১ম পর্ব এই লিংকে
৩।
ধানমন্ডি চার থেকে তিনের দিকে যেতে হাতের বাঁ দিকে যে ছোট ছিমাছাম দোতলা বাসাটা দেখা যায় গাছপালার ফাঁক ফোকর দিয়ে সেটা নামে খান বাড়ি হলেও এখন আর সেখানে কোন খান থাকেন না। তবে যিনি থাকেন তিনি প্রয়াত মঞ্জু খানের মেয়ে বটে। তনিমা শায়লা মাঝে মাঝেই ভাবেন মেয়ের নামের সাথে বংশের টাইটেল না দেয়ার প্রবণতা কি পকিস্তান আমলেই শুধু ছিলো,নাকি এখনো বাবা মা-রা ভাবেন যে বংশের টাইটেলটা শুধু ছেলের জন্যই জরুরী।
জানালা গুলো খুলে দিয়ে কফির কাপ নিয়ে তনিমা ছাদের দরজা খোলেন।এক কাপ কফি আর এক আকাশ ভোর নিয়ে ছাদে বসে থাকার এই অভ্যাস তার বহুদিনের। যেমন একলা থাকার অভ্যাসটাও।
তনিমা স্মৃতিতে ডুব মারেন। ফয়সাল যখন চলে গেলো প্রমা তখন কোলে। কতই বা বয়স তখন তনিমার, বাইশ হবে। প্রমার বয়স মাত্র ছ মাস।
চুহাত্তর। অস্থির সময়। জন্মের পরের হোঁচট খেতে খেতে একটা জাতির চলার সময়। স্বাধীনতা পেয়ে কি হলো, তখনো বুঝে ঊঠতে পারে নি এমন এক সময়।অবশ্য কি হলো সে প্রশ্নের উত্তর কি আজো পাওয়া গেছে!
রিলিফ ফুড অফিসার ফয়সাল, তিন বছর আগে গেরিলা যুদ্ধ করা ফয়সাল, ঢাকা ভার্সিটির ভীষণ রোমাণ্টিক ফয়সাল প্রতিদিন ঘরে ফিরত এক রাশ হতাশা নিয়ে। মনে হত যেন একটা লম্বা পথ কুয়াশা ঢাকা,আর তারা সবাই সেই কুয়াশার ভেতর দিয়ে চলছে, যেন কিছু দেখা যায়,আবার নিজের দেখাটাকেই মরিচীকা মনে হয়, যেন হাত বাড়ালেই স্বাধিকারের আনন্দ, কিন্তু এক পা এগুলেই আবার হতাশার কুয়াশা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই রোমান্টিক ছেলে ফয়সাল প্রতিদিন রিলিফ দিতে গিয়ে দেখত, হিসাব অনুযায়ি ১০ ভাগের এক ভাগ পরিমাণ ত্রাণও নেই, বড় কর্তাদের ঘরে খিচুরি, পোলাও রাঁধার পর যতটুকু ফেরত আসত তা দিয়ে মাস হিসেবে না খেয়ে থাকা এই মানুষগুলোর এক সহস্রাংশ অভাবও পূরণ হতো না।
গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ফয়সাল প্রতিদিন নতুন করে হতাশায় নিমজ্জিত হয়। ব্লাকে বিক্রি করা চাল, তেল, নুনের দাম জোগানো অসম্ভব। তনিমা যতটুকু যোগাড় হয় তাই দিয়ে টেনেটুনে সংসার চালায়, ফয়সালকে বলে এইতো বেশ চলে যাচ্ছে। কিন্তু ফয়সালের চোখ এড়ায় না খান বাড়ির ভীষণ আহ্লাদী মেয়েটার গালের হাড় বেড়িয়ে এসেছে, হাতে তার মার গড়ানো চুড়িটা ঢল ঢল করে আজকাল।
ঘরে ফ্যাকাশে হয়ে আসা তনিমার চামড়া, বাইরে হা পিত্যেশ করতে থাকা যমুনা বুড়ি ফয়সালের সত্তাকে ভেঙ্গে খান খান করে দেয় ।
একাত্তরের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভীষণ রোমান্টিক ছাত্রনেতা, একাত্তরের পর ক্ষমতা দখলের রাজনিতীতে গা না ভাসানো ফয়সাল, রিলিফের বাকি নয় ভাগ চাল, ডালের হিসাব চেয়ে লাশ হয়ে ফেরে ঘরে, স্বাধীনতার ঠিক তিন বছর পর, চুহাত্তরের ডিসেম্বরে, ঘরে তার ছয় মাসের মেয়ে অপরাজিতা প্রমা।
রেফারেন্সঃ
" প্রতিবছর দশ-বিশ লাখ টন চাল ভারতে পাচার হয়। এর সবটুকু হাতে এলে সরকারের বন্টন ব্যবস্থার ঘাটতি পূরণের জন্য যথেষ্ট হবে। খাদ্য উৎপাদন ও আমদানি বাবদ প্রাপ্ত খাদ্যশস্যের শুধু উদ্বৃত্ত অংশ প্রায় ৫০ লাখ টন খাদ্যশস্য পাচার করেছে।
(গার্ডিয়ান, লন্ডন, ৮ নভেম্বর , ১৯৭৪)"
"বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ৫০ লাখ মহিলা আজ নগ্ন দেহ। পরিধেয় বস্ত্র বিক্রি করে তারা চাল কিনে খেয়েছেন। ডা. আব্দুল ওয়াহিদ জানান, স্বাভাবিক সময়ে হয়তো আমরা কয়েক ডজন ভিখারীর মৃত দেহ কুড়িয়ে থাকি। কিন্তু এখন মাসে অন্তত ৬০০ লাশ কুড়াচ্ছি। সবাই অনাহারে মৃত। যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু কঙ্কার আর কঙ্কাল। বোধ করি হাজার হাজার। প্রথমে লক্ষ করিনি। পরে বুঝতে পারলাম অধিকাংশ কঙ্কালই শিশুদের।
(জন পিলজার, ডেইলি মেইল, লন্ডন, ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭৪)"
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১১:৩৪