মুমূর্ষু অবস্থায় সে শুয়ে আছে।
কষ্ট। খুব কষ্ট।
জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছ?
কিছু বলল না। এক হাত দিয়ে আমায় ধরে স্থির হতে চাইল। পারল না। ঝুলে পড়তে চাইল। তাই আবার আমার থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে শুইয়ে দিলাম।
ও আমার খুব প্রিয়, সবচেয়ে প্রিয় ছিল।
সবসময় সাথে রাখতাম। ওকে ছাড়া চলতে পারতাম না।
এখন রেখে এসেছি ঘরের এক কোণায়। আর দেখা হয় না।
আমাদের দেখা হয়েছিল নিউমার্কেটে।
দু'বছর আগের কথা।
সে ছিল ওখানেই। আর আমি গিয়েছিলাম ওকেই দেখতে।
ম্যাজেন্ডা রঙে, সাদা-কালো জিগজ্যাগ ডোরাকাটায় বড় মানায় ওকে।
মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম!
তারপরই তো বাসায় নিয়ে আসা।
তারপর থেকেই একসাথে থাকা।
রোজ একসাথে ঘুম থেকে ওঠা, একসাথে বেসিনে, ব্রেকফাস্ট, অফিস, লাঞ্চ, পড়ার টেবিল, টিভি, নিউজপেপার, আবার ঘুম... এভাবেই চলে যাচ্ছিল। আমি যা-ই করতাম, ও কিছু না করলেও আমার সাথে থাকত। কখনো কাছ ছাড়া হইনি দুজন।
আসলে আমি কিছুই করতাম না। ও সব করত। ও আগে দেখত। তারপওর আমি। আমাকে দেখাত। আমি যেন অসহায়, অন্ধ ওকে ছাড়া।
বই পড়ার পাগল আমি। বাজারে গেলেই অসংখ্য বই কিনে আনি। সবাই বলে তুমি এতো কিছু খুঁজে পাও কিভাবে! আমি হাসি। আমি কিছুই করিনা তাও সব আমার গুণগান। আমি কিছু খুঁজে পাইনা। প্রথমে ও খোঁজে, তারপর আমায় দেখায়। আগে ও পড়ে, তারপর আমি।
প্রত্যেকটা লাইন পড়েছি আমরা একসাথে। আগে ও, আমি তারপর।
এভাবেই সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলাম, কবে কিভাবে বুঝতেও পারিনি।
এইতো সেদিন, দুজনে মিলে বড় আপার বাসায় গেলাম। আপা খুব সাধল তাই রাতে থেকেও গেলাম।
সকালে আর খুঁজে পাচ্ছিলাম না ওকে। পাগল হয়ে গিয়েছিলাম সেদিন। আপা জানাল যে ও পড়ে গিয়েছিল। কে বা কারা না উঠিয়ে উল্টা ওর উপর দিয়েই চলে গেছে। এক হাত ভেঙেছে। সেই কে বা কারা নাকি পরে ফিরে এসেছিল, নিজেরাই চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু কিছু হয়নি।
হন্যে হয়ে ঘুরতে হয়েছিল সেদিন।
কতজনের কাছে সাহায্য চেয়েছি, কিছু পাইনি।
আপাও কিছু করতে পারল না।
শেষ পর্যন্ত নিজেই ওর হাত জোড়া লাগাতে বসলাম। একবার মনে হল পেরেছি। উল্লাসে ফেটে পড়েছিলাম ক্ষণিকের জন্য।
কিন্ত হল না। কিছু হল না।
হাতটা খুলে এলো, আর কোনোভাবেই ঠিক করা গেল না।
তবু ওকে কাছ ছাড়া করলাম না।
বয়ে বেড়ালাম।
এক হাতে আমায় ধরে রাখতে পারে না। পড়ে যেতে চায়, তবুও সাথে নিয়ে বেড়ালাম।
একদিন মনে হল, না এভাবে প্রিয় ওকে কষ্ট দেয়ার মানে হয় না। বারবার মনে করিয়ে দেয়ার মানে হয় না যে ও আর আগের মতো আমায় জড়িয়ে রাখতে পারে না।
তাই একদিন ঘরের কোণায় ফেলে কিছু না বলে চলে এলাম।
হয়তো অবহেলায়, হয়তো অযত্নে।
অমর সে, মরে যাবে না জানি। কিন্তু নিখোঁজ হয়েছে কিনা সে খবরটাও রাখি না।
এখন অন্য একজন দুহাতে জড়িয়ে রাখে আমায়, সবকিছু দেখায়।
কিন্তু আগের ওকে আমি ভুলতে পারি না।
তার খুলে যাওয়া হাতখানি সযত্নে সাথে নিয়ে ঘুরে বেড়াই।
এখনো।
এ হচ্ছে আমার প্রিয় চশমা আর আমার বিচ্ছেদের গল্প।
উৎসর্গঃ শুঁটকি মাছ
(তার চশমা বৃত্তান্ত পড়ে প্লটটা মাথায় এসেছিল।)
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে এপ্রিল, ২০১৪ ভোর ৪:৪০