১ম পর্বঃ Click This Link
২য় পর্বঃ
Click This Link
৪।
বাকের ভাই-এর জামানায় যে গলির কাদা মাখা চিপায় চিপায় "হাওয়া মে উড়তা যায়ে,মেরা লাল দোপাট্টা মাখমাল কি" গান বাজতো - বেটার ছিলো, এট লিস্ট কানের উপর অত্যাচার হত না, আর এই চিকনি চামেলী, হ্যানের ত্যান মার্কা গান যে এখন বাজে! ইচ্ছা করে পায়ের জুতা খুলে এক একটা সাউন্ডবক্সের উপর মারি। প্রমা বাড়িতে যাওয়ার পথে প্রতিদিনের মত মনে মনে গজ গজ করতে থাকেন।
ভাঙ্গা রাস্তার ঝাঁকি খেতে খেতে তার মনে পড়ল খালি বাসায় ঢুকতে হবে। খুব অপছন্দের একটা কাজ। একলা বাসায় ঢুকে অন্ধকার রুম দেখা কেমন যেনো মরা বাড়ির মত মনে হয়। প্রিয়মটাকে নিয়ে আসলে হত! কথাটা ভাবতেই লজ্জা পেলেন তিনি। খুব বেশি স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছেন কি তিনি? নাকি বরাবরই এমন ছিলেন?
দুপুরে যখন প্রিয়ম ফোন করে বলল লুবনার দাদা মারা গেছেন, মা'র মুখটা মনে পড়ে গেলো, মা'র বয়সটা কি লুবনার দাদার চেয়ে খানিকটা কম? মা'র ও কি হঠাত করে সুগার লেভেলটা বেড়ে যেতে পারে? কিংবা বহুদিনের পুরনো হার্টটা গন্ডগোল করবে না তো? একা ঘরে মা'র মনটা কি বুড়ো হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন? সময় কি হয়ে আসছে? সময় কি খুব তাড়াচাড়ি চলে যাচ্ছে?
প্রমার মা'কে কেমন জানি মানুষ মনে হয় না, কখনো কাঁদে না, কখনো বিলাপ করে না, কখনো অভিযোগ করে না, মা'টা এমন কেন? মাঝে মাঝে মনে হয় মা যদি আরেকটু মানুষের মত হত, যদি আরেকটূ নরম হতো, যদি আরেকটু নিজের কথা ভাবতো, যদি তার মত, আর দশজনের মত স্বার্থপর হত......।
৫।
লুবনার দাদার বাসা থেকে বের হওয়ার পরও গাটা ছমছম করতে থাকে প্রিয়মের। আগরবাতির গন্ধটা এতো অশরিরী কেন কে জানে! লুবনার দাদুর কথা মনে পড়তেই প্রিয়মের মনটা কেমন করতে লাগলো দিদার জন্য। আচ্ছা তার দাদু কেমন ছিলো? দিদা কি দাদুর জন্য আড়ালে কাঁদে? তার দাদু বেঁচে থাকলে কি সে এখন লুবনার দাদুর মতই বুড়ো হত। প্রিয়ম দাদুর মুখটা মনে করার চেষ্টা করে। ছবিতে দেখা মুখ মনে পড়ে আবছা আবছা।
"আংকেল গাড়ী ঘুরিয়ে দিদা'র বাড়ি যান তো!"- ড্রাইভারকে বলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় প্রিয়ম।
বাহ ছেলেটা তো জোস। ভেবেই লজ্জা পায় প্রিয়ম। ছিঃ কিরকম বেহায়া হয়ে যাচ্ছে সে। এরকম একটা সিচুয়েশনে কেউ ছেলে দেখে! অবশ্য দেখে তো, প্রিয়মের মনে পড়ে কুন্তলা নামের ভীষণ স্মার্ট যে মেয়েটি ওদের সাথে পড়ে সে তার নানীর কুলখানীর দিন বয়ফ্রেন্ডের সাথে চলে গেলো লং ড্রাইভে আশুলিয়া, বাসায় বলল ক্লাসে পরীক্ষা আছে, ক্লাসে এসে বলল তার বাসায় যেতে হবে নানীর কুলখানি, আপারাও জানতেন যে কিছুদিন আগেই অর বাসায় কেউ মারা গেছেন, তাই ছেড়ে দিলেন। পরে তাকে কলেজ ড্রেসে দেখা গেলো আশুলিয়ায়, তাও ফিজিক্স স্যার জগীন্দরের হাতে ধরা খেলো, বেচারা! সেই নিয়ে কি কাহিনী!
ঘটনাটা মনে পড়তেই প্রিয়মের মনে হলো সে মনে হয় ঠিক এই জেনারেশনের মধ্যে পড়ে না। সংখ্যার বয়সটা একি হলেও সে কি ভীষণ বুড়িয়ে গেছে!
দিদা'র বাড়িটা দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। যেন আভিজাত্য আছে, জাকজমক নেই, অহংকার আছে, অহমিকা নাই!
"দিদা তুমি দেখছো এদ্দিনে তোমার অপরাজিতা ফুটছে! " বলতে বলতে ভিতরে ঢুকলো প্রিয়ম। দিদা বাইরে এসে জড়িয়ে ধরল তাকে। দিদার গায়ে একটা পুরনো পুরনো ঘ্রাণ আছে। যেমন্টা মহাস্থাঙ্গড় কিংবা ময়নামতিতে পাওয়া যায়। কিংবা রাজস্থানের পুরনো মন্দিরে পাওয়া যায়। একটা পোড়া মাটির ঘ্রাণ!
দিদা তুমি শুকায়ে গেছো এবারো! খাওয়া দাওয়া কিছছু কর না, না? বিন্তিদি তুমি কি রান্না বান্না কর না নাকি? বলতে বলতে প্রিয়মের চোখ যায় বড় বাবার স্টাডির দিকে। বইগুলা সব মেঝে তে ছড়ানো।
দিদা তুমি এগুলা গুছাতে নিছো নাকি! তালার চাবিটা পেলা কৈ!
চাবি আসবে কথা থেকে আর, ভাঙ্গালাম।
সেইতো ভাটি দিলা,আরো আগে কেন দিলা না? হাসে প্রিয়ম। এই বুকশেলফের প্রতি তার ছোট বেলা থেকেই ভীষণ লোভ। এতোদিন শুধু মা, দিদার মুখে শুনেই আসছে এখানে ট্রেজার আছে! স্বাধীন বাংলা বেতারের রিহার্সেল বসত এই বাসায়। "ইস কি দুর্দান্ত দিন ছিলো না তখন দিদা?"
তনিমা নাতনীর হঠাত প্রশ্নে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন "কখন?"
এই যে যখন এখানে যখন স্বাধীন বাংলার রিহার্সেল হত? তুমি কি করতে দিদা তখন? ইউ ওয়ার ইয়ং,না দিদা? আমার সমান ছিলে? নাকি আরেকটু বড়? কিশোরী না তরুণী ছিলে বল তো!
তনিমা হাসেন। উনিশ বছর বয়সটা কে কি বলে? টু ওল্ড টু বি কিশোরী, টু ইয়াং টু বি তরুণী! ইঁচরেপাকা বয়স একটা! কিন্তু সময় একটা প্রভাবক। ৭১ পনেরো বছরের ছেলেটিকেও কি যুবক বানিয়ে দেয় নি? আবার ষাট বছরের বৃদ্ধকেও যুদ্ধে নামিয়েছিলো এই ৭১ ই। তনিমার মাঝে মাঝে মনে হয় ঐ একটা সময়ে দেশের সবার বয়সটা একই হয়ে গিয়েছিলো,কেউ কিশোর, বাচ্চা, ছিলো না, কোন বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, মিডেল এইজ়ড ছিলো না, সবার বয়স যেন বাইশ তেইশ হয়ে গিয়েছিলো।
একটা পুরো জাতি যুবক হয়ে গিয়েছিলো।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১২ বিকাল ৩:০৬