বুদ্ধিজীবী হত্যার কথা মনে পড়লেই মাথায় আসে ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। অথচ এর শুরু হয়েছিল সেই ২৫ মার্চের কাল রাত্রীতে। বাংলা উইকিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস নিবন্ধে লিখবার সময় এ বিষয়ে অল্প বিস্তর লেখাপড়া করেছিলাম। সেটুকুই তুলে ধরার চেষ্টা করিছি আজ ১৪ ডিসেম্বর।
বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমনকারী পাকিস্তান বাহিনীতে ছিল ১৮ নং পাঞ্জাব, ২২ নং বেলুচ, এবং ৩২ নং পাঞ্জাব রেজিমেন্টের বিভিন্ন ব্যাটেলিয়ন। ২৫ মার্চের রাত্রী থেকে ২৭ মার্চ সকাল পর্যন্ত এ বিশেষ মোবাইল বাহিনী স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, ট্যাংক বিধ্বংসী বিকয়েললস রাইফেল, রকেট লাঞ্চার মার্টার ভারি ও হালকা মেশিনগানে সজ্জিত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে ফেলে। ২৫ শের কালরাত্রীতে প্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ জন শিক্ষকে হত্যা করা হয়।
*******************************
খুব সম্ভবত প্রথম আক্রমন হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩ নং নীলক্ষেত আবাসের বাড়িতে। সেখানে মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফজলুর রহমনকে তার দুই আত্মীয় সহ হত্যা করা হয়। মিসেস ফজলুর রহমান দেশে না থাকায় প্রানে বেচে যান। পাক বাহিনী অধ্যাপক আনোয়ার পাশা (বাংলা) ও অধ্যাপক রাশিদুল হাসানের (ইংরেজী) বাড়িতেও প্রবেশ করে। উভয় পরিবার খাটের নিচে লুকিয়ে ছিলেন। ঘরে ঢুকে টর্চের আলো ফেলে তাদের কাউকে না দেখে হানাদাররা চলে যায়। যাবার সময় বলতে শোনা যায়, “বাঙালি কুত্তা ভাগ গিয়া”। উভয় অধ্যাপক সে রাত্রে বেচে গেলেও, মুক্তিযুদ্ধের শেষে তারা আলবদর বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে পারেননি, বাড়ি পরিবর্তন করেও। ২৪ নং বাড়িতে থাকতেন বাংলা বিভাগের অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম (নজরুল গবেষক ও বাংলা একাডেমীর সাবেক পরিচালক)। সেই বাড়ির নিচে দুপায়ে গুলিবিদ্ধ দুই মা তাদের শিশু সন্তান নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। সিড়ি ভেসে যাচ্ছিল তাদের রক্তে। পাক পশুরা ভেবেছিল, অন্য কোন দল হয়ত অপারেশন শেষ করে গেছে তাই তারা আর ঐ বাড়িতে ঢোকেনি। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম তখন প্রানে বেচে যান। ঐ বাড়িরই নিচ তালায় থাকতেন, এক অবাঙালি অধ্যাপক। পঁচিশে মার্চের আগেই সেই ব্যক্তি কাউকে না জানিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যান। বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকার সব অবাঙালি পরিবার তাই করেছিলেন।
ফুলার রোডের ১২ নং বাড়িতে হানা দিয়ে হানাদাররা নামিয়ে নিয়ে যায় অধ্যাপক সৈয়দ আলী নকিকে (সমাজ বিজ্ঞান)। তাকে গুলি করতে গিয়েও, পরে তাকে ছেড়ে দেয় এবং উপরের তলার ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মুহম্মদ মুকতাদিরকে গুলি করে নিষ্টুর ভাবে হত্যা করে। ২৭ মার্চ অধ্যাপক মুকতাদিরের লাশ পাওয়া যায় ইকবাল হলে (বর্তমান জহুরুল হক হল), তাকে পরে প্লটনে এক আত্মীয়ের বাড়িতে দাফন করা হয়। সলিমুল্লাহ হল এবং ঢাকা হলে (বর্তমান শহীদুল্লাহ্ হল) হানা দিয়ে সলিমুল্লাহ হলের হাউস টিউটর ইংরেজীর অধ্যাপক কে এম মুনিমকে তারা প্রহার করে এবং ঢাকা হলে হত্যা করে গণিতের অধ্যাপক এ আর খান খাদিম আর অধ্যাপক শরাফত আলীকে। জগন্নাথ হলের মাঠের শেষ প্রান্তে অধ্যাপকদের বাংলোতে ঢুকে তারা অর্থনীতির অধ্যাপক মীর্জা হুদা এবং শহীদ মিনার এলাকায় ইতিহাসের অধ্যাপক মফিজুল্লাহ কবীরের বাড়িতে ঢুকে তাদের নাজেহাল করে।
জগন্নাথ হলে হামলা করার সময় আক্রান্ত হয় হলের প্রাক্তন প্রাধ্যক্ষ ড. গোবিন্দচন্দ্র দেবের বাস ভবন। পাক হানাদাররা হত্যা করে অধ্যাপক দেব এবং তার পালিত মুসলমান কন্যা রোকেয়ার স্বামীকে। পরে জগন্নাথ হল সংলগ্ন বিশ্ববিদ্যালয় স্টাফ কোয়ার্টার, সেখানে হত্যা করা হয় পরিসংখ্যানের অধ্যাপক মনিরুজ্জামান তার পুত্র ও আত্মীয়সহ। আক্রমনে মারাত্বক আহত হন জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা পরে তিনি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। বৈদ্যুতিক মিস্ত্রী চিৎবালী ও জনৈকা রাজকুমারী দেবী তথ্য প্রদান করেন যে ঢাকা মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকরা চিনতে পেরে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে মর্গের কাছে গাছের নিচে খুব অল্প পরিসরে চিরদিনের জন্য শুইয়ে রেখেছেন। অধ্যাপক মনিরুজ্জামান ও অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে পাশাপাশি দাড় করিয়ে হত্যা করা হয়। জগন্নাথ হলে আরো নিহত হন হলের সহকারী আবাসিক শিক্ষক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য।
৩৪ নং বাড়িতে অধ্যাপক মনিরুজ্জামানের ও জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার লাশের পাশে মোট পাঁচটি দেহ পড়েছিল। এরই মাঝে একজন হিন্দু অধ্যাপক কাতরাচ্ছিলেন। বেগম মনিরুজ্জামান তার মুখে চামচ দিয়ে পানি দেন। বেগম মনিরুজ্জামান পর্দানশীল মহিলা ছিলেন, কখনো অন্য পুরুষের সামনে যেতেন না। কিন্তু, মৃতপ্রায় সেই হিন্দু অধ্যাপককের মুখে পানি দিতে দ্বিধা করেননি। ঠিক সেই সময়, দেখতে পারেন তার নিজ ছেলেটি তাকাচ্ছে এখনও। মাকে দেখে তার চোখ দুটো একটু বড় হল শুধু। তারপরেই সে চোখ বন্ধ করল আর তা খোলেনি কখনো। বেগম মনিরুজ্জামান তাড়াতাড়ি এক চামচ পানি দিয়েছিলেন ছেলের মুখে; কিন্তু খেতে পারেননি। যে হিন্দু অধ্যাপক তখনও বেচেছিলেন, বেগম মনিরুজ্জামান তার ফ্লাটের কপাটে ধাক্কা দিয়ে তার স্ত্রীকে বলেন, “দিদি বের হন। আপনার সাহেবকে ঘরে নিন। আমার সাহেব মারা গেছেন। আপনার সাহেব বেঁচে আছেন”। এ তথ্য পাওয়া যায় শহীদ বুদ্ধিজীবী বাংলার অধ্যাপক আনোয়ার পাশার মার্চ থেকে ডিসেম্বর নাগাদ লেখা আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ গ্রন্থে।
অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, অধ্যাপক মনিরুজ্জামানের ছোট ভাই ড. হাসান জামান ছিলেন পাকবাহিনীর অতন্ত্য বিশ্বস্ত। বড় ভাই অধ্যাপক মনিরুজ্জামানের বেঁচে যাওয়া স্ত্রীকে তিনি আশ্রয় দেননি। বেগম মনিরুজ্ঞামান আশ্রয় নেনে নীলক্ষেত এলাকার তদানিন্তন রেজিস্ট্রারের পিএ. রবিউল আলমের বাড়িতে। অন্যদিকে পাকবাহিনীর দোসর অধ্যাপক হাসান জামান তার জহুরুল হক হল আবাস ছেড়ে ইসা খাঁ রোড এলাকায় একটি সুরক্ষিত বাসায় উঠেন। তার বাড়ির সিঁড়িতে কলাপসিবল গেইট এবং সশস্ত্র প্রহরী মোতায়েন করা হয়। এ ব্যক্তি স্বাধীনতার পর গ্রেফতার হন এবং আটক থাকেন এবং মুক্তির পর দেশ ত্যাগ করেন।
২৫ মার্চে যে হত্যাযজ্ঞ চলেছিল তা সুনির্দিষ্ট ছিল না। হানাদার বাহিনীর প্রথম আক্রমনের লক্ষ্য ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কারন তারা এই বিশ্ববিদ্যালয়কে বাঙালির জাতীয়তাবাদের মূলকেন্দ্র বলে বিবেচনা করত। তাই শিক্ষকদের মাঝে পরিচিত যাদের পেয়েছে সামনে হত্যা করেছে। তখনই বন্ধ হয়ে যায় ঢাবি। এরপর টিক্কা খান ঢাবি খুলে দেন ২ জুলাই, ১৯৭১। সব শিক্ষককে তাদের কাজ শুরু করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এই ঘোষনার পেছনে উদ্দেশ্য ছিল দুইটি; এক, বহির্বিশ্বে প্রচার করা যে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি স্বাভাবিক, দুই, পাকিস্তান পন্থি ছাত্র ও শিক্ষকদের একত্রিত করা। তারা রাজশাহি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনকে ঢাকা নিয়ে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরি তখন প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করছিলেন।
সেদিন থেকেই ঢাকার নবাব আবদুল গনি রোডের একটি বাড়িতে বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নামের লিস্ট করা শুরু হয় কিছু পাকিস্তান পন্থি শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে। সেই সাথে পাকিস্তানপন্থি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের অত্যন্ত গোপনে হিটলারের গোস্টাপো বাহিনীর মত ট্রেনিং দেওয়া শুরু হয়। এই দলটিই আলবদর। একটি জাতিকে মেধাশুন্য করার ইতিহাসের সবচাইতে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র শুরু হয় সেই জাতির শিক্ষিতদের একটা অংশের সহায়তায়। এই বাহিনীর সদস্যরাই বেরিয়ে আসে মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে বুদ্ধিজীবি হত্যায়। একে একে খুঁজে হত্যা করতে থাকে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিদের। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে এই আলবদর বাহিনীর কথা কেউ জানত না এমনকি ভারতীয় গোয়েন্দারাও না।
আলবদরের প্রত্যক্ষ মদতেই ১৯৭১ এর ১৪ ডিসেম্বর একে একে হত্যা করা হয় আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের, যারা স্বাধীন নতুন বাংলাদেশকে গড়তে অবদান রাখতে পারতেন। সেই সব বুদ্ধিজীবির শুণ্য স্থান আজও আমরা পূরণ করতে সক্ষম হইনি। দেশের জন্য, জাতির জন্য ভাবতে গিয়ে যারা জীবন দিলেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। তাদের ইতিহাস আমাদের জানতে হবে, বুঝতে হবে এভাবেই একদিন আমাদের মাঝে থেকেই জন্ম নেবেন একে একে সব হারিয়ে যাওয়া শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা।
শ্রদ্ধা রইল জাতির সকল বীর সন্তানদের যারা শহীদ হয়েছেন।
বুদ্ধিজীবি দিবস উপলক্ষে গতবছর এইদিনে নিজ নামের ব্লগ হতে করা একটি পোস্ট এবং কিছুদিন আগে বিবর্তনবাদীর করা একটি পোস্ট একত্রিত করে পোস্টটি দিলাম।