(পর্ব - ১)
গত পর্বে লিখলাম বর্তমানের সোয়াইন ইনফ্লুয়েঞ্জা নিয়ে এত ভয় পাবার কিছু নাই। এটা স্বাভাবিক সিজনাল ইনফ্লুয়েঞ্জার মতই। মৃত্যুর হারও খুবই কম। এখন কেউ বলতে পারে, ভাই কোটিতে একটা মৃত্যুর কারন হইলেই বা কি! সাবধান থাকতে তো হবে নাকি? উত্তর হবে, অবশ্যই, কিন্তু সাবধান কিভাবে থাকবেন? এই পর্বে থাকবে ফ্লুয়ের বিরুদ্ধে আমাদের সাবধানতা বিষয়ে।
যে কোন যুদ্ধে প্রথমেই প্রতিপক্ষকে চিনতে হয়, জানতে হয় তার বৈশিষ্ট্য এবং সেই হিসেবে প্রতিরোধ করতে হয়। ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসটি শ্বসনতন্ত্রে সংখ্যাবৃদ্ধি করে এবং আমাদের ফ্লু হয়। কথা হচ্ছে, ভাইরাসটি আমাদের মাঝে আসে কোথা হতে। সহজ উত্তর, “আক্রান্ত ব্যক্তি হতে”। আক্রান্ত ব্যক্তি কয়েক উপায়ে ভাইরাসটি ছড়াতে পারে। প্রথমত, যেহেতু ফ্লু হলে সর্দি হয় অতএব রোগী হাত দিয়ে তার নাক, মুখ ধরবে। তার সর্দিতে ভাইরাসটি থাকায়, সর্দি থেকে হাতে আসবে। সেই হাত দিয়ে রোগী যাই ধরবে তাতেই ভাইরাস ছড়াবে। ধরুন রোগী তার ভাইরাসবাহি হাত দিয়ে দরজা খুলল, চামচ ব্যবহার করল, কম্পিউটারের মাউস, কীবোর্ড ব্যবহার করল বা মোবাইল ব্যবহার করল। তাহলে, সেই সব বস্তু আমরা সুস্থরা ধরলে আমাদের হাতেও ভাইরাস চলে আসবে। এখন আমরা যদি আমাদের হাত নাকে দেই তবে আমাদের ইনফ্লুয়েঞ্জা আক্রান্ত হবার সম্ভবনা থেকে যাবে। দ্বিতীয়ত (সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ), ফ্লু আক্রান্ত রোগী হাচি কাশি দেবে। প্রতিবার হাঁচি দিলে আমাদের নাক, মুখ হতে প্রবল বেগে মিউকাসের ছোট ছোট কনা বেরিয়ে আসে। এর মাঝে কিছু থাকে বড় কনা, যা মধ্যাকর্ষণের ফলে মাটিতে পড়ে যায়। বাকি রয়ে যায় অনেক ছোট ছোট কনা, এই কনাগুলোকে বলে ড্রপলেট। এই ড্রপলেটগুলোর বেশির ভাগই আমরা চোখে দেখি না। ড্রপলেটের বৈশিষ্ট্য হল এগুলো উৎসস্থল হতে (আক্রান্ত ব্যক্তির নাক, মুখ) বাতাসে প্রায় ৬ ফুট (প্রায় সোয়া দুই মিটারের মত) ভেসে বেড়াতে পারে। এই মিউকাস আমাদের শ্বাসনালীর অভ্যন্তরের প্রাচীরকে ঘিরে থাকায় এগুলোতে যথেষ্ট পরিমান ভাইরাস থাকে। অর্থাৎ আক্রান্ত ব্যক্তির হাচি কাশির সময় যদি সুস্থ ব্যক্তি তার ৬/৭ মিটারের মাঝে থাকে তবে সুস্থ ব্যক্তিও আক্রান্ত হতে পারে।
এই পর্যন্ত আমরা প্রতিপক্ষের (ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের) আক্রমনের পন্থাগুলো জানলাম। এখন দেখি কি করে বাধা দেওয়া যায়। প্রথমত, এই ভাইরাসটির পৃষ্টে লিপিডের আবরণ আছে যা সাবানে নষ্ট হয়। অর্থাৎ, আক্রান্ত হলে নাকে মুখে বেশি হাত দেব না। যেহেতু, এটা প্রতিহত করা কষ্টকর, তাই প্রতিবারই চেষ্টা করব সাবান দিয়ে হাত ধুতে এবং অবশ্যই নাক, মুখ ছোয়া হাত দিয়ে দরজার নব, চামচ, মোবাইল, মাউস, কীবোর্ড এগুলো ছোব না। এটাও প্রতিহত করা কষ্টকর। তাই আমাদের বাসায় অন্যরাও বার বার হাত ধোবে সাবান দিয়ে। আর একটা কথা মনে রাখতে হবে। সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, সুইচ অন অফ করার মত বিষয় না, যে চাপ দিলে লাইট জ্বলবে আবার চাপ দিলে নিভবে। ভাইরাসকে মারতে সাবানেরও সময় লাগে। তাই প্রতিবার হাত ধোয়ার সময় অন্তত বিশ সেকেন্ড ব্যপি (২০ সেকেন্ড) সাবান হাতে দিয়ে ঘষতে হবে। তারপর প্রবাহিত পানিতে ধুয়ে ফেলতে হবে। সেই সাথে যত্রতত্র থুথু কফ ফেলাও পরিহার করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, এই ভাইরাস হাচি কাশির মাধ্যমে সৃষ্টি হওয়া ড্রপলেটের মাধ্যমে ছড়ায়। অতএব, রোগীর নাক, মুখ হতে হাচি, কাশির ফলে নির্গত ড্রপলেটকে সুস্থ ব্যক্তি পর্যন্ত পৌছতে দেওয়া যাবে না। এর জন্য রোগীর মাস্ক পড়তে পারলে ভাল হয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, কোন ধরণের মাস্ক?
বিভিন্ন ধরণের মাস্ক আছে। এগুলোর প্রকার ভেদ করা হয়, এরা কোন ধরনের নিরাপত্তা দেয় তার উপর নির্ভর করে। দুই ধরণের মাস্ক আছে, এক সার্জিকাল মাস্ক, দুই রেস্পিরেটর। সার্জিকাল মাস্ক আমাদের সবার পরিচিত, আজকাল ঢাকার রাস্তা ঘাটে পাবলিকের মুখে হালকা নীল বা সবুজ রঙের যে সব মাস্ক দেখা যায় সেগুলোই সার্জিকাল মাস্ক। এসব মাস্ক বড় বড় কনা আটকাতে সাহায্য করে। ফ্লু ভাইরাস ধারণকারী ড্রপলেটের বিরুদ্ধে কোন নিরাপত্তা দেয় না। এগুলো মূলত রক্ত বা তরল কিছু নিয়ে কাজ করবার সময় যেন ছিটকে না আসে তার জন্য ব্যবহার করা হয়। যেমন আমরা যদি কোন গ্লাস সীটের উপর হাচি দেই তাহলে অনেক মিউকাসের ফোটা দেখতে পাব। কিন্তু ঘটনা হল, এই কনা গুলো কিছুই না। প্রতিবার হাচিতে প্রায় ২০,০০০ ড্রপলেট জাতীয় ছোট ছোট মিউকাসের কনা সৃষ্টি হয় যা খালি চোখে দেখা সম্ভব নয়। এইসব ড্রপলেট আটকাবার কোন ক্ষমতাই নাই সার্জিকাল মাস্কের। সার্জিকাল মাস্ক শুধু বড় বড় কনাগুলো আটকাতে পারে। আর অদেখা এইসব ড্রপলেটের মাঝে থাকে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস। অতএব, ফ্লু প্রতিরোধে সার্জিকাল মাস্কের তেমন গুরুত্ব নাই। তবে সম্ভব হলে, রোগী এটা ব্যবহার করতে পারে। যদি মাস্কের ভেতরে হাচি কাশি দেওয়া হয় তবে, ড্রপলেটের বেগ কম হবে এবং রোগী এটা পড়ে থাকলে নাক বা মুখের দিকে হাত গেলে হাত মুখে ভাইরাস মিশ্রিত মিউকাস লাগবার সম্ভবনা কম হবে। তবে কথা হল, একবার হাচি দিলে সেই মাস্ক বেশিক্ষণ পড়ে থাকতে অনেকেরই রুচি হবে না। তাই বার বার মাস্ক পরিবর্তনের চাইতে টিস্যু ব্যবহারই শ্রেয় বলে মনে হয় আমার। যারা সুস্থ তাদের সারাদিন সার্জিকাল মাস্ক পড়ে থাকার কোন যৌক্তিকতা নাই। অহেতুক, বিরক্তিকর এবং পয়সা নষ্ট।
তবে, ফ্লুয়ের বিরুদ্ধে আপনাকে রক্ষা করতে পারদর্শী হল রেস্পিরেটর। এটাও একধরণের মাস্কই তবে এর বিশেষত্ব হল এটা আপনার নিঃশ্বাস প্রশ্বাস ফিল্টার করতে পারবে। রেস্পিরেটর ড্রপলেট গুলোকেও আটকাতে পারে। সবচাইতে বহুল ব্যবহৃত রেস্পিরেটর হল N95 রেস্পিরেটর। কিন্তু, এটা যথেষ্ট দামী এবং আসল N95 মাস্ক আপনি বাংলাদেশে সহজে পাবেন না।
এই পর্যন্ত আমরা দেখতে পাচ্ছি, N95 মাস্ক আমাদের সহজলভ্য নয় এবং সার্জিকাল মাস্কের তেমন কার্যকরিতা নেই ফ্লুয়ের বিরুদ্ধে। এখন উপায়?? উপায় আছে, আগেই বলেছি আমাদের হাচি, কাশির সাথে বের হওয়া ড্রপলেট গুলো বাতাসে উৎস হতে প্রায় ছয় ফুটের মত দূরত্বে ভেসে থাকতে পারে। তাই, সব চাইতে উপকারি প্রতিরোধ ব্যবস্থা হল রোগী হতে দূরে থাকা। আর নিজে রোগী হলে অন্যদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখা রোগ শুরু হবার পর তিন চার দিন ব্যাপি। যেসব স্থানে অনেক মানুষ একত্রে থাকে সেখানে না যাওয়া। যেমন, স্কুল, কর্মক্ষেত্রে। স্কুল এই ক্ষেত্রে একটি কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। একটি আক্রান্ত শিশু স্কুলে অন্য শিশুদের আক্রান্ত করে। সেই সব শিশুরা নিজের বাড়িতে এবং এলাকার অন্যদের আক্রান্ত করে। কর্মক্ষেত্রের ব্যাপারেও একই ব্যাপার প্রযোজ্য। তাই বলে কি ফ্লু এর প্রাদুর্ভাব হলেই স্কুল কলেজ, কাজ কর্ম ফেলে বসে থাকতে হবে? ফ্লুয় ভয়াবহ মহামারি আকারে প্রকাশ না পেলে তেমনটির দরকার নাই। কারো ফ্লুয়ের মত লক্ষণ দেখা গেলে, যদি সে স্কুলে বা কর্মক্ষেত্রে না গেলেই হল। এই ব্যাপারটা পরিবারের সদস্যদের জন্যও প্রযোজ্য। যেমন আমার বাসায় যদি কারো ফ্লু হয় তবে আমিও কর্মক্ষেত্রে যাব না বা বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাব না। ঘরে বড়রা আক্রান্তদের সেবা ও শিশুদের নিরাপত্তা দেবে।
দেশের অল্প কয়েকজনের ফ্লু হয়েছে তাই সবার কাজ কর্ম লেখাপড়া ফেলে বসে থাকাটা অযৌক্তিক। তাছাড়া আমাদের অঞ্চলে ফ্লুয়ের তেমন ভয়ংকর মহামারীর ইতিহাসও নাই। এর কারন আমাদের আবহাওয়া আদ্র। পশ্চিমা যে সব দেশ ঠান্ডা ও শুষ্ক সেখানে হাচি কাশির ফলে নির্গত ড্রপলেট গুলো সহজে শুকিয়ে যায় এবং বেশিক্ষণ বাতাসে ভাসে। অন্যদিকে আমাদের আবহাওয়ায় ড্রপলেটগুলোর শুকাতে সময় লাগে এগুলো তারাতারি মাটিতে পড়ে যায়, ভেসে বেড়ায় কম।
এই পোস্টের মদ্দা কথা হল, “সার্জিকাল মাস্ক পড়ে ঘোরাঘুরি করলেই আপনি ফ্লু হতে নিরাপদ নন। তাই যুযুর ভয়ে অহেতুক পয়সা খরচ করবেন না। পরিবারে কারো ফ্লুয়ের মত লক্ষণ দেখা গেলে তাকে বাইরে যেতে নিষেধ করুন অন্যদের স্বার্থে। আপনার কর্মক্ষেত্রে বা বাচ্চার স্কুলে কেউ আক্রান্ত হলে রোগীকে বাসায় থাকতে উৎসাহী করুন এবং কর্তৃপক্ষকেও সতর্ক করুন”।
পর্ব ৩ হবে অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ ও অ্যান্টিবায়োটিকের যাচ্ছেতাই ব্যাবহার নিয়ে।