রাত প্রায় দশটা। খারাপ লাগছিল তাই রাতের খাবার অল্প খেয়েই হোটেলের পেছনে চলে গেলাম একাকী। আকাশে চাঁদ নেই। চারিদিকে গাঢ় অন্ধকার, পায়ের নিচে বালু, উপরে রাতের তারা ভরা আকাশ, পেছনে আমাদের অবকাশস্থল আর সামনে বঙ্গপোসাগর। আমি দাঁড়িয়ে আছি সেন্টমার্টিনস্ দ্বীপের সমুদ্র সৈকতে। এখানকার সমুদ্র কক্সবাজারের মত গর্জন করে না, অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট ঢেউ আছড়ে পড়ছে সৈকতে। আধাঁরে দেখা যাচ্ছে না, তবে ওদের আগমন অনুভব করতে পারছি। আমি যে দিকে তাকিয়ে আছি, সেদিক বরাবর যদি যেতে পারতাম তবে বঙ্গোপসাগর অতিক্রম করে ভারত মহাসাগরের উপর দিয়ে ওপারে এন্টার্টিকাতে পৌছতাম। যদিও সে ইচ্ছা আমার তখন হচ্ছিল না।
খোলা আকাশের দিকে তাকালাম। মেঘ মুক্ত আকাশে তারা মিট মিট করছে, পরিস্কার দেখতে পারছি আমাদের নীহারিকা আকাশগঙ্গাকে। এই আকাশ আমাদের সময়ের আকাশ নয়। এ কোটি কোটি বছর আগের আকাশ। আমাদের সময়ের আকাশ দেখতে চাইলে, আরো কয়েক কোটি বছর অপেক্ষা করতে হবে। কি বৈচিত্রময় এ জগৎ! অতীত বর্তমান একই সাথে চলছে।
সামনে বিশাল সমুদ্র। তার দৃশ্য অংশের থেকেও বিশাল তার অভ্যন্তরের জগৎ। সেই সাথে বৈচিত্রময়। প্রতিদিন ভোরে শামুক ঝিনুকের যে খোলগুলো জোয়ার সৈকতে দিয়ে যায়, শুধু ওদের রঙের বাহার দেখলেই মনটা ভরে উঠে, সমুদ্রের অংশটুকু না হয় বাদই দিলাম। সৃষ্টিকর্তা তার ঐশি বানীতে বলেছেন, তিনি নাকি সমুদ্রের জগৎকে আসমানের জগৎ থেকেও বৈচিত্রময় করে সৃষ্টি করেছেন। আসলেও তাই।
পায়ের নিচে সৈকতের বালুকণা। রসায়ন পড়েছি বলে জানি, এ বালুকণা সিলিকন-ডাই-অক্সাইড দিয়ে গঠিত। একটি সিলিকন পরমানুর কথা চিন্তা করলেই, জগতের সব কিছু নাই হয়ে যায়। চোখের সামনে ভেসে উঠে শুধু পরমানুটির কক্ষপথে পরিভ্রমনরত ইলেকট্রন ও কেন্দ্রের নিউক্লিয়াস। সৃষ্টিজগতের সব কিছু এর সামনে নাই হয়ে যায়।
আকাশ সমুদ্র বালুকণা এসবের মাঝে আমাদের পরিবেশ। ছোট বেলায় সমাজ বইতে পড়েছি, “আমাদের চারদিকে যা কিছু আছে মানুষ, ঘরবাড়ি, গাছপালা, নদীনালা, পশুপাখি, পাহাড়-পর্বত, আলো, বাতাস, পানি, সব কিছু মিলেই আমাদের পরিবেশ”। এ পরিবেশ আরো বৈচিত্রময় হয়ে পড়ে যখন এর সাথে যোগ হয় সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, রাগ-ক্ষোভ, প্রেম-ভালবাসা, স্নেহ-আকর্ষণ-ভাললাগা আরো কত কি!!
এই পরিবেশের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশে আমার বিচরণ। এই অতি ক্ষুদ্র অংশেরই অতি ক্ষুদ্র কিছু বিষয় নিয়ে আমি মেতে থাকি। সৃষ্টিজগতের সব বৈচিত্রকে ছাপিয়ে সেগুলোকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে থাকে আমার জীবন। ঐ বিষয় গুলোও এক এক সময় এক এক রকম। কখনো ক্যারিয়ার ভাবনা, কখনো নারীর প্রেম, আবার কখনো সেই নারীরই হটকারীতা, কখনো গোষ্টিগত স্বার্থ, কখনো সাময়িক ভাললাগা বা লালসা, অথবা কখনো বা কোন অজানা কারনে মন খারাপ থাকা। সামগ্রিক জগতের সামনে এই বিষয়গুলো কতই না ক্ষুদ্র!! নিজের উপরই হাসি আসছিল, হেসেও উঠলাম একাকী।
হায়রে! কি নিয়ে মেতে থাকি আমি? নিঃসংকোচে বলতে পারি সমুদ্র তটে আঁধারে সেই রাত্রীতে সব সংকীর্ণতার উর্ধে উঠে গিয়েছিলাম। বিশাল সমুদ্র তার সৈকতে দাঁড়ানো আমার মনের সব সংকীর্ণতাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল তার লোনা জলে। কিন্তু, সৈকততো আর আমার স্থায়ী জগৎ নয়। যে জগতে আমার বাস, সেখানে এত বিশাল মনের স্থান হবে না। মনটাকে ছোট্ট হৃদয়ে বন্ধ করে, আবার ফিরে এলাম সংকীর্ণ মানুষের ভুবনে।