ঢাকা শহরে যে বাচ্চাগুলো জন্মেছে, তারা নিঃসন্দেহে অনেক বেশি ভাগ্যবান কারণ তারা মফস্বলের বাচ্চাদের চেয়ে অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বড় হচ্ছে। তারা দেশের সেরা স্কুল-কলেজে পড়াশুনার সুযোগ পায়, সবচেয়ে ভালো কোয়ালিটির জামা কাপড় পরে, ভালো রেষ্টুরেন্টে খাওয়ার সুযোগ পায়!! কিন্তু তারা যে সংকীর্ণ পরিবেশে বড় হচ্ছে তাতো আমাদের গ্রাম বা মফস্বলের অনেক খারাপ পরিবেশের চেয়েও খারাপ!!
না, এই কথা শুনে ভাবার কারণ নাই যে পরিবেশ খারাপ মানে পরিবেশ নোংরা! আমরা যারা ঢাকার বাইরে শৈশব-কৈশর পার করেছি তারা এই ব্যাপারটা ভালো বুঝতে পারি!! আমি ছোটবেলায় প্রতিদিন খেলেছি আমার নানিবাড়ীর ধানের খোলায়, আজকের ঢাকা শহরের বাচ্চারা আমার মনে হয় ধানের খোলা কি এই ব্যাপারটাই জানে না!! আমার মনে পড়ে না যে জীবনে কোনদিন ব্যাগ ভর্তি বই-খাতা নিয়ে স্কুলে গেছি! আর এখনকার ২য় বা ৩য় শ্রেণীতে পড়া বাচ্চা যে পরিমাণ বই-খাতা নিয়ে স্কুলে যায় দেখলে অবাক লাগে!! এরা এদের জীবনের শুরুতেই পরিচিত হচ্ছে “চাপ” নামক এক ভয়ানক জিনিসের সাথে যা তাদের বাকি জীবন বয়ে বেড়াতে হবে! তারা নিজেরাও জানে না কি ভয়ংকরভাবেই না তাদের শৈশব-কৈশরের সরলতাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে এই বই-খাতার স্তুপের মধ্যে!!!
আমার এই লেখার উদ্দেশ্য কোনভাবেই মহৎ কিছু নয়, কোনভাবেই এটি কাউকে খোচা দেয়া বা উদ্দেশ্যপ্রণিত নয়। এইটা পুরোপুরিই আমার নিজের কথা! তবে এই কথাগুলো পড়ে যদি কেউ একটুও বোঝে যে আসলেই আমরা না জেনে অনেক বড় ক্ষতি করে ফেলছি আমাদের নতুন প্রজন্মের, তাহলেই সান্তনা!! আসলে আমার এই বাচ্চাগুলাকে দেখলে ইদানিং খুব মন খারাপ হয়!! এরা মনে হয় জীবনে কোনদিন মাঠে গিয়ে ক্রিকেট বা ফুটবল খেলতে পারবে না, এরা হয়তো কোনদিনই আম গাছ থেকে আম চুরি করে খেতে পারার আনন্দটাও পাবে না!! এদের জীবন কেটে যাবে কম্পিউটারে বসে ফিফা/ক্রিকেট খেলতে খেলতে, বন্ধুর স্কুল ব্যাগ থেকে ক্যাডবেরি চুরি করে খাওয়ার আনন্দই সম্বল হবে এদের!!
সেদিন এক বাচ্চাকে দেখলাম, ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে। সে তার মা’কে বলতেছে, মাম্মি তুমিতো জানো আমি ব্যানানা(Banana) খেতে পছন্দ করি না, দ্যান(then) কেনো বারবার পোক(poke) করছো!!! পোক শব্দটা বলতেই মনে পড়লো ফেসবুকের কথা! ফেসবুকের কল্যাণে এখন সারা দুনিয়া জুড়ে আমাদের ফ্রেন্ড(বন্ধু না বলে ফ্রেন্ড বলায় মনে হয় ভালো!!)। আমরা এখন ইচ্ছা করলেই একজন আরেকজনকে গুতা(পোক’এর খাস বাংলাতো গুতা টাইপেরই কিছু হওয়ার কথা!!) মারতে পারি, সে আমাদের খুব কাছের কেউ হউক আর না হউক। এখন ৭/৮ বছরের অনেকেও বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহার করে। কেউ কেউ এখন ফেসবুকে হিন্দীতে ষ্ট্যাটাস দেয়, সালমান-শাহরুখ’কে নিয়ে তাদের ভালবাসা ভার্চুয়ালি জানিয়ে দেয় পৃথিবীকে!! এদের আমরা বলি “ইচড়ে-পাকা”!!
এই শ্রেণীর অন্তর্গত শিশু(বয়স বিবেচনায়)-কিশোরদের বড় অংশ(সিংহভাগই বলা যায়) ঢাকার ছেলে-মেয়ে!! আচ্ছা আমরা যে এই জেনারেশনকে দোষ দেয় ঢালাওভাবে যে এরা বেয়াদব হয়ে বড় হচ্ছে, এরা দেশের কৃষ্টি-কালচার ভুলে গেছে, অপসংস্কৃতিতে গা ভাসাচ্ছে এটার জন্য কি আমরা, আমাদের শহুরে শ্রেণীই সবচেয়ে বেশি দায়ী না!!!
আজ আমরা নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের কাছ থেকে বড়দের সম্মান করার প্রবণতা আশা করি কিন্তু যারা এইগুলা আশা করে তাদের কয়জনের বাবা-মা’কে(সন্তানের নানা-নানি,দাদা-দাদি) তাদের সন্তানের সান্নিধ্য আসার সুযোগ দেয়া হয়েছে!!! আমাদের ঢাকা শহরের এখন কয়টা পরিবারে নানা-নানি, দাদা-দাদি থাকেন স্থায়ীভাবে!! একটা বাচ্চা নানা-নানি বা দাদা-দাদির কাছে থাকলে মূল্যবোধের যে শিক্ষাটা পায় তা অনেক সময় হয়তো বাবা-মার পক্ষেও দেয়া সম্ভব হয় না আর এখনতো অধিকাংশ পরিবারেই মা’ও চাকরি করে তাহলে কিভাবে বাসার পরিচারিকার কাছে রেখে যাওয়া সন্তানের কাছ থেকে আদব-কায়দা আশা করে!! আদব-কায়দাতো মানুষ পরিবেশ থেকে পাই, যে বাচ্চাটার পুরা পরিবেশ হলো ছয়’তলা দালানের কোন এক ফ্লোরের এক অংশের চার দেয়াল, সে কিভাবে এর চেয়ে বেশি পরিবেশ চিনবে, কিভাবে পরিবেশ থেকে শিক্ষা নিবে!! এদের কাছ থেকে আমরা “শিলা কি জাওয়ানি” বা “ইউ ফাইন্ড মি ইন দা ক্লাব!” ছাড়া আর কি আশা করতে পারি!!
আমাদের শহর কি পেরেছে এই বাচ্চাগুলোকে বিকেল খেলার মাঠ দিতে, আমরা কি এমন কিছু অনুষ্ঠান তৈরী করতে পেরেছি যেগুলো আসলেই এই বস্তাপচা হিন্দী সিরিয়ালগুলোর সাথে পাল্লা দিতে পারবে, আমাদের চলচিত্র শিল্পকে আমরা এখনো এমন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারিনি যেখানে একজন শাহরুখ খান বা সালমান খানের মতো ষ্টার তৈরী হবে!! আমাদের কিশোরদেরতো এখন ফেসবুক ছাড়া সময় কাটানোর মতো তেমন কোনো উপকরণ নাই যেগুলা ফেসবুকের রিপ্লেসমেন্ট হবে!! তাহলে আমাদের বাচ্চারা এই গ্লোবালাইজেশনের যুগে এইভাবেই গ্লোবালাইজড হবে এইটাই স্বাভাবিক!! আজ আমরা যদি এই জিনিসগুলোর বিকল্প তৈরী করে দিতে পারতাম এবং তারপরেও আমাদের ছেলে-মেয়েরা এই অপসংস্কৃতিগুলোকে গ্রহন করতো তাহলে আমরা বলতে পারতাম যে এরা আসলেই ইচড়ে পাকা হইছে, আসলেই বেয়াদব হইছে!!! আমরাতো পারিনাই, আর পারিনাই বলেই এই আগ্রাসন সহ্য করতে হবে, উপায় নাই!! বাংলালিংক’তো কয়েক বছর আগেই আমাদের সেই নির্মম সত্যটা বলে দিয়েছে: “দিন বদলাইছে না! সেই দিন কি আর আছে!!!” না নাই, আসলেই আর নাই; কথাটা শুনতে খুব খারাপ লাগলেও এইটাই সত্যি, খুব নির্মম সত্য!!
আমাদের শিক্ষিত বাবা-মা’রা না জেনেই তাদের সন্তানদের শৈশব-কৈশবকে নষ্ট করে দিচ্ছেন। বেশি ভালো করতে যেয়ে, বেশি ভালো রাখতে যেয়ে আমরা আমাদের সন্তানদের যে ক্ষতি করছি, তার ফল এরা সারা জীবন বয়ে বেড়াবে, যে বইয়ের বোঝা ওদের কাধে চাপছে ৪/৫ বছর বয়স থেকে, সেই বোঝা বাকি জীবন তারা বহন করবে!! একটা সুন্দর শৈশব-কৈশরের হাহাকার এদের সারাজীবনই থাকবে, থাকতেই হবে!! বৃষ্টি ভেজা মাঠে ফুটবল খেলার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হওয়ার দুঃখ এদের সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে!! গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে যাওয়ার জন্য বাসে-ট্রেনে কষ্ট করে যাওয়ার আনন্দও এরা পাবে না কোনদিন!!!
এই লেখাটি যখন লিখতে বসেছিলাম তখন মনে হয় নাই এতো কিছু লিখবো!! আসলে মনটা খুবই খারাপ হইছে একটা ঘটনায়!! কাল সন্ধ্যায় বাসায় আসার পথে প্রাইভেট কারের জানালা দিয়ে ছোট্ট একটা বাচ্চা আমাকে হাত নেড়ে দেখালো, প্রত্যুত্তরে আমিও হাত দেখালাম! বাচ্চাটার মা সাথে সাথে গাড়ির জানালাটা বন্ধ করে দিলো!! খালি বাচ্চার পাশের জানালাটা না, ড্রাইভারের জানালাও বন্ধ করা হলো!! এইটা এক ধরনের অপমান হলেও আমার কাছে সেটা খুব বেশি লাগে নাই। আপনার গাড়ি আছে, আপনি জানালা ইচ্ছামতো খুলবেন, ইচ্ছামতো লাগাবেন, আমার কি!! কিন্তু এইভাবে আমরা যে আমাদের বাচ্চাদের শৈশব-কৈশরের সহজাত উচ্ছলতাগুলো নিজের হাতে নষ্ট করে দিচ্ছি, তা কি আপনারা জানেন!!
এদের শৈশব-কৈশরের সাবলীলতা হয়তো এই যান্ত্রিক শহরে আর সম্ভব না কিন্তু এই বাচ্চাগুলোকে দয়া করে একটু স্বাভাবিক হয়ে বাচতে দিন!! ওদের একটু স্বাভাবিক হতে দেন, বেশি ভালো করতে যেয়ে শেষ পর্যন্ত যা হবে তাহলো বাচ্চাটা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে বড় হবে!!
জগতের সকল প্রাণি সুখী হউক