“বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ কেড়ে নিয়েছে আবেগ” বহুল ব্যবহৃত বাক্য। স্কুল জীবনে ভাব-সম্প্রসারণ আসত, নম্বর থাকত ১০। সাহিত্যের ভাষায় বিজ্ঞানকে জীবনের সব নিরস উপাদানের জন্য দোষ দিতে হত। এটাই ছিল নিয়ম, এর ব্যতিক্রম লিখবার কোন ধারণা ছিল না। আমরা বিজ্ঞানের ছাত্ররাই বিজ্ঞানকে বেশি অপবাদ দিতাম এবং আর্টস, কমার্সের ছেলেদের চাইতে বেশি নম্বর পেতাম। এই বিজ্ঞনের ছাত্ররাই আবার একই বাংলা দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষায় “দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান” রচনায় বিজ্ঞানের জয়জয়কার করতাম। বিজ্ঞান আমাদের এটা দিয়েছে, ওটা দিয়েছে এই এই সমস্যার সমাধান করেছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
আজ ভাবি বিজ্ঞান আমাদের বেগ দিলেও আবেগের উপর এর কোন প্রভাব নাই। মানুষ তার আবেগ ঢেলে দিয়ে নিরস বিজ্ঞানকে সরস করে তোলে। তীব্র বেগে চলা নিরস জীবনের রাশ টেনে তাকে খানিক্ষণ বিশ্রাম নিতে বাধ্য করে। একটা সময় আমরা কাগজে চিঠি লিখতাম। আজকের যুগে এটা অপ্রয়োজনিয়। এখন তড়িৎবেগে মেসেজ বা কল চলে আসে মোবাইলে। চিঠি লিখবার আবেগ ই-মেইল বা মোবাইলের এসএমএসে না থাকলেও, মোবাইলের নিজস্ব একটা আবেগ আছে। প্রেমিক-প্রেমিকা রাতে ঘুমাবার আগে অপর পক্ষের এসএমএস বা কল না পেলে বিরহে ভোগে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই মোবাইলে পাওয়া একটা সুন্দর এসএমএস দূষিত ঢাকা শহরেও কাশ্মিরের নির্মল আবহাওয়া ছোঁয়া এনে দেয়। দিনে কাজের ফাঁকে ফাঁকে প্রিয়ার মিসকল মুখে এনে স্নিগ্ধ হাসি। আর সেই মিসকল যদি হয় তাকে কল করবার ঠিক একই মুহূর্তেই তাহলে তো কথাই নাই। অনেক প্রেমিক প্রেমিকা তাদের নির্মল মানবিক প্রেমের অস্তিত্ব খুঁজে পায় ছোট ছোট সেই মুহূর্তেই।
এতো গেল দুটি মানুষের আবেগ, এখন আসি অনেক মানুষের ক্ষেত্রে। আজতক মানুষের সামাজিক বিচরণ আশে পাশের আত্মীয়-স্বজন, অফিসের কলিগ, বন্ধুবান্ধব বা আশে পাশের মানুষ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু এখন তা বিশ্বব্যাপি বিস্তৃণ। প্রথমেই আসে ইন্টারনেট চ্যাটিংএর কথা। একটা সময় মা বাবা ভাইবোন বিদেশে থাকা ভাইটি বা বোনের ফোনের অপেক্ষায় বসে থাকত। ফোন এলেও বাড়তি বিল এবং লাইনের সমস্যাতো থাকতই। এখন প্রবাসী ও দেশী উভয় পক্ষই সারাদিন নেটে লগইন থাকে। ওয়েবক্যামে দেশের রান্নাঘরে মা রান্না করে তাই দেখে ছেলেও সুদূর আমেরিকায় মায়ের মত রান্না করতে চেষ্টা করে। কত প্রেমিক প্রেমিকার পরিচয় যে এই চ্যাট রুমে তার ইয়ত্তা নেই। খারাপ দিকও আছে স্বীকার করি, কিন্তু তা কোন ক্রমেই আমাদের অফলাইন জীবনের খারাপ দিকগুলোর চাইতে বেশি না। সামাজিক পরিবর্তনে বিজ্ঞানের এটা এক বিশাল অবদান হিসেবে স্বীকৃত হবে খুব শীঘ্রই। মাঝে মাঝে অবাক হয়ে মনিটরের দিকে চেয়ে থাকি। পাশা পাশি দুটি ম্যাসেঞ্জার উনডোর হয়ত একটাতে কথা হচ্ছে লন্ডনের ইমনের সাথে তো অন্যটিতে কানাডার সাজি আপুর সাথে। কনফারেন্স চ্যাটিং করছে হয়ত বাংলাদেশের ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রামের ব্লগারা সাথে আছে কানাডা, বৃটেন, কোরিয়া, আমেরিকার ব্লগাররাও। এই আড্ডার আমেজ এলাকার টং-দোকানের আড্ডার চাইতে কম সরস না!!
আমার এই লেখার পাঠকদের কাছে বিজ্ঞান থেকে পাওয়া আবেগের সবচাইতে বড় উদাহরণ এই ব্লগ সাইট যার নাম সামহোয়্যারইন। কে কোথায় আছি জানি না, কে বড়, কে ছোট, কে ছেলে, কে মেয়ে কিছুই জানা নাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। অথচ প্রত্যেকের মনের গভীরে জমে থাকা না বলা কথা গুলো সবাই জানতে পারছি। হয়ত একজনের কোন গান ভাল লাগছে, তো সে সেই গানের কথাটা তুলে দিয়ে নিজের অনুভব প্রকাশ করছে অনেক অনেক প্রিয় মানুষের কাছে। কারো হয়ত মন খারাপ, বদ্ধ ঘরে একাকীত্বের যতনা সহ্য হচ্ছে না, সে চলে আসছে ব্লগের সরস জগতে। কেউ হয়ত খুব ভালবাসে সৃষ্টিকর্তাকে, শ্রদ্ধাভরে ব্লগারদের জন্য তুলে দিচ্ছে তার বানি। কেউ হয়ত ভাল কবিতা লিখত না, যা মনে আসত তাই ব্লগে ছাড়ত। ব্লগারদের উৎসাহে লিখতে লিখতে একদিন তার ব্লগেও পাওয়া গেল মন ছোঁয়া কবিতা। অনেক সিনিয়র কালপুরুষ, সব চাইতে ছোট মুন্না; সবাই বন্ধু। মাঝে আমরা অন্যরাতো আছিই। রাগ, শোক, ঘৃণাও, কারো প্রতি আনুগ্যত সবই আবেগেরই অংশ। সমাজের একটা বিশেষ শ্রেণীর প্রতি ঘৃণা হয়ত নিজের ভেতরেই বন্দি থাকত, এই ব্লগে ব্লগার তার ঘৃণা সবার সামনে প্রকাশ করে শান্তি পাচ্ছে। শুধু তাই নয়, যখন সে দেখে যে সে একা নয় তার শক্তি আরো বৃদ্ধি পায়। অশুভ শক্তির প্রতি ঘৃণাই মানব সমাজের আজকের উন্নতির পেছনের অন্যতম বড় কারন।
আজ যদি সেই ভাব সম্প্রসারণ লিখতে দেওয়া হত তবে আমার শুরুটা হত এরকম “বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ কেড়ে নিয়েছে আবেগ – উক্তিটির ব্যাখ্যা দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করে ...................................” এভাবে। তারপর প্রমান করতাম উক্তিটি সত্য নয়। আসলে সেই গুহা যুগ থেকে আজ পর্যন্ত মানুষের যা যা অর্জন তার সবইতো বিজ্ঞানেরই দান। যে কাগজ, কলম ব্যবহার করে আমরা চিঠি লিখতাম তা কি বিজ্ঞানের অবদান না? বিজ্ঞান মূলত আমাদের “কোন কিছু জানবার প্রতি যে আগ্রহ” সেই আবেগেরই বহিঃপ্রকাশ। অর্থাৎ মানুষের আবেগ আগে তারপরই বিজ্ঞান। “বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ কেড়ে নিয়েছে আবেগ” উক্তিটি পরিবর্তিত হওয়া দরকার। আমাদের বলা উচিত, “বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে আবেগ, সাথে যোগ করছে আরো বেগ”।
~বিবর্তনবাদী~
সেপ্টেম্বর ১২, ২০০৮