(প্রথম আলোর সমস্ত নীতি অমান্য করে গল্পটি লেখা হলো)
ক্যামেরার সেই রাগী মেয়েটি এখন অনেক নিষ্প্রভ। তার চোখ অনেক দেখেছে। শরীর অনেক বুঝেছে। কিন্তু স্বপ্ন এখনও মরে যায়নি। সেটাকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রাণপন চেষ্টা করছে। তার বুনোচেহারা আর অঙ্গপ্রত্যঙ্গের উঠানামা আরো বন্য হয়ে উঠতে চায়।
কিন্তু শব্দবনিক তাকে আবারও রক্তাক্ত করেছে - প্রকৃত সত্যটি উন্মোচন করার মাধ্যমে। আবার অনেক চাপে ক্ষমা প্রার্থনাও করেছে। তাতে তার কোনো উপকারে আসেনি। বরং গল্পেরছলে যে সত্যটি প্রকাশ পেয়েছিল, প্রত্যাহারের মাধ্যমে তা আরো সত্য বলেই প্রমানিত হলো। এতে মেয়েটির ক্ষতি হয়েছে সবচে বেশি। যারা কাদাময় ঘৃণা তৈরি করে রাজনীতির বাণিজ্যসেতু নির্মাণ করতে চায় তারাই মেয়েটিকে সবচে বেশি পচিয়েছে। নারীত্ব এমন একটি অহংবোধের জায়গা যেটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বা এর সুবিধাভোগীরা কোনো কালেই তাদের সামন্তভাবনা থেকে মূল্যায়ন করতে পারেনি।
মেয়েটির নীলাভ ক্ষত নিয়ে কিছুটা বিমূর্ষ। পায়ের তলায় তেতলে যাওয়া ঘাসের মতোই সে মেরুদন্ডহীন এক উপত্যকায় বাস করছে। অবস্থা ও পরিস্থিতির কারণে সে এখান থেকে আর পালাতেও পারে না। একটু উচু মতো একটি জায়গায় বসে সহপাঠির ফেলে যাওয়া এক টুকরো সিগরেটে দম দিচ্ছিল। এক পিচ্ছি ফেরিওয়ালা দিদি বলে হাত বাড়ায়। তার হাতে একটি পুতির মালা ধরা। মেয়েটি ইশারায় না করে, লাগবে না। ছেলেটি তবু ধরে রাখে। ইশারায় বলে, পয়সা লাগবে না।
কেন রে লাগবে না?
না, দিদি। তুমি গলায় ঝুলায়া রাখো, আমি টিভিতে দেখুমনে।
কী?
আমার কিছুই দেওনের নাই। তুমি যখন ফাসি চাই ফাসি চাই কইয়া চিল্লাইবা, আমার মালাটিও সেই সঙ্গে ঝুইলা রইবো। আমার ভালা লাগবো।
মেয়েটির চোখে পানি আসে। হাত বাড়িয়ে মালাটা নেয়। এই তো সে পেয়েছে তার কাজের স্বীকৃতি। মাস্তান দলবাজরা তাকে ব্যবহার করলেও এই ছেলেটি তার পবিত্র সত্ত্বা দিয়ে অনুভব করেছে। সে মালাটি গলায় ঝুলিয়ে নিতে নিতে ছেলেটির মাথা নেড়ে দেয়।
মঞ্চ থেকে ফাটাফাটি চিৎকার ভেসে আসছে। কে এখন মাইকে, সরকার? হ্যা, ওটা তো সরকারেরই গলা। ফেসফেসে। দৃপ্তহীন। মেয়েটির মুখে একটি গালি আসতে আসতে আবার আটকে যায় গলার জিবের তলানিতে। তবু মাইকের কাছাকাছি যেতে হবে। এবারের এই সমুদ্র যাত্রা থেকে ফেরার কোনো পথ নাই - এই ভেবে সে নিজেকে সময়ের জন্য প্রস্তুত করে। একটি মৃদু ধাক্কা সে পিছন থেকে অনুভব করে। আমলে নেয় না। অনেকটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। সন্ধ্যা তখনও পুরোপুরি ঘনিয়ে আসেনি। মাইকের চড়া আওয়াজ জানান দিচ্ছে আজ নতুন কোনো কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে। এ নিয়ে একটা উত্তেজনা ছড়িয়ে আছে পুরো চত্বর জুড়ে। কোনো কর্মসূচী ঘোষণার পূর্বে যে উত্তাপটা থাকে তা ধরে রাখার একটা প্রাণপন চেষ্টা সবার মধ্যে। বামনটা মঞ্চের গুড়ালিতে বসে এখনো ঝিমুচ্ছে। এতো বেশি টানে যে তার চোখ টেনে তোলার তাক্কত নাই। মুখের সামনে ল্যাপটপটা এখনো উন্মুক্ত। কী লিখছে? এ বামনটা তো গল্প বানাতে উস্তাদ যার সবটা জুড়ে কেবল খিস্তিখেউড় উগলানো থাকে।
সন্ধ্যার আলো নিভে যাবার আগে ক্যামেরার মেয়েটিকে একটা ভয় এসে চেপে ধরে। আবার সঙ্গীদের হৈচৈ আর অশ্রাব্য উচ্চারণে বুঝেছে সবই একটা ফান। একটা এডভাইঞ্চারের মধ্যে রাত্রিটা কাটবে। অতপর রাত্রি যত ঘনায় উত্তেজনায়, আলোআধারির ছায়াতলে রহস্যময়ী হয়ে উঠে প্রতিটি মানুষের মুখ। তাদের পদচারণার ভঙ্গি, ঘন-ঘন নিশ্বাস, দাতখিলানো হাসি, হাটতে হাটতে বুতল নিঃশেষ করার অভিনব কসরত, সিগারেটের টবাকো ফেলে দিয়ে তার ভেতর মাড়ানো গাজা ঢুকিয়ে দিয়ে দম মারো দম’র ঘোর লাগতে থাকলে, ক্যামেরার মেয়েটি নিজের ছোট্ট পুটলি থেকে ম্যাস থেকে আনা নক্সিকাথায় গা মুড়ে শুয়ে থাকতে মনোস্থির করে। যেহেতু এখানেই তারা অবস্থান নিয়েছে, এই চত্বরেই তাদের অমীমাংসিত সময় কাটাবে। তারা প্রতিশোধের উন্মোক্ত তলওয়ার দিয়ে সবাইকে জবাই করবে যক্ষণ না তাদের দাবী পুরণ হবে। বেশ দূরত্ব রেখে একেকটা জটলা হচ্ছে। জটলাগুলো এখন নুয়ে আসা, ক্লান্ত, ঘুমঘুম অবস্থায়। চোখের ভেতর দূরের বাতিগুলো ঝাপসা ও রঙের ক্যানভাস মিলিয়ে যাবার আগেই সে বুঝতে পারে কেউ একজন তার কাছ ঘেসে বসেছে। ভালোই লাগে তার। কেউই আর অপরিচিত নয়। বিষয়ে ও কর্মে সবাই এখন সমমনা। আজ তারারা ফুটেনি। নক্সিকাথার ভেতর ফুটে আছে কয়েকটা মাছরাঙা আর ইলিশের ঝাক। করতলে ধাতব মাইক্রফোন ...। একটা মৃদু চাপে ক্যামেরার মেয়েটি তন্ত্রা ছুটে যায়।
- ঘুমালে নাকি?
পাশ থেকে ছেলেটি ফিসফিস করে বলে। শঙ্কিত গন্ধে তার ঘুম পালায়। নক্সিকাথার ভেতর একটা আতঙ্ক জেগে উঠে।
কয়েক রাত্রি পার হবার পর সে বুঝতে পারে এখানেও তার জীবন সীমাবদ্ধ। নারীত্ব অরক্ষীত। এখন তুখোড় ছাত্রনেতা, যিনি বাম বাম করে ফেনায়িত মুখে অশ্রাব্য গালিগালাজ করেন রাতেও তার শরীর থেকে অশ্রাব্য গিনিপিগের গন্ধ বেরুতে থাকে।
ক্যামেরার মেয়েটি ক্যামেরা দেখলে এখন আর ঝলসে উঠে না। বরং নিষ্প্রভ চোখটি ভীতু হয়ে উঠে। রাগটা এখন এক শব্দবনিকের উপর আছড়ে পড়ছে। তারচে রাগটা সরকারের উপরও পড়েছিল। সব কিছু ছাড়িয়ে সকল রাগ রাজাকারদের উপর ছুড়ে মারে। শালারা যদি না থাকতো তাহলে তাকে আজ এমন দলবাজ মাস্তানদের খপ্পরে পড়তে হতো না। হঠাৎ একটা শান্তি খোজার আপ্রাণ চেষ্টা চালায় মেয়েটি। পেয়েও যায়। খুব শস্তা। তবু মন্দের ভালো। এটি একটি দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ। আর সে এই মুক্তিযুদ্ধের প্রথম বীরাঙ্গনা। তারপর হাসতে হাসতে বিড় বিড় করে উঠে, তাও আবার স্বপক্ষকর্তৃক ...। স্বপক্ষকর্তৃক সম্ভ্রমহানীর ঘটনা রোকেয়া প্রাচীররা জানেন না। খবরও রাখেন না। তারা তো মঞ্চের মানুষ, রঙের মানুষ। মঞ্চের পেছনের সংবাদ তাদের জানা থাকার কথা নয়। অথবা জানলেও তাদের মিশন বাজার পাবে না – এমনই এক চতুরতার মধ্যে তারা তথাকথিত প্রগতির অনুশীলন করছেন। মেয়েটি বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছে স্বপক্ষের কাউকে, অন্তত বিবেচনাবোধ সম্পন্ন কাউকে বিষয়টি খুলে বলে। পারেনি। সবাই এক উন্মাদ সময় পার করছে। তার কথা শুনার ফুরসত নাই কারোরই। এটি বেশি জানাজানি হলে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির অনেক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে – এমন ইশারাও দিয়েছেন অনেকে। আমাদের যেনতেনভাবে প্রতিশোধটা নিতেই হবে। তাতে বিচার বা অবিচার, কিন্তু অথবা যদি-টদির ধারধারি না বলেই আমরা অন্ধকারের প্রলয়ের ভেতর সব শেষ করতে চাই। মীমাংসা করতে চাই।
এসব বক্তব্যের সঙ্গে একমত না হয়েও ক্যামেরার মেয়েটি একই সঙ্গে যাত্রা শুরু করেছে, যে যাত্রা মীমাংসা নয়, বরং যুদ্ধাপরাধের বিচার-প্রক্রিয়া আরো আরো জটিল ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠতে বাধ্য। কিন্তু এসব কারোর ভাবনার মধ্যে নেই। এখন বিচার মানি সীমানার তালগাছটি পাবার মানসে সবাই অস্তির।
বিশাল চত্বর জুড়ে আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ে, ফাসি চাই ফাসি চাই। ক্যামেরার মেয়েটি কান দুটো চেপে রাখে। তার চোখে ভাসছে ফিনকি দেয়া গলগলে রক্ত। জবাই করা রক্তে তার জঙ্গা ভেসে যাচ্ছে। দাত খিচিয়ে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত উর্ধ্বে তুলে মেয়েটি স্বজোরে চিৎকার মারে – ‘জবাই কর, সবকটারে জবাই কর ...। আজকের সন্ধ্যার পরে যেনো আর অন্ধকার নেমে না আসে। দলমাস্তানরা যেন আর চড়াও হবার সুযোগ না পায় ... জবাই কর, সবকটাকে জবাই কর ...। এই দলীত ঘাষের সঙ্গে আর দলীত হতে চাই না ... তোরা আমারে মুক্তি দে ...।’
মেয়েটি মুক্তি পায়নি। বরং একসময়ের চড়া ও রাগী কণ্ঠের আওয়াজটি শতকণ্ঠের দলানিতে আরো তলিয়ে যাচ্ছে, তলাচ্ছে কাদাময় এক অন্ধকারের দিকে।