দিন কয়েক আগে একজন আত্মীয়ের বাসায় যাবার দুর্ভাগ্য হয়েছিলো টাকা-পয়সার ব্যাপারে।
ভদ্রলোক আমার বিয়াল্লিশ বছর বয়স্ক খালাতো ভাইয়ের মোটামুটি সত্তর বছর বয়সের শ্বশুর। সম্প্রতি ভাইয়ের শাশুড়ি মারা গিয়েছেন এবং শ্বশুর ভদ্রলোক চল্লিশ দিন পার না হতেই ছোট শালীকে বিয়ে করেছেন। শালী (বর্তমান স্ত্রী) আগের স্বামীকে তালাক দিয়ে এখানে চলে এসেছেন।
যা হোক, বাড়িতে ঢুকতেই দেখি উনারা তরুণ নবদম্পতির মতো বেডরুম থেকে বেরুলেন। আমার তো হাসতে হাসতে ওখানেই প্রাণ যায়, কোনমতে হাসি চেপে রাখলাম।
টাকা-পয়সার মামলা শেষ করে উনি বড় ছেলের বউকে পাঠালেন কাগজ-কলম আনতে, উনার নাকি কীসব অসুখ হইছে প্রেসক্রিপশন করে দিতে হবে।

ভালো করে চেয়ে দেখি ফুরফুরে মেজাজের সদ্য বিবাহিত বৃদ্ধ, তাগড়া ফিগার, রোগহীন।

প্রথম স্ত্রীর সাথে চুপচাপ দেখছিলাম, এখন খালি হাসে। সারাদিন খুশি খুশি। আগে কালো কুচকুচে ছিলো, এখন ফর্সা হইছে দেখি!!

এত খুশি নতুন বউয়ে নাকি নতুন নাতনী হইছে তাই নাকি আসন্ন ঈদের জন্যে তার পোস্টমর্টেমে গেলাম না।

কিছু একটা বলা লাগে, জিজ্ঞেস করলাম কি হইছে আপনার?
- আমার ওজন তিরাশি কেজি।
- আচ্ছা। আপনার ওজন ঠিকঠাক আছে।
- না!

- কি কি খাইলেন রোজায়?
- সেহরিতে এই ইকটু ভাত, আর ইফতারে শুধু দুই গ্লাস পানি।
- ও।
ভাবলাম খানিক হাইপোথাইরয়ডিজমের দিকে নিয়ে যাই।

- ঠান্ডা-গরম কোনোটা ভালো লাগছে ইদানিং?
- উফফ যা গরম!

- ঠান্ডা না গরম কোন আবহাওয়া ভাল্লাগে?
- ঠাণ্ডাটাই ভালো।
- (আমি উৎসাহিত হয়ে) এখন না আগে থেকেই?
- নাহ মা, ছোটকাল থেকেই।

- ঘুম কেমন হয়?
- ভালো না।
- কেমন ভালো না?
- এই একটু একটু কম ঘুম হয়। হাতুড়ে ডাক্তার(!) দেখাইছিলাম, সে বলেছে ঘুমের ওষুধ না খেতে, এমনিই ঠিক হয়ে যাবে, সেইজন্য আর ওষুধ খাই না।
- কবে থেকে একটু একটু ঘুম ভালো হয় না?
- এইতো অনেকদিন আগের কথা, এখন কোনো সমস্যা নাই।
(মেজাজ গেলো খারাপ হয়ে।

- পেটের কোনো সমস্যা হচ্ছে, এই যেমন কষা অথবা ডায়রিয়া?
- না কষা না নরমও না। কম মনে হচ্ছে।
- আগের চেয়ে পরিমাণে কম?
- হ্যাঁ

- ও মনে হচ্ছে, আপনি কনফার্ম না?
- ইয়ে মানে...

(আরও মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো।)
- বলো তো মা, কি করি?
আমি বললাম, আপনার কোনো সমস্যা নাই তাও ভালো ফিজিসিয়ান ধরে বইলেন ওজন বাড়ার কথা।
- আর কোনো প্রব্লেম?
- (অনেকক্ষণ চিন্তা করার পর) ... আমার পেটে গুটি হইছে।

- কোথায়?
- (হন্তদন্ত হয়ে শার্ট উঠিয়ে দেখালেন) ... এইযে।
আমি দেখলাম ইঙ্গুইনাল রিজিনের একটু উপরে একটা গুটি, সম্ভবত কোনো লিম্ফ নোড। উনি এবার শার্ট আরও উপরে উঠায়ে বললেন তার বুকেও এইপাশে ওইপাশে মাঝখানে এরকম গুটি আছে। এবার জানতে চাইলাম কবে থেকে এমন?
- ছোটকাল থেকে। তোমার ভাবীরও (উনার মেয়ে, ভাইয়ের বউ) আছে।

- কি করি মা বলো তো?
- ভালো ফিজিসিয়ান ধরে বলেন ওজন বেড়ে যাচ্ছে আর ছোটকাল থেকে গুটি।

(আরও কিছুক্ষণ পর)
-

- কি?
- আমার লো প্রেশার।

- কত?
- হাতুড়ে ডাক্তার(!) দিয়ে মাপাইছিলাম, ৮৫/১২০।
- এইটা ১২০/৮৫ হবে। এইটা স্বাভাবিক প্রেশার।
- না এইটা লো প্রেশার। আমার যা বয়স, এখন ৯০-৯৫ হওয়া উচিত।
- ৯০-৯৫ হওয়া উচিত না, এটাই ঠিক আছে।
- না ঠিক নাই, আগেও আমার লো ছিলো, অফিসে মাঝে মাঝে আমায় বাতাস করতো, ৭০-৭৫।
- (হেসে গড়ায় পড়তিছি মনে মনে

- না এইটা নরমাল না।
মেজাজ পুরাই খারাপ হয়ে গেছে ততক্ষণে

- নাহ কোনদিন হয়নি।
- তাহলে লো বলছেন কেন?
- না, এইটা লো প্রেশার।
- কি করি মা বলো তো?
- কিছু লাগবে না। আপনার কোনো অসুখ নাই।
(বেজার চেহারা)
তাই পুরানো কথা রিপিট করলাম, ভালো ফিজিসিয়ান ধরে বলবেন ওজন বাড়ছে, গুটি হইছে।
- প্রেশার? উনি রোগ ধরে দিবে?

আমি বললাম, ভালো ফিজিসিয়ানও বলবে আপনার কোনো অসুখ নাই।
......
- আমার আরেকটা সমস্যা হচ্ছে ইদানিং।
- কি?
- আগে জগিং করতাম। এখন রাস্তার এইমাথা থেকে ওইমাথা না যেতেই হাঁসফাঁস লাগে।
(এতক্ষণে খানিক কাজের কথা বললেন বলেই ভাবলাম।

বললাম টায়ার্ড লাগে, শ্বাস নিতে কষ্ট কষ্ট লাগে? আগে শ্বাসকষ্টের সমস্যা ছিলো নাকি? বুকে ব্যাথা মনে হয় মাঝে মাঝে? রক্তচাপ তো সবসময়ই স্বাভাবিক।
- না। আমি সব চেকআপ করাইছি, সব নরমাল। ওসব কিছু নাই আমার।
- তাহলে কেমন লাগে?
- গলার কাছে কেমন কেমন লাগে।

- কি করি মা বলো তো?
- কিছু করার নাই।
- আমার যে শরীর খারাপ লাগে?

- বড় ডাক্তার দেখান, তিনটা কমপ্লেন করবেনঃ
১। ওজন বাড়ছে
২। গুটি
৩। দৌড়ালে হাঁসফাঁস লাগছে
- আমার মনে হচ্ছে অনেক বড় অসুখ হইছে। প্রেসক্রিপশন করে দাও।
প্যাড-কলম আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। সুন্দর করে কলমের খাপ লাগিয়ে প্যাড বন্ধ করে একটা কথা বললাম। নিজেরও হাসি পাচ্ছিলো, সাথে থাকা ছোটবোন তো হাসতে হাসতে একরকম গড়ায় পড়ে।



- খালু, নিজেকে নিয়ে এত চিন্তা-ভাবনা বন্ধ করেন, আপনার সব সমস্যা ভালো হয়ে যাবে একদিনেই।
উনি এবার হাসি হাসি মুখে লজ্জা পেলেন।

(মনে মনে ভাবলাম, হ্যাঁ ভাববেই তো, বিয়ে করে যুবক হয়ে গেছে না! ভালো স্বাস্থ্য, কলপ দেয়া চুল, সারাদিন হাসি হাসি মন... সাথে পান খেয়ে ঠোঁট লাল করা চল্লিশের কমবয়সী নতুন বউ ও সাবেক শালী। ভাববেই তো!)
#
কথাটা বলেই তরুণ(!) বৃদ্ধকে আর সুযোগ না দিয়ে দু'বোন বেরিয়ে এলাম। পারলে মেঝেতে গড়াগড়ি যেতাম হাসতে হাসতে। স্থান-কাল-পাত্র আমাদের তা থেকে বঞ্চিত করলো। এ দুঃখ কোথায় রাখি!!!




সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ১০:১৫