আজ আমরা আমাদের বিশ্বের নতুন সম্রাটের আগমত বার্তা পেলাম। সম্রাট দ্বিতীয় বুশের উত্তরসূরী হিসেবে আগামী ২০ জানুয়ারি অভিষেক হতে যাচ্ছে সম্রাট বারেক ওবামার। গ্রীষ্মের পরে এল শীত, বুশের পরে আসছেন ওবামা। তার সাফ কথা, Change, Change, Change। সব কিছু উল্টিয়ে ফেলবে, সব নতুন হবে। ওবামার সিংহাসনে বসার সাথে এমনিতেই একটি পরিবর্তন আসবে। সেটা হল একজন কালো মানুষের আমেরিকার সম্রাট হওয়া। কালোরা যুগ যুগ ধরে নির্যাতিত। এখন তারা পরিবর্তন আনবেন। মুখে যাই বলি সম্রাজ্যের অন্তর্গত আমাদের মত ছোট ছোট আপাত স্বাধীন জাতিগুলো খুব খুশি। সবাই ভাবছেন নিজেদের লোক এখন ক্ষমতায়, যেন নিজেরাই ক্ষমতায় বসে গেলেন।
পৃথিবীতে সম্রাজ্য ও সম্রাট প্রতি সময়েই ছিল। মিশরের ফরাওরা, পারস্য, রোমান, সুলতান মাহমুদ, কুবলাই খান, অটোমান, সেই দিনে ডুবে যাওয়া বৃটিশ সম্রাজ্য এগুলো এখন ইতিহাস। আকাশে এখন আমেরিকার সূর্য উঠেছে, যদিও অনেকেই বলেন সেই সূর্য ডুবতে শুরু করেছে। সময় যেটাই হোক না কেন, সম্রাজ্য সবসময়ই সম্রাজ্য। বিশ্বে তাদের দাপট ও তার বহিঃপ্রকাশ একই ধরনের। আমেরিকার সম্রাজ্যে এখন চলছে পরিবর্তনের হাওয়া, কেউ কেউ ভাবতে পারেন এমন পরিবর্তন আসাটা গনতন্ত্রের এই যুগেই সম্ভব। কিন্তু না, কথাটা ঠিক নয়। এমন হঠাৎ পরিবর্তনের আমেজ অতীতের সম্রাজ্যগুলোতেও এসেছিল। মানুষ আনন্দে মেতেছিল খানিক্ষণের জন্য, তারপর আবার ফিরে গেছে আগের অবস্থায়। কারন, একটা। এখনকার আমলাতন্ত্র অথবা তখনকার পুরোহিততন্ত্র। সম্রাট আসে যায় কিন্তু সম্রাজ্য টিকে রয় স্বরূপে, এই আমলা বা পুরোহিতদের জন্যই। এদের শুরু সম্রাজ্যের সাথে, শেষও সম্রাজ্যেরই সাথে। এমনই এক পরিবর্তনের কথা এখন বলব যা এসেছিল আজ থেকে ৩৩০০ বছর আগে মিশরে।
মিশরে ফরাওদের শাসন শুরু প্রায় ৫০০০ হাজার বছর আগে, নীলনদ কেন্দ্রিক Upper Egypt (ভূমধ্যসাগরের দূরবর্তী অংশ) ও Lower Egypt (ভূমধ্যসাগরের নিকটবর্তি ব-দ্বীপ অঞ্চল) একত্রিভূত করনের দ্বারা। শাসকের টাইটেল ফরাও বা ফেরাউন। ফরাওরা মিশরে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতা হিসেবে শাসন করতেন। তাদের ছিল অনেক দেব দেবী, অর্থাৎ তারা বহু ইশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন। ফরাওএর পরেই ছিল শক্তিশালী পুরোহিত গোষ্টি। এদের তুলনা করা যায় আজকে আমেরিকার পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা বিষয়ক হর্তাকর্তাদের সাথে। মূলত এদের দ্বারাই শাসিত হত মিশর। তারা নানা দেবদেবীর উপাসনা করতেন। মন্দির গুলো তাদের নিয়ন্ত্রনে থাকত। জনগনের থেকে অর্থ আদায় করতেন তারাই, নানা দেবদেবীর নামে। মিশরের যা কিছু আমরা আজ দেখি তার সবই এই পুরোহিত গোষ্টির হাতে তৈরি। তারাই ফরাওদের মমি করতে পরামর্শ দেয়, তারাই পিরামিড তৈরির বুদ্ধি ও পরিকল্পনা দেয়। শত শত বছর ধরে তারাই শাসন করে মিশর। জনগন এবং ইশ্বেরের মাঝে থাকতেন শুধু ফরাও এবং তার পুরোহিত বাহিনী।
এভাবেই চলে আসছিল। কিন্তু এর মাঝে হঠাৎ এল পরিবর্তনের হাওয়া। আজ হতে প্রায় ৩৩০০ বছর আগে (খ্রিষ্টপূর্ব ১৩০০ এর দিকে) ফরাও তৃতীয় আমেনহোটেপের মৃত্যুর পরে তার প্রধান পত্নি টায়ার এর ছোট ছেলে চতুর্থ আমেনহোটেপ ক্ষমতায় আসেন। এই আমেনহোটেপই নিয়ে আসেন পরিবর্তনের হাওয়া। কি সেই পরিবর্তন?
বহু ইশ্বরের উপাসনাকারী পুরোহিতদের তিনি চ্যালেঞ্জ করেন। তখন মিশরে নানা দেবদেবী এবং সবচাইতে শক্তিশালী দেবতা আমুন-রা এর উপাসনা হত। কার্নাকের মন্দির ছিল প্রধান উপাসনালয়। আমেনহোটেপ আমুন-রাকে দেবতা হিসেবে অস্বীকার করেন এবং সেই সাথে অন্যান্য সব দেবদেবীকেও নাকচ করে দেন। তিনি নিয়ে আসেন নতুন সৃষ্টিকর্তা এটেন এর ধারণা। এটেন মূলত সূর্য দেবতা। আমেনহোটেপ একমাত্র দেবতা এটেনের উপাসনা করতেন। মিশরের দীর্ঘ ইতিহাসে এই প্রথম এল একেশ্বরবাদী চিন্তা ধারা। উল্লেখ যোগ্য যে, আমেনহোটপের প্রায় একশত বছর পরেই দ্বিতীয় রামসিস ক্ষমতায় আসেন, ধারণা করা হয় মুসা (আঃ) এই সময়েই পৃথিবীতে আসেন। অর্থাৎ বলা যেতে পারে মূসা (আঃ) এর প্রায় শত বছর পূর্বেই আমেনহোটেপ এক ইশ্বর তথা সূর্য দেবতার উপাসনা শুরু করেন।
এখন আসি পরিবর্তনের কথায়। প্রথমত আমেনহোটেপ তার নাম পরিবর্তন করে রাখেন, আখেনাতেন (এটেনের পূত্র)। তার নতুন সৃষ্টিকর্তার জন্য নতুন এক শহর প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন, যার নাম হয় আখেতাতেন (এটেনের স্থান)(বর্তমান আমারনা)। তাছাড়া এটেন (সূর্য দেবতা) এর উপাসনার ধরণ একটু অন্যরকম ছিল। এই দেবতার উপাসনা দিনের আলোতে বাইরে সবার সামনে হত। এর আগে আমুন-রা এর উপাসনা পুরোহিতেরা অন্ধকার মন্দিরগুলোর ভেতরে রহস্যময় কায়দায় করতেন। সাধারণ মানুষের সেই উপাসনার সাথে তেমন যোগাযোগ থাকত না। নতুন দেবতা এবং নতুন উপাসনা পদ্ধতি আসায় সৃষ্টিকর্তা এবং জনগনের মাঝে শুধু একটি সত্ত্বাই রয়ে গেল। তিনি হলে ফরাও আমেনহোটেপ বা আখেনাতেন স্বয়ং। ফলে পুরোহিতদের গুরুত্ব চরম ভাবে হ্রাস পেল। উপাসনার জন্য দেবতাকে উৎসর্গের জন্য তারা যে অর্থ জনগন থেকে নিতেন, সেই পথ বন্ধ হয়ে গেল। শুধু তাই নয়, আখেনাতেন হুকুম দিলেন কার্নাকের মন্দিরের সব জৌলুস সরিয়ে দিতে। সম্রাজ্যের নানা প্রান্তে তার আদেশে আমুন-রা এবং অন্যান্য দেবদেবীর মূর্তি সরিয়ে ফেলা শুরু হল। থেকে গেল শুধু এক ইশ্বর এটেন বা সূর্য সাথে তৈরি হল পুরোহিতদের ক্ষোভ।
এই বিশাল মহাযজ্ঞে আখেনাতেন একা ছিলেন না, তার স্ত্রী নেফারতিতি সব সময় তার সব কিছু নিয়ন্ত্রন করতেন। হতে পারে এই বিশাল কর্মকান্ডের মূল হোতা ছিলেন নেফারতিতিই। আখেনাতেন বেশিদিন বাঁচেন নি, আখেতাতেন শহরের কাজ শেষ হবার আগেই আখেনাতেনের মৃত্যু ঘটে। এরপরেই ঘটে সেই অবিশ্বরণীয় পরিবর্তন, মিশরের ফরাও হন নেফারতিতি। সমগ্র মিশরের ফরাওদের ইতিহাসের একমাত্র নারী ফরাও। নেফারতিতির তত্ত্বাবধানে এটেন দেবতার আখেতাতেন শহরের কাজ আরো জোরেসোরে শুরু হয়। একসময় নেফারতিতি মারা যান। আখেনাতেন এবং নেফারতিতির কোন ছেলে ছিল না, ছিল ছয় মেয়ে। নেফারতিতির মৃত্যুর পরে পুরোহিতেরা আখেনাতেন এর অন্য রানীর আট বছর বয়স্ক ছোটছেলে তুতানখামুনকে মিশরের ফরাও হিসেবে বসিয়েদেন।
এখন শুরু হল নতুন খেলা। বালক তুতানখামুনকে সিংহাসনে বসিয়ে, পুরোহিতেরা সমগ্র মিশরকে আগের অবস্থায় নিয়ে যান। আখেতাতেন শহরের কাজ বন্ধ হয়ে যায়, আবার পুরোদমে উপাসনা শুরু হয় কার্নাকের মন্দিরে। সূর্য দেবতা এটেনের বিদায় হয় এবং আবার শুরু হয় দেবতা আমুন-রা এবং অন্য সব দেবদেবীদের উপাসনা। এই সময়ই ঘটে মানব ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস বিকৃতি।
পুরোহিতদের কাছে এটা চরম অপমানজনক ছিল যে, একজন নারী তাদের ফরাও ছিলেন এটা ইতিহাসে রেখে যাওয়া। তারা সমগ্র মিশরে যেখানেই নেফারতিতির নাম ছিল সেখানেই পরিবর্তন করেন। আমরা জানি মিশরের বর্ণমালা ছবি ভিত্তিক (Hieroglyphics)। বিধায় নেফারতিতির ছবিতে একজন নারীর প্রতিচ্ছবিই থাকবে। পুরোহিতেরা নেফারতিতির ছবিগুলোতে শশ্রু লাগান, মাথায় সাপ এঁকে দেন কারন এগুলো পুরুষের চিহ্ন, এবং পড়লে মনে হবে এই ফরাও একজন পুরুষ।
যতই রাজনীতি করুক তারা হাজার হোক পুরোহিত ছিল এবং সৃষ্টিকর্তার ভয় ছিল। বিধায় তাদের পক্ষে এটা সম্ভব হয়নি নেফারতিতির মমি তৈরি না করা। তারা নেফারতিতির মমি তৈরি করে কিন্তু সেটিকে এমন এক জায়গায় ভ্যালি অব কিংস-এ (এই মরূভূমিতে অনেক ফরাওএর মমি সংরক্ষিত আছে) রাখে যেন ভবিষ্যতে কারো চোখে না পড়ে। আর পড়লেও তাদের পক্ষে যেন এটা ধরা সম্ভব না হয় এই ফরাও একজন মহিলা তাই সব জায়গায় লিখে রাখায় হয় তিনি একজন পুরুষ। ঘটনা এখানেই শেষ, এবং প্রায় ৩২০০ বছরের জন্য ইতিহাস থেকে মুছে যায় নেফারতিতির নাম, মিশরের একমাত্র নারী ফরাওয়ের নাম।
বিশাল সম্রাজ্যগুলোতে মাঝে মাঝে আসা পরিবর্তন গুলোর এভাবেই ইতি ঘটে। জনগনের ভাগ্য আবার ফিরে যায় সেই আগের অবস্থায়। শুধু খনিকের জন্য মানুষ আশার আলো দেখে। তবে হ্যা, নেফারতিতি আমাদের জন্য আর একটি বিশেষ উদাহরণ। আর তা হল, ইতিহাসে যা একবার ঘটে যায়, তা পরিবর্তন অসম্ভব। এই কয়েকবছর আগে হঠাৎ পুরাতাত্ত্বিক খোঁজ করতে গিয়ে হঠাৎ একটা দেওয়াল পাওয়া যায় যার ধরণ দেখে মনে হয় এর পেছনে কোন প্রকোষ্ট আছে। পুরাতাত্ত্বিকরা সেই দেওয়াল ভাঙ্গেন। ভেতরের লেখা ও মমি করার পদ্ধতি দেখে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হন এটা এক ফরাওয়ের মমি। তাছাড়া মজার ব্যাপার হচ্ছে, পুরোহিতেরা মানুষের চোখ থেকে লুকিয়ে রাখবার চেষ্টা করায় এই ৩২০০ বছরে এই প্রকোষ্টটি মমি চোরদের হাত থেকে বেঁচে যায়। বিজ্ঞানীরা মমি পরীক্ষা করে দেখেন সেটি একটি মহিলার মমি এবং সেখানে সংরক্ষিত একটি মূর্তি পাওয়া যায়, যেটি নেফারতিতির বলে ধারণা করা হয়। পরবর্তীতে আরো গবেষণায় সত্য বের হয়।
বর্তমানে আমেরিকার সম্রাজ্যে বারাক ওবামা সম্রাটতো হলেন, কিন্তু সেই আমলাতন্ত্র, পুরোহিততন্ত্রের ধারকরা, যেমনটি ছিলেন বুশের সময় তেমনটি আছেন। বিধায় এই পরিবর্তনে আমাদের খুব একটা স্থায়ী অর্জন হয়ত কপালে নেই।
পোস্টের সাথে সম্পর্কহীন মন্তব্য এখানে করুন।
সূত্র: উইকিপিডিয়া এবং বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দেখা ডকুমেন্টারি।