২০০৪ সালের অক্টোবর মাসে আমি বের হলাম প্রথম পাহাড়-সমুদ্র দেখতে রাঙামাটি-কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। সাথে আমার ছোট মামা আর বেলজিয়ামের নাগরিক উইম কিউপেন্স। উইমে সাথে অস্ট্রেলিয়ায় আমার কাজিনের পরিচয় হয়। সেই সুবাদে বাংলাদেশে আসার পর আমি ও আমার মামা উইমের সঙ্গী হলাম। কক্সবাজার ভ্রমন শেষে আমরা এলাম চট্টগ্রাম বাসে। সেখান থেকে আবার বাসে ২/৩ ঘন্টার রাস্তা রাঙামাটি। মজার ব্যাপার, মামা টিকেট কাটতে গেলে সাথে উইমকে দেখার পর বাসের টিকেট কাউন্টারের কেউ আমাদের টিকেট দিতে রাজি হল না। কারন, পথে সেনাবাহিনী আটকাবে। কেন আটকাবে তা তারা জানেন না, কিন্তু আটকালে ওদের অযথা সময় নস্ট। যাই হোক, আমরা এক মুরুব্বি পেলাম। তিনি আমাদের একটু দূরে নিয়ে গেলেন। তার পরামর্শে আমি একা গিয়ে তিনটা টিকেট নিয়ে আসলাম। বাসওয়ালারা ফাদে পড়ে , অবশেষে আমাদের নিয়ে যাত্রা শুরু করল।
পথে কিছুদুর যাবার পর, পাহাড়ী পথে এক জায়গায় দেখি বিদেশীদের চেক পোস্ট। ড্রাইভারের বাস থামাতে হল। বাস থেকে আমরা উইম সহ নামলাম। উইম তার পাসপোর্ট দেখাল, ভিসাও ছিল। কিন্তু, আর্মি বাস ড্রাইভারকে বলল আমাদের ভাড়া দিয়ে দিতে, কারন আমরা ওদের সাথে যেতে পারব না। ওরা তাড়াতাড়ি ভাড়া বের করে দিল। আর্মি বলল, বাসটিকে চলে যেতে। বাস চলে যাবার পর আমরা বসে রইলাম।
চেক পোস্টে একটা মজার ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। সেখানের চার পাঁচজন অফিসারের কেউ ইংরেজী জানে না । আমি আর আমার মামা না থাকলে যে সেদিন তারা কি করে উইমের সাথে কথা বলত কে জানে। ওদের ওয়্যারলেস ফোনে বারবার জিজ্ঞাসা করছিল, উইমের পেশা কি। উইম বার বার বলছিল, সেলস্ম্যান। একপর্যায়ে ওরা একটা সাদা কাগজ নিয়ে বলল, উইমকে সাদা কাগজে সাইন করতে হবে। চিন্তা করেন !!! একজন বিদেশীকে বলা হচ্ছে সাদা কাগজে সাইন করতে। কি আর করা, সে করল সাইন। আর্মি একটা মাইক্রোবাস থামিয়ে আমাদের তুলে দিল। শুরু হল রাঙামাটির পথে যাত্রা। চারিদিকে কেমন যেন ছমছম একটা ভাব। সেই গাড়িতে এক বাঙালি ভদ্রলোক ছিলেন। তার সাথে কথা হল পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি নিয়ে। তিনি বললেন, আগে, এই অঞ্চলে বাঙালিরা আগে নিরাপদ ছিল না, প্রায়ই পাহাড়িদের আক্রমনের শিকার হত। আওয়ামী সরকারের সাথে শান্তিবাহিনীর শান্তিচুক্তির পরে পাহাড়িরা চাকমা – নন চাকমা দুইভাগে বিভক্ত হয়েগেছে। এখন তারা আর বাঙালিদের আক্রমন করে না। চাকমাদের নন চাকমারা আক্রমন করে এবং অপর পক্ষও একই কাজ করে। পাহাড়িদের নিজস্ব সংঘর্ষের খবর আমরা বাঙালিরা সংবাদমাধ্যমে পাই না। শান্তি চুক্তির ফলে বাঙালিরা এখন ভালই আছে, ব্যবসা-বানিজ্যে তেম সমস্যাও হচ্ছে না। তবে পাহাড়িদের অবস্থা আগের চাইতে খারাপ। ভদ্রলোককে আওয়ামী সরকারের এই চতুর সিদ্ধান্তের জন্য খুব আহ্লাদিত লাগছিল। বাঙালি হিসেবে আমি লজ্জাই পেলাম নিজের কাছে। পথে নানা জায়গায় সেনাবাহিনী মাইক্রোবাস আটকাল। ওয়ার্লেসে তারা আগেই খবর পেয়েছিল যে আমরা আসছি। পরিবেশে কেমন একটা গুমোট একটা ভাব। পথে এরপর এল পুলিশ। পুলিশ জিজ্ঞাসা করে, “কোন হোটেলে উঠব?”। আমরা কি জানি। যেটা সস্তা সেটাতে উঠব। কিন্তু, ওরা নাছোড়বান্দা আগে ঠিক করতে হবে। অবশেষে, ওরাই ফোন করে একটা হোটেল ঠিক করে দিল।
বিকেলে বের হলাম রাঙামাটির বিখ্যাত লেক ভ্রমনে। লেকের উপর বিখ্যাত ঝুলন্ত ব্রীজ দেখলাম। তেমন, আহামরি কিছু বলে মনে হল না। যাইহোক, ব্রীজের উপর খানিকটা মোটা ছোট্টখাট্ট এক লোক আমাদের পরিচয় জানতে চাইল। প্রথমে, আমরা ভাবলাম হয়ত সাথে একটা বিদেশী দেখে আমাদের সাথে কথা বলতে চাইছে। একটা ব্যাপার আমি এবার লক্ষ্য করলাম। সেটা হল, বাংলাদেশের প্রায় সব স্থানেই সাধারণ লোকেরা বিদেশীদের সাথে টুকটাক আলতু ফালতু কথা বলতে আগ্রহী হয়। মনে হয়, হাই, হ্যালো, হাও আর ইয়ু ইত্যাদি বলে নিজেদের ইংরেজী জ্ঞানের পরিচয় দিতে তারা গর্ব বোধ করছে। এ সময় তাদের মুখে এক বিশেষ প্রকার হাসি থাকে। সে হাসিতে থাকে এহেন মহান ব্যক্তির সাথে সাক্ষাতের উচ্ছাস সেই সাথে সেটাকে নিয়ন্ত্রনের বৃথা চেষ্টা। এরুপ হাসিতে ঠোঁটের দুই প্রান্ত উপরেও ওঠে না নিচেও নামে না, শুধু ডাইনে বামে যথাসম্ভব প্রসারিত হয়।
যাইহোক, সেই লোকের কথায় আসি। অচেনা জায়গা, তার উপর আমাদের সন্দেহ হওয়ায়, আমরা তাকে মোটামুটি শক্তভাবে জবাব দিয়ে সরে যেতে লাগলাম। কিন্তু, সে বলে, “ভাই যাগো খুজতেছিলাম, আপনারা তারাই। আমি ডিবি পুলিশের লোক”। আমরাতো আকাশ থেকে পড়লাম। ডিবি পুলিশ আমাদের সাথে কেন? সে বলল, বিদেশীর নিরাপত্তার জন্য। কি আর করা, সে আমাদের ছাড়তেই চায় না। আমরা নৌকায় উঠলাম, সেও আমাদের সাথে উঠল। অবশেষে রাত হয়ে গেলে আমরা হোটেলে ফিরে আসলাম।
হোটেলে উইমের সাথে সারাদিনের আর্মি, পুলিশ, ডিবির ব্যাপারে কথা হল। আমরা উইমকে বুঝালাম, কিছুদিন আগে এক বৃটিশ ও ডেনমার্কের নাগরিক অপহরণ হওয়ায় সরকার হয়ত বিদেশীদের নিরাপত্তার জন্য এই ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু, উইমের সন্দেহ ছিল অন্যদিকে। সে আমাদের জানাল, সকালে বিদেশীদের চেক পোস্টে আর্মিকে ওয়্যারলেসে বার বার জিজ্ঞাসা করা হচ্ছিল উইম কি কাজ করে। আর চেক পোস্টের ওরাও বার বার উইমের পেশা কি তা জানতে চাচ্ছিল। উইমের কাছে এটাই খটকার লাগে। সে আমাদের বলল, একই পরিস্থিতিতে সে পড়েছিল মেক্সিকোতে। সেখানেও পাহাড়ী এলাকায় যেখানে উপজাতিরা থাকে, সেনাবাহিনী সেখানে বিদেশীদের চলাফেরা নিয়ন্ত্রন করে। এমনকি সরাসরি রিপোর্টারদের অনেক সময় যেতে দেয় না। সেনাসদস্যরা নাকি সেসব স্থানে অনেক ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন করে থাকে। উইমের মত ছিল, যদি তার পেশা রিপোর্টার হত তাহলে তাকে হয়ত রাঙামাটি ঢুকতে দেওয়া হত না। যদিও দেশের মর্যাদার স্বার্থে আমরা তাকে বুঝালাম, আমাদের সেনাবাহিনী বা সরকার পাহাড়ী এলাকায় মানবাধিকার লঙ্ঘন করে না।
পরের দিন সকালে ৮ টায় উঠলাম। দেখি মামা আর উইম দুজনেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হোটেলের নিচে গিয়ে দেখি, সেই ডিবি পুলিশ ৮ টায়ই এসে উপস্থিত। কি ঝামেলা!! উপরে উঠে মামা আর উইমকে বললাম। সবাই বিরক্ত। তারপরও তাকে নিয়েই গেলাম বৌদ্ধদের মন্দিরে ঘুরতে। সে আমাদের সাথে মন্দিরে ঢুকল না। কিন্তু মন্দির থেকে বের হয়েই দেখি, আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। তারপর গেলাম চাকমা রাজবাড়ীতে, সাথে সেই ডিবি পুলিশ। কি বিপদ!!! দুপুর ১ টায় হোটেলে এসে সিদ্ধান্ত নিলাম, আর না! অনেক হয়েছে। তখনই বাসের টিকিট কাটতে গেলাম। মাননীয় ডিবি পুলিশ আমাদের হাত নাড়িয়ে বিদায় করেই খান্ত দিলেন। আমরাও রাঙামাটি ছেড়ে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললাম!
সেই যাত্রায় যা বুঝলাম তার মদ্দা কথা হল পার্বত্য অঞ্চলে আমাদের বাংলাদেশে আর্মী নিয়মিত মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। পাহাড়িরা খাতে কলমে বাংলাদেশী হিসেবে স্বীকৃত হলেও, মনস্তাত্বিক ভাবে আমরা তাদের বাংলাদেশী মনে করতে ব্যর্থ। পার্বত্য অঞ্চলকে বাংলাদেশের অংশ হিসেবে সেভাবেই বিবেচনা করতে হবে, যেমনটি বগুড়া, বরিশাল, নোয়াখালি, কুমিল্লা বা সিলেট অঞ্চলকে গন্য করা হয়। জিয়াউর রহমানের সেখানে বাঙালিদের আবাসন বা শেখ হাসিনার শান্তিচুক্তির ন্যায় ছলনার নীতি পরিহার করে, পাহাড়ীদের সত্যিকারের বাংলাদেশি হিসেবে গন্য করে তাদের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করতে হবে।
বর্তমানে যারা এই দেশের শাসক বা নিকট ভবিষ্যতে যারা আসবেন তাদের কাছে এই দূরদর্শীতা আশা করি না, তবে পরিস্থিতির অবনতি ঘটাবেন না এটা অন্তত আশা করতে পারি। বাকিটা না হয় পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে দেওয়া গেল।
বিদ্র: ব্লগে বছর খানেক আগে লেখা দুইটি পোস্ট এক করে নতুন করে দিলাম। তখন আমি নতুন ব্লগার ছিলাম, পাঠক অনেক কম ছিল। আজকে নরাধমের একটা পোস্ট পড়ে, ইচ্ছে হল নতুন করে দিতে। আগের পোস্ট দুটি সরিয়ে ফেললাম।
পোস্টের সাথে সম্পর্কহীন আলোচনা এখানে করুন