গত সপ্তাহ হতে চেষ্টা করছিলাম সিনেমাটা দেখবার, কিন্তু টিকেট পাচ্ছিলাম না। আজ ঢাবিতে কাজ থাকায় আজকে বলাকায় ঢূঁ দিলাম। টিকেট মিলল তবে সেকেন্ড ক্লাস। ডিসির সব টিকেট শেষ। গত সপ্তাহে সেটাও পাইনি। হলে ঢুকতে ঢুকতে দেখি সিনেমা শুরু। ছবিটা মুক্তি পাবার পর ব্লগে এবং বন্ধু মহলের আলোচনায় মোটামুটি সিনেমার প্রতি বিশেষ দৃশ্য এবং সংলাপ সম্পর্কে ধারণা হয়ে গিয়েছিল। জ্ঞানগর্ভ আলোচনা শুনতে শুনতে ভেবেছিলাম নিশ্চয়ই সমাজ উল্টা পালটা করে দেওয়া কোন মুভি ফারুকি বানিয়েছে। নিজে দেখতে গিয়ে শোনা কথার একশত আশি ডিগ্রি উল্টা চিত্র দেখে বড় হতাশই হতে হল।
সিনেমার কাহিনীটা এ রকম যে, রুবা এবং মুন্না লিভ টুগেদার স্টাইলে একসাথে থাকছে। ব্যাপারটা পরিবারে জানাজানি হলে পরে তারা মুন্নার ফ্যামিলির সাথে থাকা শুরু করে। মজার ব্যাপার, তারা বাপ মার সাথে থাকলেও তাদের বিয়ে হয়নি। সেই লিভটুগেদারই চলছিল। এর মাঝে মদ খেয়ে বন্ধুদের সাথে মারামারিতে মুন্নার হাতে একটা খুন হয়ে যায়। যাবৎজীবন কারাদন্ড শাস্তি পেয়ে মুন্না জেলে যায়। ছেলের অবিবাহিত বউকে মুন্নার বাবা আর ঘরে রাখে নি। এদিকে রুবা তার মায়ের সাথে থাকতে চায় না। কারন তার মা পুরানো প্রেমিকের হাত ধরে ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেছে। রুবার বিশ্বাস এই কারনেই তার বাবার মৃত্যু ঘটে। সে তার মাকে ঘৃণা করে। থাকার স্থান না থাকায় রুবা প্রথমে তার খালাত বোনের বাসায় উঠে, কিন্তু খালাত বোনের শাশুড়ি রুবাকে তার ঘরে দেখতে চায় না। অগ্যতা রুবার ঢাকায় বাসা এবং চাকরি খুজতে থাকে। ঢাকার অলিগলিতে ঘুরতে ঘুরতে তার বিভিন্ন পুরুষের অসৎ উদ্দেশের লক্ষ্য হতে হয়। যেখানেই যায় সেখানেই অসৎ ইঙ্গিত। নিজের বাপের বয়সীদের হতে পাওয়া এই আচরণে রুবার ঘৃণা ধরে যায়। কেউ চাকরি দিতে চায়, কেউ বাসা ভাড়া দিতে চায় কিন্তু বিনিময়ে ব্যবহার করতে চায় রুবাকে। উল্লেখ করা মত একটা জিনিস দেখলাম যে, রুবার প্রতি অন্যসব পুরুষকে আগ্রহী দেখানো হলেও, তার অফিসের বসকে কোন প্রকার ইঙ্গিত দিতে দেখানো হয় নি। অথচ, জেলে দেখা করতে গেলে মুন্না রুবাকে বলে তার বস একটা লুইচ্চা। এমনি কি রুবার দ্রুত প্রোমশনে অফিসের অন্য পুরুষ কর্মকর্তাকেও জেন্ডার ডিসক্রিমিনিশনের দায়ে বসকে দোষ দিতে দেখা যায়। কাহিনীতে এই বসকে লুল না দেখিতে হয়ত রুবার চাকরির যোগ্যতা দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
এভাবে চলতে চলতে একসময় রুবার ছোট্ট বেলার বন্ধু তপুর কথা মনে আসে। এই তপুর সাথে তার দীর্ঘ দিন যোগাযোগ নাই, এমনকি মোবাইল নম্বরটাও নাই। সিনেমায় তপু বাস্তবের তপুই। বিখ্যাত নূপুর গানের গায়ক, তার হাজার হাজার ফ্যান। যাইহোক, মোবাইল নম্বর যোগার করে রুবা তপুকে ফোন করে দেখা করতে বলে। তারা বসুন্ধরার পেছনে কাশবন টাইপের এক জায়গায় দেখা করে। রুবা তার কাছে থাকবার জায়গার জন্য সাহায্য চায়। সাথে সাথে তপু বসুন্ধরায় ফ্লাট ভাড়া করে। যেহেতু্ একা মেয়ের জন্য বাসা ভাড়া পাওয়া কঠিন তাই তপুই রুবার স্বামী পরিচয়ে বাসা ভাড়া নেয়। রুবা মুন্নার বাসা থেকে ফার্নিচার নিয়ে আসে। তপু রুবাকে বসুন্ধরায় দামী ফ্লাটের ভাড়া, অভিজাত জীবন যাপনের খরচা পাতি এবং সেই সঙ্গে মুন্নার মামলার খরচও দিতে থাকে। তাদের সাথে কথা হয় এইগুলো তপু দান করছে না, একসময় রুবা তাকে টাকা দিয়ে দিবে।
এরপর শুরু সিনেমার অন্যপর্ব। তপু-রুবা একই ফ্লাটে থাকছে, আলাদা আলাদা রুমে। রাতের বেলা প্রথমাংশের এই সব বৃদ্ধদের মতই মিলনের ইচ্ছায় তপু রুবার রুমের সামনে ঘোরা ঘুরি করে, মাঝে মাঝে দরজা নক করে। রুবা সবই বুঝে কিন্তু সরাসরি সম্মতি দেয় না। ঠিক পরের দৃশ্যে, একই উদ্দেশ্যে রুবাকেও ঘোরা ঘুরি করতে দেখা যায়। ঠিক এই মূহুর্তেই রুবার সামনে হাজির হয় তার ১৩ বছরের মন। রুবাকে তপুর প্রতি শারিরিক আকর্ষণ হতে দূরে রাখতে রুবার মনের এক অংশ সবসময় রুবার সাথে ঝগড়া করতে থাকে। এই সমস্যায় রুবা মানসিক চিকিৎসকেরও কাছে যায়। প্রথমে মাঝে মাঝেই রুবা মুন্নাকে দেখতে যেত। কিন্তু চাকরি এবং তপুর কারনে সেটা ধিরে ধিরে কমতে থাকে, একপর্যায়ে মুন্নাই আর রুবার সাথে দেখা করতে চায় নায়। তপু রুবাকে পাবার আকাঙ্খা বার বার প্রকাশ করে যায়। রুবা বোঝে এবং এটাকে সে কোন প্রকার অসৎ উদ্দেশ্য বলে মনে করে না, যেমনটা সে প্রথমের বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে মনে করত। উলটা রুবা নিজেই তপুর আহ্ববানে সাড়া না দেবার কারনে অস্বস্থি বোধ করে। এক পর্যায়ে রুবা তপুর আকাঙ্খাতে সম্মতি জানিয়ে তপুকে তার ঘরে আসতে বলে। তপু লাফাতে লাফাতে কনডম কিনে হাজির হয় রুবার ফ্লাটে। গিয়ে দেখে রুবা নাই। রুবা আবার তার ১৩ বছরের মনের প্রভাবে তপুর কাছে নিজেকে সমর্পনে অসম্মতি জানায়। তপু মহা বিরক্ত হয়।
ঠিক এই মূহুর্তেই কিভাবে যেন মুন্না জেল থেকে ছাড়া পায়। সে এসে উঠে রুবার ফ্লাটে। কিন্তু বুঝতে পারে এই রুবা আগের সেই রুবা নয়, সব চেঞ্জ হয়ে গেছে। রুবাও বুঝতে পারে তার মন পড়ে আছে তপুর কাছে। সেটা সে সরাসরি মুন্নাকে জানায়। মুন্নাকে সে বলে যেহেতু তাদের বিয়েই হয় নাই তাই ডিভোর্সের প্রশ্ন উঠে না। তাই তাদের আলাদা হয়ে যাওয়া উচিত। প্রথমে মুন্না জানায় সাত দিন সময় নিয়ে দেখতে যদি মত পালটায়। কিন্তু অল্প কয়দিনেই মুন্না বুঝে কোন লাভ নাই। সে রুবাকে প্রস্তাব দেয় তারা আলাদা থেকে আর কি করবে, তার চেয়ে তারা বন্ধুর মত একত্রেই থাকতে পারে। শেষ অংশে দেখা যায় রুবার তার মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ পেতে। সে চিৎকার করে বলে, মা আমি তোমাকে ভালবাসি। ভালবাসা ফিরে এসেছে যে কারনে রুবা তার মাকে ঘৃণা করত সেই দোষেই সে নিজে দোষী। সেই মূহুর্তে রুবা নিজের মায়ের কৃতকর্মের যুক্তি খুজে পায়। এককালে তার কাছে মায়ের যে কাজটিকে পিতার মৃত্যুর কারন বলে মনে হয়ে এসেছে, সেই একই কারনে তার মায়ের প্রতি ভালবাসা ফিরে আসে। এরপর তপু রুবার সাথে দেখা করতে এসে প্রস্তাব দেয় তার সাথে কক্সবাজারে ঘুরতে যাবার। রুবা বলে মুন্নাকেও নিয়ে যেতে, মুন্না রাজি হয়। তারা তিনজন কক্স বাজারে ঘুরতে যায়
...................................................সিনেমা শেষ।
এখন আসি বাকি কথায়। প্রথমেই অভিনয়। আগেই বলে নেই আমি অভিনয় বিষয়ে আলোচনার যোগ্য কেউ নই। হাজার হাজার দর্শকদের একজন, তাই আমার আলোচনায় চলচিত্রের বোদ্ধাদের আপত্তি থাকলে আমার কিছু করার নাই। রুবা চরিত্রে তিশা, মুন্না চরিত্রে মোশারফ করিম আর তপু চরিত্রে তপুই। তিশার আমি এপর্যন্ত যত অভিনয় দেখেছি তার সবটাই একই রকম বৈচিত্রহীন। অত্যন্ত রকম, বা খানিকটা বেয়াড়া মেয়ের চরিত্র। এখানেও একই ধরণের চরিত্র। মোশাররফ করিমের অভিনয় ভাল ছিল, কিন্তু সে সিনেমায় অভিনয় দেখাবার তেমন সুযোগ ছিল না। তার অভিনয় খুবই কম সময়ের জন্য। তপুর অভিনয় আমার কাছে কোন অভিনয়ই মনে হয় নাই। গায়ক হিসাবে তার পরিচিতি না থাকলে হয়ত এই অভিনয় কারো আলোচনার বিষয়ই হয়ত হত না। একমাত্র আবুল হায়াৎ লুচ্চা বুড়ার চরিত্রে খুব ভাল অভিনয় করেছে।
এই সিনেমার সবচাইতে বড় দূর্বলতা কাহানী প্রবাহ। মনে হল একটার পর একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা দেখানো হল। প্রথমে রুবা তপুর কাছে সাহায্য চাইল। তপু বাসা ম্যানেজ করতেই তারা এক ফ্লাটে থাকা শুরু করল। প্রথম রাতেই তারা শারিরিক তাড়নায় একজন আর একজনের রুমের সামনে ঘোরাঘুরি শুরু করল। তপু রুবার দেখা হওয়া, তারপর এক ফ্লাটে থাকা শুরু করা এবং প্রথম রাতেই উত্তেজিত আচরণ। তিনটা পর্বই বিচ্ছিন্ন মনে হয়েছে। মজার কথা হল, তারা একজন যে আর একজনকে শারিরিক ভাবে পেতে আগ্রহি সেটা কোন ভাবেই ফুটিয়ে তুলতে পারে নাই ফারুকি। অশ্লিলতা বাদ দিয়ে এমন অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলতে পারলেই ফারুকির যোগ্যতা প্রকাশ পেত।
ছবিতে কাহানীতে খাপছাড়া কিছু বিষয় পেলাম। যেমন মুন্না-রুবা লিভ টুগেদার করত। পরে তারা মুন্নার বাবার বাসায় থাকতে শুরু করে। মজার ব্যাপার, মুন্নার বাবার বাসায় থাকলেও তার বাবা-মা রুবা মুন্নার বিয়ে দেন নি। তার লিভ টুগেদারই করত। এই অবাস্তব ব্যাপারটার কি কোন দরকার ছিল? বাবা-মা লিভ টুগেদারকে খারাপ চোখে দেখে নিজের ঘরেই তা চালু রাখতে দিল? রুবা চাকরি আর বাসা খুজতে গিয়ে লুল বৃদ্ধদের লালসার লক্ষ্য হল। অথচ, তপুর উদ্দেশ্যও ব্যতিক্রম কিছু ছিল না। বরং, আমার কাছে সেই বুড়াদের থেকে তপু চরিত্রকে বেশি লুইচ্চা মনে হয়েছে। কারন রুবার সাথে প্রথম রাতে ফ্লাটে থাকতে এসেই সে রুবার রুমের দরজা দিয়ে উকি ঝুকি শুরু করে। পুরা ছবিতেই তপু অন্যদের মতই নানা ইঙ্গিত দিতে থাকে রুবাকে। অথচ, রুবা তার ঋণ পরিশোধের জন্য উতলা হয়ে উঠে। আরো অদ্ভুত, ঋণ পরিশোধের একমাত্র রাস্তা হিসেবে এই ছবিতে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে শারিরিক সম্পর্ককে। মুন্না ঠিকই রুবাকে ভালবেসে যায়, কিন্তু রুবা যখন জানায় যে সে আর মুন্নাকে ভালবাসে না সে অন্য কাউকে ভালবাসে তখন মুন্নার স্বাভাবিকভাবে কি করার কথা? রুবার ফ্লাট ছেড়ে দেবার কথা। অথচ, মুন্না রুবার ফ্লাটেই আলাদা থাকা শুরু করে বন্ধুর মত। সিনেমার ওয়েব সাইটে মুভি সম্পর্কে লেখা আছে, third person singular number is a thoroughly modern, stylistically assured story of a young woman.....combining an indie sensibility with subcontinental elements... Modern বলতে ফারুকি কি বুঝালেন তা ধরা গেল না। কারন, পুরুষের লিপ্সা হতে বাচবার সংগ্রামে রুবার সাহায্য নিতে হয়েছে আরেক লুলপুরুষের। তবে, শেষ অংশে মুন্নাকে ছেড়ে দেবার যে সিদ্ধান্ত রুবা নিল সেই সাহস থাকাটাকে আধুনিক বলা যেতে পারে। শেষে দেখাতে চাওয়া হয়েছে তারা তিনজন অথচ সিঙ্গুলার। কিন্তু রুবা মুন্নাকে ছাড়তে চাইল তপুর জন্য। তবে?? রুবা এদিকেও নাই ওদিকেও নাই আবার সবদিকেই আছে??? আউলা ঝাউলা সব ব্যাপার অথবা বুঝবার বুদ্ধিই আমার হয়ত নাই। তবে সিদ্ধান্তহীন ও নৈতিকতা বিবর্জিত জীবন যাপন যদি আধুনিকতা হয় তবে এই মুভি সত্যিই আধুনিক। নৈতিকতা বিবর্জিত এই কারনে যে, ছবিতে যা কিছু খারাপ হিসেবে দেখানো হল, ছবির মূল চরিত্রগুলোও একই দোষে দোষী।
ব্লগে অনেক আলোচনা পড়লাম এই সিনেমা নিয়ে। অনেকেই মনে করেন এইসব সিনেমা লিভটুগেদারকে উৎসাহ দেবে। আমার এরকম কিছু মনে হল না। এরকম অন্তসার শুন্য একট সিনেমা সমাজে প্রভাব ফেলতে পারে বলে আমার মনে হয় না। বাংলাদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের জন্য ভাল সিনেমার অভাব ছিল। কারন প্রচলিত সিনেমাগুলো নিম্ন মানের, অশ্লিলতাপূর্ণ। মাঝে কয়েকটা ছবি দেখে অনেকেই মনে করেছিলেন অশ্লিলতা না থাকলেই বুঝি ছবি ভাল হয়। আসলে অশ্লিলতা না থাকলেও একটা ছবি খারাপ হতে পারে তার উদাহরন এই থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার। এই ছবিতে কোন অশ্লিলতা আছে বলে আমার মনে হয় না, কিন্তু ছবিটা ভাল হয় নাই। মনে রাখবার মত কোন ছবি এটা নয়। মনপুরা দেখে মনে হয়েছিল, ছবিটা আহামরি না হলে দুই আড়াই ঘন্টা বসে সময় কাটাবার জন্য ভাল একটা মুভি। কিন্তু থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার দেখে মনে হল অযথাই সময় নষ্ট করলাম।