প্রাচীনকাল আর আধুনিকতার সঙ্গে যে ক'টা জিনিস পার্থক্য নিরূপণ করে তার মধ্যে যোগাযোগ অন্যতম। যোগাযোগের ওপর ভিত্তি করেই পৃথিবী আজকের অবস্থানে এসেছে। শিক্ষা থেকে ব্যবসা অথবা যুদ্ধ থেকে শান্তি সবকিছুর সফলতাই নির্ভর করে সহজ যোগাযোগের ওপর। যোগাযোগ যখন হয় দূরবর্তী তখনই প্রয়োজন হয় সংযোগের আর সংযোগের কথা এলেই আসে সেতুর কথা।
এটা কাপ্তাই লেকের ঝুলন্ত সেতু
সহজ যোগাযোগ ধারণার প্রথম অবস্থা থেকেই সেতু একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। এরই মধ্যে আধুনিক স্থাপত্যকলা সেতুর গতানুগতিক ধারণায় এনেছে রূপগত পরিবর্তন। এম পরিবর্তনের এক অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে ঝুলন্ত সেতু। সহজ যোগাযোগ ছাড়াও সৌন্দর্য রক্ষায়ও অন্যতম ভূমিকা রাখে এ সেতু। কাপ্তাই লেকের ঝুলন্ত সেতু বাংলাদেশে তাই সুপরিচিত। পৃথিবীর সব দেশেই এমন সুপরিচিত ঝুলন্ত সেতু রয়েছে যেগুলো দৈর্ঘ্যের পরিমাপে কেড়েছে সবার নজর।
দৈর্ঘ্যের দিক থেকে এখনও সবার ওপরে রয়েছে জাপানের 'আকাশি কাইকিয়ো ব্রিজ'। ১৯৯৮ সাল থেকে স্বমহিমায় নিজের জায়গা ধরে রেখেছে এই ব্রিজ। একে 'পার্ল ব্রিজ' নামেও ডাকা হয়। ১৯৯১ মিটার অর্থাৎ ৬৫৩২ ফিট এই ব্রিজ তৈরিতে সময় লেগেছে পাক্কা দশ বছর। 'হংসু-শিকোকু' হাইওয়ের অংশ আই সেতু কোবের শহরকে হনসুর মূল ভূমির সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছে। সবকিছু রেখে বাতির সংখ্যা শুনলেও অবাক হয়ে যেতে হয়। প্রায় ১৭৩৭ ঐন্দ্রজালিক বাতি রাখা হয়েছে, যার মধ্যে ক্যাবলেই রয়েছে ১০৮৪ বাতি, ১১৬টি রয়েছে মূল স্তম্ভে এবং ৪০৫টি রয়েছে গার্ডারে। এ সেতু তৈরিতে খরচ হয়েছে ৫০০ বিলিয়ন ইয়েন। প্রতিদিন প্রায় ২৩ হাজার গাড়ি টায়ারের ছাপ রেখে যায় এ সেতুতে।
চীনের ‘জিহউমেন ব্রিজ' ঝউসান দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে সমন্বয় করেছে। অনেকগুলো দ্বীপকে একীভূত করেছে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দৈর্ঘ্যের এ ঝুলন্ত সেতু। এ ব্রিজটি ২০০৯-এর ১৬ ডিসেম্বর উন্মুক্ত করে দেয়ার কথা থাকলেও ছোট একটি দুর্ঘটনার জন্য উদ্বোধন হয় ২৫ ডিসেম্বর। দ্বিতীয় দৈর্ঘ্যতম এ সেতু করা হয়েছে মধ্যবর্তী খিলানের দৈর্ঘ্যের ওপর ভিত্তি করে। পাঁচ কিলোমিটারের কিছু বেশি এ সেতু গিয়ে আরও দুই কিলোমিটারের মূল সেতুর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে মধ্যবর্তী খিলানের সঙ্গে যা ১৬৫০ মিটার। এ সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৩৬০ বিলিয়ন ইউএস ডলার।
ডেনমার্কের 'গ্রেট বেল্ট ফিল্ড লিংক' নামক ব্রিজটি জিল্যান্ড এবং ফানেন দ্বীপকে একীভূত করেছে। সড়কের পাশাপাশি রেলসেবাও প্রদান করে আসছে 'ইস্ট রোড' নামে পরিচিত তৃতীয় দৈর্ঘ্যতম খিলান বিশিষ্ট এ ঝুলন্ত সেতু। এশিয়ার বাইরে এটাই সবচেয়ে দৈর্ঘ্যতম মূল খিলানের (১.৬ কিলোমিটার) অধিকারী। এ সেতুর মোট দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৬৭৯০ মিটার। কংক্রিট আর ইস্পাতের মিশেলে তৈরি এ সেতু ১৯৯৮ সালের মধ্যবর্তী সময় থেকে সেবা দিয়ে আসছে। ডেনমার্কের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ এ প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ২১.৪ বিলিয়ন ডেনিস ক্রোন। সেতু থেকে আগত সব আয় সরকারি কোষাগারে না গিয়ে সেতু সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় করা হয়।
দক্ষিণ কোরিয়ার 'সান-সিন ব্রিজ' পুরোপুরি তৈরি হওয়ার আগেই চতুর্থ দৈর্ঘ্যের জায়গা দখল করে নিয়েছে। কোরিয়ার দক্ষিণ উপকূলে নির্মাণাধীন এ সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে ২০১০-এর এপ্রিল থেকে। এ সেতু ইয়েসু কারখানার প্রক্রিয়া রাস্তা হিসেবে পরিচিত। সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হওয়া মাত্র মূল খিলানের দৈর্ঘ্যের শর্ত মোতাবেক চতুর্থ স্থান দখল করে নেবে বলেই সবার ধারণা। সেতুর নামকরণের ইতিহাস বলে কোরিয়ান এডমিরাল 'সান-সিন'র নামেই তৈরি হয়েছে এ ব্রিজ যিনি 'ওৎড়হপষধফ ডধৎংযরঢ়'-এর আবিষ্কারক ছিলেন।
চীনের জিয়াংসু প্রদেশের ইয়াংজি নদীর 'রানইয়াং ব্রিজ' আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ সেতুর সংযোগস্থল। এটি ইয়াংৎজি নদীর দক্ষিণ তীরকে যুক্ত করেছে। তাছাড়া এ সেতু বেইজিং-সাংহাই মোটর রাজপথকে একীভূত করেছে। এ সেতুর মূল খিলান হচ্ছে ১৪৯০ মিটার। ২০০৭-এর পূর্ব পর্যন্ত এটাই ছিল চীনের সর্ববৃহৎ খিলানবিশিষ্ট সেতু। পৃথিবীর পঞ্চম স্থান দখল করে নেয়া এ সেতু ২০০৫-এর মাঝামাঝি সময়ে সবার ব্যবহারের উদ্দেশ্যে খুলে দেয়া হয়। চীনে এ সেতু বর্তমানে দ্বিতীয় স্থানে আছে। সেতুর প্রস্থ ৩৯.২ মিটার যেখানে ৬টি মোটর লেন রয়েছে। পানি থেকে সেতুর দুটি খিলান ২১৫ মিটার উচ্চতায় সবাইকে যেন সেতুর অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। সেতুর মোট দৈর্ঘ্যের পরিমাপ হচ্ছে ৩৫.৬৬ কিলোমিটার। প্রায় পাঁচ বছর সময় নিয়ে তৈরি এ সেতুর মোট ব্যয় ৭০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
খিলান দৈর্ঘ্যের ভিত্তিতে তৈরি তালিকায় এ পাঁচটি সেতুই সবার প্রথমে অবস্থান করছে। শত মানুষের আনাগোনা আর টায়ারের ছাপ যেন প্রতি মুহূর্তেই আমাদের মনে করিয়ে দেয় কত প্রয়োজন সহজ যোগাযোগের। সহজ যোগাযোগের স্বপ্নে মানুষ ডিঙিয়েছে সব ধরনের প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতা, আর তারই প্রমাণ দিচ্ছে আজকের এসব বৃহদাকার সেতু।
পত্রিকায় প্রকাশিত আমার লেখা
ই-পেপার
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১:০৪