বিজ্ঞানের ছাত্র আমি, জীবনের লক্ষ্য বিজ্ঞানের সাধনা যা দেশের সমস্যা সমাধানে কাজে আসবে। দেশের কাজে লাগবার সামর্থ অর্জনের জন্য নিজেকে গড়তে ব্যস্ত। সেই যুদ্ধে লড়তে লড়তে প্রায়ই দেখা হয় দেশের বিজ্ঞানের মহারথীদের সাথে। আমি জীব বিজ্ঞানের ছাত্র, বাংলাদেশে এই ক্ষেত্রে গবেষকদের মাঝে যারা প্রতিষ্টিত তাদের কারো কারো কাছাকাছি গেছি অথবা তাদের ব্যাপারে শুনেছি। তাদের গবেষণার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা আছে যার ভিত্তিতে খানিকটা বিশ্লেষণ করবার সাহস রাখি। এ জন্যই আমার আজকের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।
আমাদের দেশে প্রধানত তিনটি ক্ষেত্রে গবেষণা হয়:
১. সরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠানে।
২. কোন না কোন বিদেশী প্রোজেক্টের অর্থায়নে
৩. ডিগ্রি দেবার জন্য মাস্টার্স, এমফিল ও অল্প স্বল্প পিএইচডি ডিগ্রি উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দ্বারা পরিচালিত গবেষণা।
প্রথম থেকেই শুরু করি, সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান হতে। এসব প্রতিষ্ঠানে মূলত আমাদের গবেষকগন কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করেন। সরকারি চাকরির সুবিধা পান, সরকারের খরচে বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ লাভ করেন। তাদের আমরা বিজ্ঞানী হিসেবে চিনি না। আমাদের কাছে তাদের পরিচয় উনি বিসিএসআইআর, পশু সম্পদ গবেষণা, বারি বা বিরি ইত্যাদিতে চাকরি করেন। দৈনন্দিন অফিস করা, সাইন-সিগনেচার করা ও মাস শেষে বেতন তোলাই এদের প্রধান কাজ। নতুন কিছু আবিস্কারের বা দেশে সমস্যা সমাধানের জন্য তাদের প্রতি কোন প্রকার চাপও নেই। কারন, আমাদের নীতিনির্ধারকদের মাথায় একটাই চিন্তা ঘোরে তা হল এদেশে অর্থাভাবে ফলপ্রশু গবেষণা সম্ভব নয়, দরকার বিদেশী কনসাল্টেন্ট। এদের মাঝে কেউ কেউ দেশের জন্য কিছু না কিছু করবার চেষ্টা করেন। কিন্তু স্বীকৃতির অভাবে অথবা নানামুখি চাপে তারা হয় হতাশ হয়ে পড়েন, নইলে এক পর্যায়ে বিদেশে পাড়ি জমান। দুই একজন টিকে থাকেন তারা তাদের ল্যাবরেটরি সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হন, তাদের অল্প কিছু অর্জনের খবর আমরা মাঝে মাঝে পেপারে পেয়ে থাকি। একটা তৃতীয় বিশ্বের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাপেক্ষে হয়ত তাদের অর্জন চোখে পড়বার মত, কিন্তু সামগ্রিক ভাবে দেশের জন্য তাদের অর্জন মূলত সমুদ্রের তীরে বালুকণা সম। যেমন, দুই একটা উচ্চ ফলনশীল ধান বা মাছে ফরমালিনের মাত্রা নির্ণয়ের কিট।
আমাদের দেশে বাজেটের মাত্র ০.০৩% (যতদূর আমার মনে আছে, ভুলও হতে পারে) গবেষণার জন্য বরাদ্দ। উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রনালয়ে বদলি নিতে চান না কারন সেখানে পয়সার ঢল নামে না। যা কিছু আসে তা সচিব পর্যায় থেকে শুরু করে গবেষক পর্যায়ে একে একে শোষিত হয়। বাকি যা থাকে তার প্রথমত খরচ হয় প্রোযেক্টের ভবন, গাড়ি, এসি, টেবিল চেয়ার ও অন্যান্য আরামদায়ক আসবাব ইত্যাদি খাতে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই প্রোজেক্ট শেষ হবার সাথে সাথে তার গাড়ি, এসি এগুলো গায়েব হয়ে যায়। তাছাড়া বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে মন্ত্রনালয় পর্যায়ে যে সব মূল নীতি নির্ধারক থাকেন তারা কেউই মূলত বিজ্ঞানী বা গবেষক নন। কিছু কিছু বিজ্ঞানের ছাত্র থাকলেও তাদের বিজ্ঞানী সত্তা বিসিএস পরীক্ষায় সফল হবার সাথে সাথেই লোপ পায়। এরা কিছুই বোঝে না মূলত। দূর্ণীতিবাজরা কিছু পয়সা পকেটে ভরেন, অন্যদিকে সৎ কর্মকর্তার সততা জ্ঞানের অভাবে কোন কাজে আসে না। বরং তাদের সততার ঠেলায় দীর্ঘসূত্রিতা সৃষ্টি হয়। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যা কিছু গবেষণা হয় তার ফল মূলত ল্যাবরেটরির বাইরে অচল। গবেষকদের বানিজ্যিক জ্ঞান শুন্যের কোঠায় থাকায় তারা এমন কিছু তৈরি করতে সক্ষম হন না যা বানিজ্যিক ভাবে সফল হতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় উৎপাদন খরচ যা পড়ে তারচে ঐ জিনিস পার্শবর্তী দেশ ভারত হতে আমদানী করলে অনেক খরচ বেচে যায়। ফলশ্রুতিতে, যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে গবেষণায় ঢালা পয়সা আসলে পানিতে পড়ে। আমরা একবার এক scientific conference-এ অংশগ্রহণের জন্য ময়মনসিংহের Bangladesh Institute of Nuclear Agriculture বা BINA তে গিয়েছিলাম। সেখানে ঢুকবার পথে ডিসপ্লেতে তাদের গবেষণা লব্ধ কিছু ফসল রাখা ছিল। তা ওদের বিজ্ঞানীদের জিজ্ঞাসা করলাম, এগুলো কি দেশের কৃষক মাঠে উৎপাদন করছে নাকি তাদের ল্যাবরেটরির বাইরে যায় নি। ওদের উত্তর ছিল, “এখনও কৃষকের থাকে যায় নাই, টমাটো পাঠানো হয়েছিল কিন্ত কৃষকরা উৎসাহি হয়নি“। এরপর কি হয়েছিল জানি না।
আরো হতাশার ব্যাপার হচ্ছে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি হতে এসব প্রতিষ্ঠান হাজার মাইল দূরে থাকে। ইন্টারেটের ব্যবহার হচ্ছে গবেষকগনের বিদেশী উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশী প্রফেসরের যোগাযোগের জন্যে। বছর তিন চার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের কিছু বন্ধু বান্ধব একটা সংগঠন করেছিল। তা ওরা এক আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রন জানিয়েছিল বিসিএসআইআর এর চেয়ারম্যানকে। তিনি বিশিষ্ট ফার্মাসিস্ট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। স্যারের বক্তব্য শেষে তাকে নানা জন (সব আমাদের মত অনার্সের ছেলে মেয়ে) প্রশ্ন করছিল। আমি স্যারকে জিজ্ঞাসা করলাম, তার বিসিএসআইআর-এ কি জাতীয় গবেষণা হয় তা আমরা কোথা হতে জানতে পারি? উত্তরে আশা করেছিলাম স্যার তাদের ওয়েব সাইটের লিংক দিবেন। কিন্তু, তিনি বললেন তিনি একটা সুভেনির দিয়ে যাবেন, সেখান থেকে আমরা কিছু আইডিয়া পাব। হতাশ হয়ে, বাসায় এসে ইন্টারনেটে খুঁজে বিসিএসআইআরএর ওয়েব সাইটে ঢুকলাম। ঢুকে দেখি সেই সাইট পাঁচ বছর ধরে আপডেট হয় না। চেয়ারম্যান স্যারের নাম গন্ধও নেই। এই হচ্ছে অবস্থা!!!
আমার কাছে যেটা সব চাইতে হাস্যকর মনে হয় তা হল এই সব গবেষণা প্রতিষ্টান স্থাপনের পেছনে উদ্দেশ্য। এগুলো এই জন্য তৈরি হয়েছে কারন দেশে গবেষণা প্রতিষ্ঠান না থাকলে ভাল দেখায় না। যেমন, কৃষি প্রধান দেশে একটা কৃষি বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান থাকবে না তা শুনতে ভাল লাগে না। তাই এসবের পেছনে পয়সা ঢালা। এদেশের উন্নতিতে কোন সদূরপ্রসারী প্লান নাই। দেশে সমস্যা চিহ্নিত করণের কোন উদ্যোগ নেই, সেখানে সমাধানের চেষ্টা আসলে সময় ও অর্থের অপচয়। একজন গবেষক নতুন কোন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়ে গেলে বুঝেন তাকে গবেষণার জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কি নিয়ে তিনি গবেষণা করবেন? কেন করবেন? কার জন্য করবেন? সব চাইতে বড় কথা কি করে তিনি তার গবেষণার ফলাফল যার সমস্যা তার কাছে পৌছে দেবেন তার কোন খবর থাকে না!! আমরা মূলত বিদেশী লেখকের বই পড়ে গবেষক হই, সেসব বইতে বিদেশের সমস্যার কথাই থাকে। আমাদের মস্তিস্কও তাই ঐ সব সমস্যা সমাধানের জন্য গড়ে ওঠে। এর ফলাফল এই দাঁড়ায় যে গবেষক কিছু একটা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন যা তার ও তার বন্ধুদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলেও সামগ্রিক ভাবে বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য কোন বিশেষ ফল বয়ে আনে না। আমাদের বিজ্ঞানীরা আমাদের জন্য যা করেন তা হচ্ছে এই দেশে হাজার হাজার বছর ধরে যে সব ফসল উৎপাদিত হয়ছে তা বাদ দিয়ে বিদেশী ফসলের সাথে ব্রিডিং করা নতুন উচ্চ ফলনশীল ফসল দেশে প্রচলন করা। আর তা না পারলে বিদেশী ফসল সরাসরি দেশে চালাবার চেষ্টা করা। এগুলো এদেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্যের ক্ষতি করছে তা নিশ্চিত, নষ্ট হচ্ছে জমির উর্বরতা। তবে, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন বিভাগ, বা বাংলাদেশ পশুসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট যতদূর শুনেছি ভালই কাজ করছে। যদিও বাস্তবতা জানি না। হাজারো প্রতিবন্ধকতার মাঝেও মাঝে মাঝে আশার আলো দেখা যায়।
এই হচ্ছে আমার দৃষ্টিতে বাংলাদেশে সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা। অনেকেই আমাকে নেগেটিভ মাইন্ডেড বলে মনে করে থাকেন। তবে আমি পজিটিভ চিন্তা করে স্বপনের জগতে বাস করবার চাইতে, নেগেটিভ চিন্তা করে সমস্যার সমাধানে মাথা খাটাতে আগ্রহি।
পরবর্তি পোস্ট