গতকাল মিয়া পাড়ায় উগ্র হিন্দুরা হামলা করেছে। শিশু কিশোরী বৃদ্ধা কাউকে ছাড়েনি ওরা। ভয়াবহ ধর্ষণ আর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে ওরা। এমনটি ঘটতে পারে আভাস পেয়েছিল মিয়া পাড়ার মুসলমানেরা। তাই তারা পালাক্রমে রাতে পাহারা দিত। মেয়েরা সবসময় সাথে রাখত মরিচের গুড়া, কাঁচ মিশ্রিত বালির পুটলি। কিন্তু ওরা এসেছিল ভয়ানক এক জলোচ্ছাসের রূপ নিয়ে। সবকিছু যেন তছনছ করে দিয়ে গেছে। পৃথিবীর সভ্যতার অগ্রগতিকে একেবারে মিশিয়ে দিয়েছে মাটির সাথে। কী এমন হল যে মালো পাড়া আর মিয়া পাড়ার হাজার বছরের সম্প্রীতির সম্পর্ক এক ঝটকায় বদলে গেল? নব্য যুবক আবির বিষয়টি খুব একটা বুঝে উঠতে পারেনি। মালো পাড়ার পরান ছিল তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। সকাল হলে শুরু হত তাদের এক সাথে পথ চলা। মালো পাড়া আর মিয়া পাড়া থেকে ওরা এসে একসাথে রাজারামপুরের প্রধান রাস্তায় উঠত। অতপর স্কুল চুরি, আম চুরি, সাঁতার কাটা, ফুটবল খেলাÑ সব চলত একসাথে। সেই বন্ধু কী করে একদিনের ব্যবধানে ভয়ানক শত্রুতে পরিণত হল? এসবের হিসেব মিলাতে পারে না আবিরের সরল মন।
আজ আবির রামদা হাতে মিয়া পাড়ার মিছিলের সাথে মালো পাড়ায় এসেছে। আঁধার রাতে অসংখ্য মশালের আলো কাঁপছে, ওরা হিংসার লালচে উত্তাপ নিয়ে দৌঁড়ে চলেছে সামনে, মালো পাড়ার দিকে। ওখানে অসংখ্য হিন্দু পরিবারের বাস। হই হই, রই রই। কেন যাচ্ছে তারা জানে, কিন্তু পরিণামে কী পাবে তারা? তা তারা জানে না। আঁধারে কাউকে চেনার উপায় নেই। শুধু দৌঁড়াচ্ছে তো দৌঁড়াচ্ছে। আজ সবাই মানুষ শিকারী। তাদের হাতের অস্ত্রগুলো লাল মানবীয় রঙে অমানবিকভাবে রঞ্জিত হচ্ছে। মালো পাড়ার হিন্দুদের আক্রমণে আবির তার মা বাবা, একমাত্র আদরের বোনকে হারিয়েছে। কেন মারল তারা? ওরা তো ক’দিনের মধ্যে এ দেশ ত্যাগ করে নতুন দেশ পাকিস্তানে চলে যেতে। কেন তাকে ওরা আপন হারা করে দিল? আজ তার হাতের রক্তাক্ত রামদা এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলেছে। তার রামদা আজ বেশ কয়েকবার রক্তাক্ত হয়েছে। কিন্তু কতবার তার হিসেব রাখার প্রয়োজনীয়তা সে অনুভব করেনি। মশালের নিচে মানুষের ছায়াগুলোকে ঠিক রূপকথার দৈত্যদের মত মনে হচ্ছে। আমাদের নায়ক দিকবিদিক ছুটতে থাকে ক্ষুধার্ত সিংহের তম। ছুটতে ছুটতে হঠাৎ কখন যে সে সুবর্ণ নদীর তীরে এসে পড়েছে খেয়ালই করেনি। নদীর তীর একেবারে শান্ত। জনমানুষের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। দূরের লোকালয় থেকে মানুষের কান্না আর আগুনের নৃত্য এখান থেকেও দেখা যাচ্ছে। আকাশ থমথমে। মাঝে মাঝে বিজলির আলোয় আকাশ চৌচির হয়ে যাচ্ছে। নদীর জল হঠাৎ হঠাৎ রুপালি আলোয় ভরে উঠছে। আমাদের নায়ক লক্ষ করল দূরে নদীর ধারে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাতের অস্পষ্ট আলোয় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে মেয়েটির শ্বাস ফুলে ফুলে উঠছে ভীষণ জোরে। যেন ওর নদীর বুকে জোয়ার ভাটা চলছে। কী অপরূপ সে দৃশ্য! খোলাচুলগুলো মেয়েটির ঝড়ো হাওয়ায় উড়ছিল মেঘের মত। মেয়েটির চোখ দেখা যাচ্ছিল না কিন্তু বোঝাযাচ্ছিল মেয়েটি একদৃষ্টিতে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে। সে কোনো অজানা আকর্ষণে মেয়েটির দিকে এগিয়ে যায়। মেয়েটি এবার চঞ্চল হয়ে ওঠে। নায়কের শরীরে এক ভাললাগার ফালগু হাওয়া বয়ে যায়। সমস্ত রাগ ক্ষোভ প্রতিহিংসা এক নিমেষে যেন হারিয়ে যায়। হঠাৎ আকাশ জুড়ে আলোর ছটা ঝলমল করে উঠে মেয়েটিকে সম্পূর্ণ মূর্ত করে তোলে। কী অপরূপ সে নারীর মোহময় রূপ। একটি মাত্র ঝলক সেই ঝলকেই নায়কের মন সুন্দরের আনন্দে ডুব সাঁতার দিয়ে ওঠে। বৃষ্টি নামে অঝোরে ঝির ঝির ছন্দে। ময়ূর এবার নেচে উঠবে ময়ূরীকে মুগ্ধ করায়। প্রকৃতির এই তো নিয়ম। কিন্তু চোখের পলকে একটি ঘটনা ঘটে যায়, মেয়েটি ঝাঁপ দেয় সুবর্ণ নদীর বুকে। বর্ষার জলের প্রবল স্রোত মেয়েটিকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে দূর কোনো দেশে। কোনো অলক্ষ্যে। আমাদের নায়কের হাত থেকে রামদাটা খসে পড়ে। সে হাটুর উপর ভর করে বসে মাটির উপরে। বৃষ্টির জলের ছটা তার চোখ ভিজিয়ে দিচ্ছিল।