বড়দিনের মাঝরাতে কুয়েন্টিন টারানটিনোর নতুন চলচ্চিত্র জ্যাংগো আনচেইন্ড দেখে ফিরলাম। আমেরিকার দাসব্যবস্থা নিয়ে কিছুটা সত্য, কিছুটা কাল্পনিক এক গল্প। এই ছবি দেখে আমার মনে প্রশ্ন জাগল, একাত্তর নিয়ে এমন একটা চলচ্চিত্রের কথা আমরা কেউ ভাবি না কেন?
আমেরিকার দাসপ্রথা স্থায়ী হয়েছিল প্রায় ৩০০ বছর। আফ্রিকা মহাদেশ থেকে তাদের অপহরণের পর জোর করে দাস হিসেবে নিয়োগ করা হয়। অথচ মানুষ হিসেবে তাদের কোনো অধিকার ছিল না। জীবনের দাম ছিল বন্দুকের গুলির চেয়েও কম। তাদের বাঁচা-মরা নির্ভর করত মালিকের খেয়ালখুশির ওপর। সেই দীর্ঘ ও মানবেতর ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের একাত্তরের ঘটনার কোনো তুলনা হয়তো চলে না। কিন্তু এ কথাও তো ভুল নয়, নৃশংসতার বিচারে উভয়ের মধ্যে অমিলের চেয়ে মিলই বেশি। দাস ব্যবসা নিয়ে ‘জ্যাংগো’র মতো ফিল্ম হলে আমাদের একাত্তর নিয়েও সম্ভব। আর কিছু না হোক, সেই ফিল্ম এ কথা স্মরণ করিয়ে দেবে যে একাত্তরে এই রকম এক বর্বরতার বিরুদ্ধে কী অপরিসীম সাহস ও সংহতি নিয়ে যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করতে হয়েছিল! আমাদের দেশে এখনো এমন লোক রয়েছে, যারা একাত্তরের অপরাধ নিয়ে সাফাই গায়। অপরাধী হিসেবে প্রমাণিত হওয়ার পরও যাদের পক্ষে ওকালতি করে বিদেশ থেকে জরুরি বার্তা আসে, এমন লোকের জন্যই দরকার একাত্তরের জ্যাংগো।
ছবিটি আপনারা অধিকাংশই এখনো দেখার সুযোগ পাননি। অতএব গোড়াতে সংক্ষেপে গল্পটি বলি, জ্যাংগো একজন দাস, ড. শুলজ দাসপ্রথাবিরোধী এক শ্বেতকায় ব্যবসায়ী, যার কাজ অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত, এমন লোকদের জীবিত বা মৃত ধরে দেওয়ার বদলে সরকারি পুরস্কার আদায়। শুলজ তার সহকারী হিসেবে নিয়োগ করে জ্যাংগোকে। দ্রুত গুলি চালানো শিখে নেয় জ্যাংগো, খুব সহজেই শুলজের ব্যবসায়ী অংশীদার হয়ে ওঠে সে। শ্বেতকায় দাসপ্রভুদের নির্দয়ভাবে হত্যা করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই জ্যাংগোর। কিন্তু তার আসল লক্ষ্য, মিসিসিপির এক দাসপ্রভু ক্যানারি খামারে আটকে রাখা হয়েছে তার স্ত্রী ব্রুমহিলডাকে। পালাতে চেষ্টা করেছিল, সেই অপরাধে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে খামারের এক অন্ধ কূপে ফেলে রাখা হয়েছে তাকে। মোটা দামে ক্যান্ডির সেরা নিগ্রো কুস্তিগির কিনে নেওয়ার বাহানায় তার বাড়িতে এসে হাজির হয় শুলজ ও জ্যাংগো। ব্রুমহিলডাকে নগদ অর্থে কেনার ব্যবস্থা যখন চূড়ান্ত, ঠিক সেই সময় ক্যান্ডির প্রবল অনুগত নিগ্রো পরিচালক স্টেফান টের পেয়ে যায়। ক্যান্ডিকে জানিয়ে দেয়, পুরো ব্যাপারটাই সানো, কুস্তিগির নয়। এ দুজনের আসল লক্ষ্য ব্রুমহিলডা। এ নিয়ে কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে শুলজের হাতে নিহত হয় ক্যান্ডি। শুলজও নিহত হয় ক্যান্ডির দেহরক্ষীদের হাতে। আবার ধরা পড়ে জ্যাংগো, তাকে বিক্রি করে দেওয়া হয় নতুন দাসপ্রভুর কাছে। চালাকির আশ্রয় নিয়ে মুক্ত হয়ে ফিরে আসে জ্যাংগো, ক্যান্ডির খামারের প্রত্যেক সাদা রক্ষী ও বাসিন্দাকে খুন করে জ্বালিয়ে দেয় সে খামার ও বসতবাড়ি, মুক্ত করে আনে ব্রুমহিলডাকে।
আমেরিকার নিগ্রো দাসদের প্রতিরোধের ইতিহাস সুপরিচিত। মানুষের ইতিহাস, অথচ কালো মানুষের কণ্ঠস্বর সেখানে কার্যত অনুপস্থিত। কখনো রক্ষণশীল, কখনো উদারনৈতিক শ্বেতকায় ঐতিহাসিকের লেখা সে ইতিহাসে কোনো জ্যাংগোর কথা আমরা পড়িনি। দাসপ্রথা নিয়েও বিস্তর ফিল্ম হয়েছে, তার অধিকাংশই মুখ্যত দাসপ্রথাবিরোধী সাদা মানুষের ভূমিকার জয়গান। যেমন, এই এখন চলছে স্টিভেন স্পিলবার্গের নতুন ছবি লিঙ্কন। আমেরিকার গৃহযুদ্ধে মহানায়ক আব্রাহাম লিঙ্কন, যাঁর ‘মুক্তি সনদের’ মাধ্যমে ১৮৬৩ সালে সরকারিভাবে আমেরিকার দাসপ্রথার অবসান হয়, এই ছবি তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবনত অঞ্জলি। এই ছবিতে নিগ্রো দাসদের অভাব নেই। কিন্তু তারা সবাই শ্বেতকায় রাজনীতিক, তাদের মুক্তিদাতা, লিঙ্কনের প্রতি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। প্রায় বিদ্বেষহীন একদল মানুষ। কয়েক শ বছর ধরে তাদের জন্তুর মতো আটকে রাখা হয়েছে, বাঁচা-মরা—সবই নির্ভর করেছে দাসপ্রভুর দয়ার ওপর। এখন সেই নির্যাতন থেকে মুক্ত হয়ে, সাদা রাজনীতিক লিঙ্কনের প্রশংসায় তারা পঞ্চমুখ।কোনো ক্রোধ নেই, কোনো হিংসা নেই। ঘৃণার আগুনে জ্বলে যাওয়া, পুড়ে যাওয়া সেসব মানুষের রক্তক্ষরণের কোনো প্রমাণ নেই, জ্যাংগো সে রকম কোনো কালো মানুষ নয়। তার খামারে নিগ্রো দাসেরা কেন বিদ্রোহ করে না, বিদ্রূপের সঙ্গে সে প্রশ্ন করে ক্যান্ডি। জ্যাংগো তার সে পরিহাসময় প্রশ্নের জবাব। সে প্রতিহিংসা চায়। যারা তাকে শিকলে আটকানো কুকুরের মতো ব্যবহার করেছে, তাদের সে কুকুরের মতো হত্যা করতে চায়। যারা তার স্ত্রীকে নিজেদের ফুর্তির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করেছে, তাদের প্রত্যেককে টিপে টিপে খুন করতে চায়। শুধু দাসপ্রভুদের নয়, যে খামারে তার স্ত্রীকে আটকে রাখা হয়েছিল, তার প্রতিটি শ্বেত বাসিন্দা ও অনুগত নিগ্রোদের হত্যা করার পর পুরো খামারটিকে জ্বালিয়ে দেয় জ্যাংগো। দাউ দাউ পোড়া সে আগুনের দিকে শেষবারের মতো পরিহাসের চোখে তাকায় সে। তারপর সদ্য মুক্ত স্ত্রী ব্রুমহিলডাকে নিয়ে পা বাড়ায় অজানার উদ্দেশে।
টারানটিনোর ফিল্ম যাঁরা দেখেছেন, সেলুলয়েডরা পর্দায় খুনখারাবি নিয়ে তাঁর বাড়াবাড়ির কথা সবাই জানেন। তাঁর ২০০৯ সালের ফিল্ম ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস-এর বিষয়বস্তু ছিল ইহুদিদের বিরুদ্ধে নাৎসি জার্মানদের নির্মমতার জবাবে সহিংস প্রতিশোধ। নাৎসি খুনেদের অপরাধের জন্য কোনো আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের প্রয়োজন তাঁর নেই। যে ভাষা নাৎসিরা সবচেয়ে ভালো বোঝে, ঠিক সেই ভাষায়, বন্দুকের গুলিতে ঝাঁঝরা হওয়া আগুনের উৎসবে, তিনি সেই খুনেদের অপরাধের জবাব দিয়েছেন। ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটেনি তো কী হয়েছে, ঘটা উচিত ছিল। শিল্পী হিসেবে নিজের ক্যামেরাকে বন্দুক হিসেবে ব্যবহার করে সেই ঐতিহাসিক দায়িত্বই পালন করেছেন তিনি।
একই কথা জ্যাংগো নিয়ে। কালো মানুষের রক্ত নিয়ে যারা হোলি খেলেছে, তাদের একমাত্র জবাব তাদের রক্তে পাল্টা হোলি খেলা। জ্যাংগো আনচেইন্ড ছবিতে একদিকে আমরা দেখি দাসপ্রভুদের অত্যাচার। দেখি, প্রত্যেক নিগ্রো রমণী কেবল দাসপ্রভুর ব্যক্তিগত সম্পদ নয়, ভোগের উপকরণও। দেখি, রক্তভুক কুকুর লেলিয়ে বেয়াড়া দাসকে শায়েস্তা করার দৃশ্য। পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টার অপরাধে মুখে গনগনে আগুনের ছ্যাঁকা। শুধু তাদের মনোরঞ্জন হবে, সে জন্য নিগ্রো দাসদের মধ্যে নিষ্ঠুর কুস্তি, যেখানে প্রতিপক্ষকে খুন না করা পর্যন্ত লড়াই শেষ হয় না।
জাংগোর হাতে একেকজন দাসপ্রভু নিহত হয়। তার আগুনে পোড়া, গুলিতে ছিন্নভিন্ন দেহ দেখে আমরা উল্লসিত হই। যে ক্রোধ জ্যাংগোর মনে দাউ দাউ করে জ্বলছে, আমাদের মনেও তা আগুন ধরায়। হত্যা-নিষ্ঠুর, নির্দয় ও নির্বিকার—তা যে এমন স্বস্তিদায়ক হতে পারে, আগে কখনো দেখিনি। জ্যাংগো আমাদের চোখে নায়কের রূপ গ্রহণ করে। যে মুক্তি তার প্রকৃতিদত্ত, যে স্বাধীনতা তার স্বভাবজ, জাংগো তাকে কারও কৃপায় নয়, নিজ পেশির জোরে দখল করে নেয়। হোক না হলিউডি ফিল্মের নায়ক, কিন্তু এই প্রথম একজন নিগ্রো দাসকে পেলাম যে শ্বেতকায় দাসপ্রভু বা রাজনীতিকের কারুণ্যে মুক্তি পাওয়ার বদলে নিজের মুক্তি ছিনিয়ে আনে। সে শ্বেতকায় মুক্তিদাতার প্রতি কৃতজ্ঞবশ্যতায় তাকায় না, নির্দয় অহমিকায় তার বিজয় পতাকা ওড়ায়।
না, এ রকম কোনো জ্যাংগোর কথা ইতিহাসে নেই। না থাক, কিন্তু তাকে কল্পনা করতে আমাদের কোনো ক্ষতি নেই। পৃথিবীর অধিকাংশ ইতিহাস লেখা হয় বিজয়ী প্রভুর চোখে। বিজিত, পরাজিত মানুষের কথা সে ইতিহাসে নেই। কিন্তু এ কথা কে না জানে, সব বিজয়-তোরণের প্রতিটি স্তম্ভ নির্মিত সাধারণ মানুষের রক্তে, তাদের ত্যাগে, তাদের মৃত্যুতে। একজন জ্যাংগো যে সেখানে ছিল না, এমন কথা জোর করে বলি-ই বা কী করে?
একজন জ্যাংগো, সত্যি অথবা কাল্পনিক, তাকে প্রয়োজন শুধু রক্তপাতের উৎসবের পুনর্মঞ্চায়নের জন্য নয়, বরং নতুন সময়ের নাগরিকদের সেই গভীর দুঃসময়ের কথা ও তার প্রতিরোধে সাধারণ মানুষের সাহসী ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিতে। শুধু গতকাল নয়, আজকের জন্যও জ্যাংগো প্রাসঙ্গিক। আমেরিকায় এখন আর দাসপ্রথা নেই, তা আমরা জানি। কিন্তু সাদা-কালোর যে পর্বত-প্রমাণ বৈষম্য এখনো বিদ্যমান, তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার জন্যও একজন জ্যাংগোকে প্রয়োজন।
জ্যাংগো দেখে আমার একাত্তরের কথা মনে হয়েছে। সে লড়াইয়ে আমরা দানবের বিরুদ্ধে জয়ী হয়েছিলাম, আমাদের সঙ্গে ছিল এক নয়, অনেক জ্যাংগো। তাদের শৌর্য ও শক্তি আমাদের বিজয়ী করেছে। কিন্তু সেসব জাংগোর সবার গল্প এখনো বলা হয়নি, যেমন বলা হয়নি একাত্তরের দানবদের নির্মমতার কথা। সেই ইতিহাসকে নতুন করে কল্পনা করার দায়িত্ব শিল্পীর, লেখকের, কবির। শিল্প কেবল একটি আয়না নয়, যেখানে চোখে দেখা বাস্তবতার প্রতিফলন হবে। ব্রেখট শিখিয়েছেন, শিল্প হলো হাতুড়ির মতো, তার কাজ দৈনন্দিন বাস্তবতাকে দুমড়েমুচড়ে শিল্পীর নিজের স্বপ্ন ও বিশ্বাসের আদলে পুনর্নির্মাণ করা।
আমরা এখনো অপেক্ষায় সেই রকম একজন শিল্পীর। আমরা অপেক্ষায় একজন জ্যাংগোর।
লিখেছেন: হাসান ফেরদৌস
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:০৩