করুন ।“
দেখলাম ইরা আসতে আসতে হেটে বাইরে চলে গেল ।
ডিউটি শেষ হতে হতে অনেক রাত হয়ে গেল । যখন রেস্টুরেন্ট থেকে বের হলাম তখন প্রায় ১১টা বেজে গেছে ।
বেরিয়েই ইরাকে দেখলাম রাস্তার পাশে চুপচাপ বসে আছে । এটা আমি একদমই আশা করিনি ।
আমি ভাবতেই পারি নি ও এতোক্ষন অপেক্ষা করবে ! তার উপর আবার এতো রাতে ! এই টুকুন পিচ্চির মেয়ে এতো সাহস হল কিভাবে ??
আমাকে দেখে ও উঠে দাড়াল । ওর উপর যত রাগই থাক না কেন ওকে একা রেখে চলে যেতে মন চাইল না কিছুতেই ।
ও আমার সাথে যাই করুক না কেন ওকে তো ভালবাসতাম এক সময় ।
হয়তো ...! হয়তো এখনও বাসি । এবার আমি নিজেই এগিয়ে গেলাম ওর দিকে ।
“তুমি কি চাও আমার কাছে ? এতো রাত পর্যন্ত কোন মেয়ে বাইরে থাকে?”
ও কোন কথা বলল না । কেবল নিরব চোখে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে কিছুক্ষন । তারপর টুপ করে চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল ।
এই মেয়েটার সমস্যাটা কি ? বার বার এতো কাঁদে কেন ? স্বাভাব দেখি আগের মতই আছে । কথায় কথায় চোখের পানি ফেলা ।
“অন্তত কিছু বলার সুযোগ দাও আমাকে প্লিজ । সেদিন আমি কেন কিছু বলি নি তার কারন নিশ্চই আছে । আর যে যাই ভাবুক তুমিতো জানতে যে আমি তোমাকে ভালবাসতাম । এখনও বাসি ।“
আমি কি বলব ভেবে পেলাম না । ওকে দেখেতো এমনিতেই আমার মন দুর্বল হয়ে গিয়েছিল । ওর কথা শুনে নিজের রাগ কিছুতেই ধরে রাখতে পারছি না ।
বললাম “এখন অনেক রাত হয়ে গেছে । কাল বল । এখন তোমার বাসায় যাওয়া উচিত্ ।“
আমার কথা শুনে ও যেন শান্তি পেল মনে ।
“চল তোমাকে বাসায় দিয়ে আসি ।“
ইরা আরো একটু খুশি হল । আমি রিক্সা ডাকলাম ।
সেই ছয় বছর আগের অনুভূতিটা আবার ফিরে এল । আগে কত ওর সাথে এভাবে পাশাপাশি রিক্সায় চড়েছি । ভেবে অবাক হলাভ এতো দিনেও সেই অনুভূতিটা মরে যাই নি । তাহলে কি ...??
আগে রিক্সায় চড়ার সময় ইরা সবসময় আমার হাত ধরে থাকতো । রিক্সায় ওঠার পরও আজ ও ইতস্ততঃ করছিল । শেষ পর্যন্ত ধরেই ফেলল । বাসায় আসার আগ পর্যন্ত একটাবারও হাতটা ছাড়ল না । যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে ।
রিক্সা থেকে নামার আগে ও আমার গালে মৃদু করে একটা চুমও খেল । খুব স্বাভাবিক ভাবেই খেল । বলল “তোমাকে ঠিক ছয় বছর দুমাস এগার দিন পর চুম খেলাম । আমার যে কি পরিমান ভাল লাগছে তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না ।“
রিক্সা থেকে নেমে বলল “কাল সকালে দেখা হবে । কেমন !!”
আমি রিক্সা ঘুরাতে বললাম । রিক্সা চলতে আরাম্ভ করলে আমি পিছন তাকালাম । ও তখনও দাড়িয়ে । হাত নাড়ল আমার দিকে । আমিও নাড়লাম । বাসায় এসে ফ্রেস হয়ে বিছানায় গেলাম ।
ইরার কথাই কেবল মনে পড়ল । ওর কথাই কেবল মনে পড়ছে ।
আশ্চর্য ! এতো দিনে এই অনুভূতি গুলো বিন্দু মাত্র মলিন হয়নি । এতো কেবল আমার মনে হত যে আমি ইরার উপর রাগ করে আছি । কিন্তু আজ ? ওর প্রতি অনুভূতির কাছে সেই রাগ টিকতেই পারল না । তা না হলে এমন কেন হবে ??
কিন্তু ও সেদিন ওমনটা কেন করল ? নিজের ভাবনায় নিজেই ডুবে যাই । সেই ছয় বছর আগে । তখন সবে মাত্র টেনে উঠেছি । বলতে গেলে আবেগ আর ভালবাসা সবে মাত্র জীবনে দেখা দিতে শুরু করেছে । ভালবাসার ফুল ফুটবে ফুটবে করছে ঠিক তখনই ইরারা আমাদের এলাকায় এল । আর আমি প্রথম দেখাতেই ইরার প্রেমে পড়ে গেলাম । আমার এখনও মনে আছে যেদিন ওকে প্রথম দেখি ও সেদিন লাল রংয়ের একটা সেলোয়ার কামিজ পরেছিল । বাবা হাত ধরে হাটছিল ।
দুয়েক দিনের মধ্যেই নামধাম সব কিছু খোজ নিয়ে ফেল্লাম । কয়দিনের মধ্যেই আমি ভাবনায় বিভোর হয়ে গেলাম । ওকে ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না । কিছুদিনের মধ্যে মোটামুটি এলাকার সবাই এ কথা জেনে গেল । এতে একটা সুবিধা হল যে ইরাকে কেউ টিজ করার সাহস পেত না । কারন এলাকায় আমাদের একটা প্রভাব ছিল । আমার বাবা রাজনীতি করতেন । তার উপর আমার বড় ভাই ডিফেন্সে চাকরি করতো । তখন এলাকায় আমার ভাবই আলাদা ।
আমি এ জিনিসটা দেখতাম । অন্য মেয়েদের পাড়ার ছেলেরা টিজ করলেও ইরা কে কেউ টিজ করতো না । বেশ বুঝতে পারতাম ও নিজেও এ ব্যপারটা বেশ ইনজয় করছে । প্রায় প্রতিদিন ওর সাথে দেখা হত । একদিন সকালের দিকে আমি ওদের বাড়ির গলির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম । এমন সময় হঠাত্ করেই ও গলি থেকে বেড়িয়ে এল । ওর চেহারায় কেমন যেন এক তাড়াহুড়া দেখতে পেলাম । আমার দিকে একটু তাকিয়ে দাড়িয়ে থাকা একটা রিক্সার দিকে এগিয়ে গেল । কিন্তু রিক্সা ওয়ালা যেতে চাইল না । ওকে একটু হতাশ দেখলাম । তাড়াতাড়ি করে ও আবার হাটা দিল । নিশ্চই কোথাও যাওয়া জলদি আছে । আমি রিক্সা আলার কাছে গেলাম । আগেই বলেছি এলাকায় বেশ প্রভাব ছিল আমাদের । রিক্সা ওয়ালা দৌড়াতে দৌড়াতে ইরা পিছনে ছুটল রিক্সা নিয়ে । ইরা প্রথমে বেশ অবাক হল রিক্সাওয়ালাকে দেখে । তারপর আমার দিকে তাকাল । কি বোঝার কি বুঝল কে জানে । রিক্সায় উঠে পড়ল ।
ঐ দিন বিকেল বেলাই ইরার সাথে আমার আবার দেখা হল । ভাল করে বললে হয় ইরা নিজেই দেখা করতে এল । আমি মাঠে বসে খেলা দেখছিলাম । এমন সময় ইরা এসে সামনে দাড়াল । আমার তখন কথা হারিয়ে গেছে । কি বলব বুঝতেই পারছিলাম না । আমি ভাবতেই পারি নি নিজে আমার সামনে আসবে !
আমার দিকে বিশটাকার একটা নোট বাড়িয় দিয়ে বলল
“নিন ।“
আমি আরো খানিকটা অবাক হলাম । কি বলে এই মেয়ে ? কোন মতে বললাম “মানে কি ? টাকা নেব কেন?”
“মানে হল সকাল বেলা আপনি যে রিক্সা ঠিক করে দিলেন না?’
“হ্যা দিয়েছি । এই জন্য টাকা নেবো কেন?”
“ আরে বাবা কথা শেষ করতে দেবেন তো ! যাকে ঠিক করে দিলেন সে আমার কাছ থেকে টাকা নেয় নি । তারমানে আপনি দিয়েছেন নিশ্চই ।“
“ না আমি টাকা দেই নি সত্যি ।“
“ আমি জানি আপনিই দিয়েছেন । টাকাটা নিন ।“
“ দেখো রিক্সাওয়ালা টাকা না নিলে আমি কি করবো বল ? তোমাকে টাকা দিতে হবে না ।“
“ দেখুন টাকাটা নিন কিন্তু । যদি আপনি এখন টাকা না নেন তাহলে কিন্তু আর কোন দিন আপনার ঠিক করা রিক্সায় উঠবো না ।“
(চলবে)