২১।০৬।২০১৪
তিন দিনের টানা বৃষ্টি।
আজ সকালে বিরক্তই হচ্ছিলাম। ডর্মিটরি থেকে ডিপার্টমেন্ট যেতে আধাঘন্টা লাগলো যেখানে অন্যদিনগুলোয় হেঁটে যেতেই মাত্র পাঁচ মিনিট লাগে। রাস্তায় নামলাম আর বৃষ্টির বেগ বেড়ে গেলো। বোরিং। পানি জমেছে। বৃষ্টি ভালোবাসি বলেই বোধয় জমা পানিতে পা ডুবিয়ে হাঁটছিলাম। ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ উঠে, কি যে চমৎকার! কাপড়-চোপড় নিচে অর্ধেক ভিজে গেলো আর উপরের অর্ধেকের অর্ধেক ভিজলো ছাতার টুপটাপ পানিতে।
একটা বাচ্চা মেয়ে আম্মুর হাত ধরে স্কুলে আসছিলো। সে আমায় যখন ক্রস করছিলো, দেখলাম তার মুখে রাজ্যের বিস্ময় আর অপূর্ণতা, বিশেষ করে আমায় দেখার পর। ওর আম্মুকে জোরাজুরি করছিলো জমা পানিতে হাঁটতে চেয়ে।
ওর আম্মু আর আমি এবার চোখাচোখি চেয়ে হেসে ফেললাম।
এই ক্যাম্পাসে প্রচুর ব্যাঙ। বাচ্চা ব্যাঙ। সারাদিন লাফায়। কখন কার পায়ের নিচে চাপা পড়ে। একটু পর পর রাস্তায় দেখা যায় পিষ্ট ব্যাঙ, সাদা হয়ে পলিথিনের মতো স্বচ্ছ হয়ে পিচের সাথে লেপ্টে আছে। আমি ভেবেই পাইনা এই বয়সী ব্যাঙদের কি হাড়-টাড় কিছু থাকে না? এতো জলদি মিশে যায় কিভাবে!
ক্যাম্পাসের সব তরুণ ব্যাঙ যদি হ্যামেলিনের ইঁদুরদের মতো একসাথে রাস্তায় এসে লাফিয়ে লাফিয়ে লংমার্চ করে দেখতে কেমন লাগবে?
বৃষ্টির ফোঁটাগুলোকে আজ সত্যিই ব্যাঙয়ের মতো মনে হলো। বিশ্রাম নেয়ার বালাই নেই। আকাশ থেকে নেমেই পড়িমড়ি হয়ে দে ছুট! তাও আবার লাফিয়ে লাফিয়ে। হাজার খানেক, নাকি কোটি কোটি ফোঁটা, একসাথে নেমে একই দিকে লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে, কি যে অদ্ভুত আর অসাধারণ দৃশ্য!
feeling Life is Beautiful.
***
২০।০৬।২০১৪
শুক্রবার হলে কি হবে, ছুটি নাই।
এই ক্যাম্পাসের সাপ্তাহিক ছুটি রবিবার। নামাজ ব্রেক দেয়, সেই ফাঁকে আমরা সবাই ডর্মিটরিতে এসে কাজ সেরে আবার অফিস যাই আউট ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে।
আমি আর রুমা আপু (কলিগ) যাই। বৃষ্টির দিন হলে দুজনের দুই ছাতায় ঠোকাঠুকি হয়ে "তুমি আমার ছাতার মধ্যে ছাতা ঢুকাও ক্যান?" আর "আপনার ছাতা আপনি আরও উঁচুতে ধরেন" বলতে বলতেই সময়টুকু চলে যায়।
আটচল্লিশ ঘন্টার টানা বৃষ্টিতে ঠোকাঠুকি থামিয়ে আপু আজ বলল, "দ্যাখো দ্যাখো লোকগুলো কি সুন্দর দৌড়ে পালাচ্ছে!"
লোকগুলো আম বিক্রেতা, আমাদের ক্যাম্পাসের আম কিনে আমাদের কাছেই বেচে, কলেজ বিল্ডিঙের কাছে ফুটপাতে বসে থাকে। হঠাৎ অনেক জোরে বৃষ্টি নামায় তারা দৌড় দিয়েছে, ছাতা-পলিথিন কিছুই নেয়নি আজ।
আমার মনে পড়লো আরেকজনের কথা।
আমি তখন দিনাজপুরে, আমার নিজের ক্যাম্পাসে। বাজারে, কিছু একটা সারাতে এসেছি। হঠাৎ বৃষ্টি নামলো। রাস্তার সব মানুষ তাড়াহুড়ো করে রাস্তার দুপাশের দোকানগুলোয় আশ্রয় নিচ্ছে। এর মাঝে একজন দেখলাম নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে খালিপায়ে বুক সোজা রেখে মাথা উঁচু করে স্বগৌরবে কাকভেজা হয়ে রাস্তার একদম মাঝখান দিয়ে হেঁটে চলে গেলো।
সেদিন সেই মানুষটার থেকে চোখ ফেরাতে পারিনি। খুব ইচ্ছে করে তার মতো একদিন হাঁটতে। শুধু মনে হয় যেদিন তার মতো করে নির্লিপ্ততায় বিলীন হতে পারবো সেদিন বৃষ্টির পানি আমার হৃদয়ে পৌঁছে সব গ্লানি ধুয়ে নিয়ে যাবে।
আফসোস! বাংলাদেশের একলা মেয়েদের এতো ইচ্ছে হতে নেই।
অফিস টাইম শেষ।
রুমে ফিরে প্রিয় ইন্সট্রুমেন্টাল শুনছি। একটু পর কফি বানাবো। কি যে হাল! এই একটাই চব্বিশ ঘন্টা শুনি গত তেরো দিন ধরে। কঠিন প্রেমে পড়েছি! একটা নদীর। প্রমত্তা যমুনা তার তুলনায় কিছুই না।
***
১৯।০৬।২০১৪
বসে আছি বোকার মতো।
দরজা লাগিয়ে ডিপার্টমেন্টে নিজের রুমটায় বসে আছি। মেঘ ডাকছে বাইরে, শুনতে পাচ্ছি। আজ আর বারান্দায় বের হবো না। রোজ কিছু না কিছু করে ফেলি, স্টুডেন্টরা যায়-আসে, বিব্রতকর অবস্থা হয়, মাঝে মাঝেই লজ্জা পাই ওদের সামনে।
তাও বের হলাম ঘন্টা খানিক পর। দেখি যে আমার ইন্টিমেট দুই মেয়ে কলিগও বৃষ্টি বিলাসে ব্যস্ত। গল্প জুড়লাম।
আমাদের কলেজ বিল্ডিঙের সেন্ট্রালি ফাঁকা। একদম মাঝে একটা কাঠগোলাপের গাছ। সারা গাছে সাদা সাদা ফুল। মাঝে সুন্দর করে হলুদ। অন্যসময় বিশেষ চোখে পড়ে না। মেঘলা দিনে অথবা বৃষ্টির পর সবকিছু যখন মলিন লাগে আর সবুজগুলো সতেজ হয়, এই পাজি ফুলগুলো মনে হয় আরো বড় বড় করে তাকায়, পাতার জানালার ফাঁক দিয়ে একদম বের হয়ে আসার মতো ভাব।
প্রিয় কবিতা "পল্লীবর্ষা"র কথা মনে পড়ছিলো কদিন-
"আজিকার রোদ ঘুমায়ে পড়িছে ঘোলাটে মেঘের আড়ে
কেয়া-বন-পথে স্বপন বুনিছে ছল ছল জলধারে।
কাহার ঝিয়ারি কদম্ব-শাখে নিঝ্ঝুম নিরালায়,
ছোট ছোট রেণু খুলিয়া দেখিছে অস্ফুট কলিকায়!
বাদলের জলে নাহিয়া সে-মেয়ে হেসে কুটি কুটি হয়,
সে হাসি তাহার অধর নিঙাড়ি লুটাইছে বনময়।"
কদম দেখিনি এই ক্যাম্পাসে। আমার নিজের ক্যাম্পাসে ছিলো, বৈশাখ মাসে(!) কদম পড়ে থাকতো। এখানে কাঠগোলাপ আর টগর দেখি। খুব সুন্দর! সবার অবস্থাই কবিতার কদম মেয়ের মতো। হঠাৎ প্রবল সাদা চোখে লাগে।
ইদানিং ভালো বৃষ্টি হচ্ছে।
কাল দুঘন্টা হয়ে থামলো সকালে। নাস্তা করতে নিচে যাচ্ছিলাম আমি আর তিথি (কলিগ+রুমমেট), মজার দৃশ্য দেখলাম জানালায়, পাশের গ্রামের। একটা নাড়ুমাথা পিচ্চি আরএফএল-এর চেয়ারে বসে আছে, তার পাশের আরেকটা নাড়ুমাথা পিচ্চি আগের পিচ্চির চেয়ারকে দোলানোর চেষ্টা করে। মাটিতে থাকা জিনিস কি তাই দোল খায়! পিচ্চি গেলো পড়ে, ভেজা বালির উপর। উঠে বসলো আবার চেয়ারে, আবার ধাক্কা। এবার আর পড়েনি, চেয়ার আঁকড়ে লেগে বসেছে, কত ধাক্কা দিবি আমি আর নামছি না! ধাক্কার পর ধাক্কা, পিচ্চি আর পড়ে না।
আমারা বুঝলাম, দ্বিতীয় পিচ্চির মোটিভ খারাপ, সে দোল দিচ্ছে না, প্রথম পিচ্চিকে ফেলে দিয়ে ওই চেয়ারে সে বসতে চায়। অথবা প্রথম পিচ্চিই পচা, চেয়ারে একা একা বসতে চায়, আরেকজনকে ভাগ দিবে না।
যাহোক, হাসতে হাসতে আমরা নেমে এলাম।
Life's good

***
--------------------------------------------------------------------
পছন্দের ইন্সট্রুমেন্টালঃ All Because of You - Slow Emotional Rap/RnB Instrumental
কাঠগোলাপ
টগর
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুন, ২০১৪ রাত ১:৩২