১।
ক্লাসে গিয়ে বসতে না বসতেই লুবনা এসে বলল হচ্ছে না আজকে। যা বাবা প্রতিদিন দিন একই ঝামেলা আর কাহাতক ভালো লাগে! শেষ হয়ে গেলে যণত্রনা কমত, কিন্তু বিশ্বজিত স্যারই বা কেন এতদিন ধরে আসছে না সেটা বুঝতে পারছে না প্রিয়ম।
"কালকে থেকে দাদূর শরীরটা ভালো না,এই জানলে দাদু বাসায় জেতাম, ধ্যাত স্যারের যে কি হয়েছে আজকাল, এরকম তো কখনো দেখি নি", বলল লুবনা।
হঠাত প্রিয়মের মনে হলো আচ্ছা স্যারের কিছু হলো না তো!
"লুবনা শোন, ঐ যে লম্বা করে মেয়েটা, কি যেন নাম , পল্টু স্যার যাকে ক্যাবলা ডাকে.....।"
"কে ঐশী?"
"হ্যা হ্যা, ও পড়ে না বিশ্বজিত স্যারের কাছে?"
"হুম পড়ত তো মনে হয়, যদিও স্বীকার তো করে না, জিজ্ঞাসা করলেই বলল্বে " নাঁ তোঁ আঁমার তোঁ বাঁসায় বাঁবা পঁড়ায়!.।.।" লুবনাকে এমনভাবে হাত টাত নেড়ে মিমিক করতে দেখে প্রিয়ম হাসি আটকে রাখতে পারলো না, এক ক্লাস মেয়ের মাঝখানে হো হো করে হেসে দিলো!
এরই মধ্যে পুতুল আপাকে আসতে দেখে তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে
সামনের দিকে ফিরে বসল, সেকেন্ডের মধ্যেই ক্লাসের মেয়েরা সব যে যার জায়গায়, পুতুল আপা হচ্ছে সেই প্রজাতির মানুষ যে মুখে একটি বাজে কথা না বলে, গলার স্বর একটুও চড়া না করে , হাসি হাসি মুখে এমন সব কথা বলবেন যে তার সামনে যে থাকবে তার মনে হবে "হে ধরনী দ্বিধা হও!"
"গাআর্লস এজ ইউ নো, ইউর ম্যাথমেটিকাল টিচার ইজ এবসেন্ট টিল নাও ফর হিস আনএভওয়েডেবল রিজন্স। সো উই হ্যাভ ডিসাইডেড ফ্রম টূমরো ইট উইল বি মি টিচিং ম্যাথস হেয়ার, এন্ড ইউর পোস্টপন্ড ক্লাসটেস্ট উইল হেল্ড টূমরো! এভ্রিবডি ক্লিয়ার দ্যাট?" বলে তার বিখ্যাত চশমার কোণা দিয়ে তাকালেন ক্লাসের দিকে!
প্রিয়মের মনে হলো সারা ক্লাসের মেয়েরা এইবার সুইসাইড করবে, গণ আত্মাহুতি!! পুতুল আপার ম্যাথ ক্লাস!!!!! সিরিয়াসলি??! এই ছিলো কপালে!
পুতুল আপা চলে যাওয়ার পড়েও অনেক্ষণ ক্লাসে কোন সাড়াশব্দ নাই, বুঝাই যাচ্ছে সকলে অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছে। আপা যাওয়ার পর পরই সেকেন্ড প্রিয়ডের ঘন্টা পড়ে গেলো, ঐশীকে আর জিজ্ঞাসা করা হলো না স্যারের কথা। স্যারের কথা ভাবতেই প্রিয়মের মনে একটা অস্বস্তি হতে শুরু করলো, আসলেই তো হাসি খুশি মানুষটার কি হলো!
টিফিন ব্রেকে দিদা'র ফোন আসলো, দিদা'র বাসায় দাওয়াত, নিশ্চয় পিঠা বানিয়েছে। শীতকালটা বেশ লাগে, কেমন উৎসব উৎসব ভাব! বিয়ে , দাওয়াত , পিঠা
-এবং ডিসেম্বর!
২।
মাঝরাতে মারজুকের ফোন পেয়ে ঘুম ভাঙ্গলো লুবনার। এই ছেলের মতলবটা কি! সে প্রায় প্রায়ই আজকাল মাঝরাতে গল্প ফেদে বসে তার ফাউল ব্যান্ডের কি হইছে, না হইছে, কোথায় কার বংশ উদ্ধার করছে, এতো কথা বলে,এতো কথা বলে যে মাথা ধরে যায়। ফ্যামিলি ফ্রেন্ড বলে প্রথমে ভদ্রতা রক্ষা করতে গিয়ে এরকম ক্যাচালে পড়তে হবে এই কথা যদি সে আগে জানতো! উফ! ফোনটা সাইলেন্ট করে দিয়ে শুয়ে পড়ল আবার সে। কালকে তো আবার পুতুল আপার পরীক্ষা! "কার চেহারা দেখে যে ঘুম থেকে উঠছিলাম খোদা!"
"লুবনা, লুবনা দরজা খোল। তোর দাদুর ওখানে যেতে হবে"- চোখটা দ্বিতিয়বারের মত লেগে আসতেই মার দরজা ধাক্কায় ভেঙ্গে গেলো, ঘুম চোখে দরজা খুললেও মাথায় কিছু ঢুকছিলো না.।।
"কি হইছে মা?" মা চিৎকার করে উঠতে লুবনার হুশ আসলো- "দাদু!"
মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ মনে হচ্ছিলো যেন শেষই হচ্ছে না, পৌঁছায়ে দাদুর ঘরে দৌঁড়ে যেতে দেখতে পেলো একটা ছোট হয়ে আসা নিথর শরীর পড়ে আছে বিছানায়।
লুবনার দাদু ডাকে হাতটা কি একটু নড়লো, চোখের পাতাটা কি একটূ কাঁপলো? ভীষণ ক্লান্ত দেখানো এই শরীরটাও যে দুদিন আগে একদম ফিটফাট ঘুরে বেড়াচ্ছিলো কে জানবে? মৃত্যু কি এরকমই,এতোই সহজ?
দাদুর গলার স্বর লুবনার কানে বাজে " যা বাঁচতেছি এখন সব বোনাস, একাত্তরেই তো উবে যেতে পারতাম, সে সুখ কপালে হলো না, এখন যে বেলা ডাক আসবে তাতেই খুশি!"
একসময় চোখের পানি শুকিয়ে যায়, কেউ একজন দাদুর মুখ পশ্চিমে ঘুরিয়ে শুইয়ে দেয়, লুবনা দাদুর ঠান্ডা হাত ধরে বসে থাকে। তরতাজা স্মৃতিগুলো চোখের সামনে একটা একটা করে ভাসতে থাকে, মানুষ চলে যায়, তার স্মৃতি জেগে থাকে উত্তরসূরীর রক্তে। হয়তো সেজন্যই লুবনা ৭১ কে যেন স্পষ্ট দেখতে পায়, ঐ যে দাদু এই হাতে রাইফেল ধরে আছে, বাচ্চু দাদা অপারেশন কালুরঘাটে শহীদ হওয়ার আগের রাতে যে দাদুকে আজমীরি দাদুর জন্য চিঠিটা দিলো তাও যেনো লুবনার সামনেই। দাদুর মাথার পাশে এখনো গোর্কিস চাইল্ডহুড বইটা পড়ে আছে, কেউ একজন সরিয়ে সেখানে পবিত্র কোরান শরীফ রাখলো।
লুবনা গোর্কির বইটা নিলো, একটা পৃষ্ঠা ভাঁজ করা,
" The next impression which my memory retains is a deserted corner in a cemetery on a rainy day. I am standing by a slippery mound of sticky earth and looking into the pit wherein they have thrown the coffin of my father. At the bottom there is a quantity of water, and there are also frogs, two of which have even jumped on to the yellow lid of the coffin. At the graveside were myself, grandmother, a drenched sexton, and two cross gravediggers with shovels."
লুবনার পৃথিবী ঝাপসা হয়ে আসে।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১২ দুপুর ১২:৫৭