সরকার একদিকে যদিও বলে যাচ্ছে বিশেষজ্ঞদের মতামত ও জাতীয় স্বার্থ নিশ্চিত করেই কয়লা উত্তোলন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে, কিন্তু সংসদীয় কমিটি অব্যাহতভাবে উন্মুক্ত খনির পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। উন্মুক্ত খনির পক্ষে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছেন অর্থমন্ত্রীসহ সরকারের নানা সদস্য।
দ্বিতীয়ত, ফুলবাড়ীর কয়লা খনির ওপর লন্ডনে এখনও শেয়ার ব্যবসা করছে এশিয়া এনার্জি (জিসিএম)। মাদক ব্যবসা, ফটকাবাজারী ও সন্ত্রাসীদের সাথে যুক্ত নানা তহবিল সংস্থা এর অংশীদার। আমরা এযাবতকালের সকল সরকারকে অবৈধ জালিয়াতিপূর্ণ বাংলাদেশবিরোধী এই অপতৎপরতা বন্ধ করবার দাবি জানিয়েছি। কিন্ত তার বদলে সব সরকারই জনগণ বিতাড়িত কোম্পানিকে পুনর্বাসন করবার অপচেষ্টায় লিপ্ত থেকেছে। শেয়ার ব্যবসার মুনাফার একাংশ ছড়িয়ে দেশে দালাল লুম্পেনদের তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। মুখচেনা কতিপয় কনসালট্যান্ট, সাংবাদিক, মন্ত্রী , আমলা এখন দেশের সর্বনাশ করে কোম্পানির স্বার্থরক্ষায় সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। কোন কোন বিজ্ঞাপনী সংস্থা ও মিডিয়াকেও এই জাতীয় স্বার্থবিরোধী তৎপরতায় যুক্ত দেখা যাচ্ছে।
মার্কিন দূতাবাসের ভ’মিকাও এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সাবেক রাষ্ট্রদূত মরিয়াটি প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানী উপদেষ্টাকে এশিয়া এনার্জির উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ফুলবাড়ীর কয়লা উত্তোলনের জন্য যে চাপ দিয়েছেন, এবং জ্বালানী উপদেষ্টা যে সে অনুযায়ী কাজ করবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা উইকিলিকসেই প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমান মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা বিভিন্ন সভা সমাবেশে প্রাসঙ্গিক অপ্রাসঙ্গিকভাবে যেভাবে এই প্রকল্পের পক্ষে চাপ দিয়ে যাচ্ছেন তাতে এটা বোঝা যায় যে, তিনিও কোম্পানির লবিষ্ট হিসেবেই কাজ করছেন।
তৃতীয়ত, সরকারের কাছে তথাকথিত বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্ট আজ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে জমা দেয়া হয়নি। সংবাদপত্রে প্রকাশিত তাদের সিদ্ধান্তেও এশিয়া এনার্জির প্রকল্পের পক্ষে কোন সুপারিশ দেখা যায় নি। অথচ গত ১৪ অক্টোবর তারিখ দেয়া এক সার্র্কুলারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দিনাজপুর জেলা ও ফুলবাড়ীসহ ৪ থানায় এশিয়া এনার্জি যাতে নির্বিঘেœ জরীপ কাজ চালাতে পারে তার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে নির্দেশ পাঠিয়েছে। সার্কুলার দেখে মনে হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এশিয়া এনার্জির লাঠিয়াল বাহিনীর ভূমিকায় অবতীর্র্ণ হতে চায়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, এশিয়া এনার্জি নামের এই কয়লা খনি বিষয়ে অনভিজ্ঞ, জালিয়াত ও খুনি কোম্পানি বহিষ্কার এবং উন্মুক্ত খনি নিষিদ্ধসহ ৬ দফা ফুলবাড়ী চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে জনগণের কাছে অঙ্গীকার করেই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় এসেছেন।
চতুর্থত, পরিবেশগত সমীক্ষার ন্যুনতম শর্ত ভঙ্গ করে, জোরপূর্বক মানুষ উচ্ছেদ করে, সুন্দরবনসহ বাংলাদেশের সর্বনাশ করে ভারতের কোম্পানিকে সুবিধা দিতে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে সরকার যে তৎপরতা দেখাচ্ছে তা একইসঙ্গে জাতীয় স্বার্থবিরোধী ও বেআইনী।
এখানে রামপাল প্রকল্প নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী তিনটি গুরুতর সমস্যার প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। (১) প্রকল্পটি বহুদিক দিয়ে ও অনিবার্যভাবে বিশ্বের অমূল্য সম্পদ ও দেশের পরিবেশগত প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা বর্ম সুন্দরবনকে ধ্বংসের মুখোমুখি করবে। (২) চুক্তিটি ভারত পক্ষকে কয়লার কলুষিতা থেকে মুক্ত রেখে আর্থিকভাবে লাভবান করবে ঠিকই, কিন্তু বাংলাদেশকে সুন্দরবনের অপূরণীয় ক্ষতি সহ সন্নিহিত পশুর নদীর পানি দূষণ, ভূগর্ভস্থ জলাধারকে নিম্নগামী ও শুন্য করা, খাদ্য নিরাপত্তা হ্রাস করা, এলাকার মানুষের আশ্রয় ও জীবিকা হরণ ইত্যাদি ক্ষতিবহন করতে হবে যা তথাকথিত লাভের তুলনায় লক্ষ গুণ বেশি। তাছাড়া প্রকল্পটিতে বাংলাদেশের দেয় বিদ্যুতের মূল্যের অনির্দিষ্টতা ছাড়া আরও বহুদিক দিয়ে চুক্তিটিতে অনির্দিষ্টতা ও অনিশ্চয়তা পুরে রাখা হয়েছে। এবং (৩) প্রকল্পের শুরু থেকেই ভূমি অধিগ্রহণ আইন লংঘন ও মানবাধিকার লংঘন করে পরিবেশ পরিণাম সমীক্ষার পূর্বেই বলপূর্বক প্রকল্পের জমি জবরদখল, প্রতিবাদী এলাকাবাসীর উপর সীমাহীন অত্যাচার নিপীড়ন চলছে।
আমাদের প্রশ্ন, এই প্রকল্প যদি দেশের উন্নয়নের স্বার্থেই করা হবে তাহলে পরিবেশগত সমীক্ষা নিয়ে সরকারের এতো ভয় কেন? জনগণের উপর জুলুম নিপীড়ন কেন? নানা বিষয়ে অনির্দিষ্টতা, গোপনীয়তা বজায় ও সুনির্দিষ্টভাবে আইন লংঘন কেন? (আপনাদের অবগতির জন্য এই বিষয়ে আমাদের বিস্তৃত বিশ্লেষণযুক্ত পুস্তিকা দেয়া হল।)
‘বিশেষজ্ঞ কমিটি’র রিপোর্ট আসলে কাদের ও কীজন্য?
গত ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১১, সরকার বাংলাদেশের কয়লা খনি সমূহের ভ’তাত্ত্বিক ও পরিবেশগত অবস্থা, কয়লা উত্তোলনের বিভিন্ন দিক এবং বাংলাদেশের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে উন্মুক্ত খনির ঝুঁকি ও সম্ভাবনা ইত্যাদি বিষয়ে বিশ্লেষণ করে মতামত প্রদানের জন্য একটি কমিটি গঠন করে। ২০১২ সালের জানুয়ারী মাসে প্রস্তুত রিপোর্টের বিভিন্ন অধ্যায়ে বিশেষজ্ঞ বিশ্লেষণে বাংলাদেশে উন্মুক্ত খনির ভয়াবহ ঝুঁকি যথাযথভাবেই আলোচিত হয়েছে। কিন্তু বিস্ময়করভাবে উপসংহারে গিয়ে বিশ্লেষণের বিপরীতে গিয়ে উন্মুক্ত খনি ও বিদেশী কোম্পানির পক্ষেই সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, রিপোর্ট সরকারের কাছে জমা দেবার আগেই উন্মুক্ত খনি ও বিদেশী কোম্পানির পক্ষের সিদ্ধান্ত পত্রপত্রিকায় ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়েছে। আমরা তাই নিশ্চিত যে, যারা এই কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করতে চেয়েছিলেন তাদের চাপের মুখে রেখে কমিটির ভেতর ও বাইরে থেকে কোম্পানির লবিষ্টরা রিপোর্টটিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে সবরকম ক’টকৌশলের আশ্রয় নিয়েছে।
বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্টের ভেতরে উন্মুক্ত খনির বিপদ সম্পর্কে যা যা বলা হয়েছে তার কয়েকটি এখানে উল্লেখ করলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। বলা হয়েছে:
“বাংলাদেশের কয়লা মজুদের ক্ষেত্রে এটা ঠিক যে উন্মুক্ত খনি কয়লা উত্তোলনের হার অনেক বৃদ্ধি করে বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয় হতে পারে, কিন্তু পরিবেশের বিপর্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক ও প্রতিবেশগত ক্ষতি বর্ধিত কয়লা উত্তোলনের থেকে প্রাপ্ত সুবিধার তুলনায় অনেক বেশি হতে পারে। যদিও বৈজ্ঞানিক যুক্তি তর্কে এটা বলা সম্ভব যে, স্ট্রীপ মাইনিংয়ে কয়েক বছর পরেই ভুমি আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব, কিন্তু বাস্তবে মাটির উপরের স্তর সরিয়ে ফেলার পর জমির উর্বরতা পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা অসম্ভব হতে পারে।…উন্মুক্ত খনির ক্ষতি এতো বেশী যে তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।” (পৃষ্টা ১৫)
ফুলবাড়ীর কয়লা প্রকল্পের মারাত্বক ঝুঁকি সম্পর্কে কয়েকটি পয়েন্ট উল্লেখ করা হয়েছে:
“১. পানি শূন্য করার প্রভাবের মাত্রা ও পরিমাণ পুরোটাই অনিশ্চিত।
২. পানিতে দূষণের মাত্রা পরিবেশগত ভয়াবহ বিপর্যয় আনবে।
৩. ভূগর্ভস্থ পানি তোলার ফলে কোথাও হস্তচালিত নলক’প কাজ করবে না। তা ছাড়া পানি সরবরাহের যে নেটওয়ার্ক আছে তা দূষিত হবার কারণে মানবিক বিপর্যয় ভয়াবহ (Catastrophe) হবে।
৪. সমগ্র অববাহিকা জুড়ে ভূগর্ভস্থ ও ভূপরিস্থ পানি দীর্ঘ মেয়াদের দূষণের শিকার হবে।
৫. বিশাল আকারের বর্জ্য মজুদ বোমার মত অবস্থা তৈরী করবে।
৬. প্রায় দশ লক্ষ মানুষের পূনর্বাসন জটিলতা সামাজিক অস্থিরতা ও সংঘর্ষের উচ্চ মাত্রার ঝুঁকি তৈরী করবে” (পৃ: ৩০)
৭. “৩৮ বছর ধরে প্রতিদিন ৮০ কোটি লিটার ভূগর্ভস্থ পানি প্রত্যাহার করতে হবে” (পৃ: ৫২)
“উন্মুক্ত খনির খরচ কম কিন্তু পরিবেশের জন্য তা খুবই ক্ষতিকর। এতে অতিরিক্ত বর্জ্য (Over burdens) ফেলার জন্য বিশাল জায়গার প্রয়োজন হয়। হিসাব অনুযায়ী অতিরিক্ত বর্জ্য ও কয়লার অনুপাত হচ্ছে ২৫:১। অর্থাৎ ১ মে. টন কয়লা উত্তোলনের জন্য ২৫ মে. টন সরাতে হবে। এই ভূগর্ভস্থ দ্রব্য যেগুলো প্রধানত দূষিত, তা রাখতে হবে পাশ্ববর্তী কৃষি জমি জলাশয় ও নদীতীরে। এগুলো যে শুধুমাত্র আশেপাশের জলাশয়কে দূষিত করবে তাই নয়, তার নীচের দিকের সকল নদী, খাল ও জলাভ’মিকে ভয়াবহ মাত্রায় দূষিত করবে। …বৃষ্টির কারণে অনেক বর্জ্য পানিতে ধুয়ে যাবে এবং তা জমি, নদী, জলপ্রবাহ, নদীকে বিষাক্ত করবে।” (পৃ ৪৯)
রিপোর্টে ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্পের লাভক্ষতির হিসাব দেখানো হয়েছে এভাবে, “এশিয়া এনার্জি বিনিয়োগ করবে ৯৩০০ কোটি টাকা, কিন্তু লাভ করবে কমপক্ষে ১,৪২,১০০ কোটি টাকা। শুধু মাত্র কৃষি আবাদের ক্ষতিতে ৫০ বছরের ক্ষতি হবে ২৫,০০০ কোটি টাকা।” (পৃ: ৫০)
ভূগর্ভস্থ পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়েছে:
“ভূগর্ভস্থূ খনি পদ্ধতিতে ভূমি ধ্বস একটা অনিবার্য সমস্যা। তবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে এটা কমানো সম্ভব….অতীতে এ বিষয়ে খুবই ভুল প্রচারণা চালানো হয়েছে যে ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে মাত্র ১০% কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব। ৯০% কয়লা মাটিতেই পড়ে থাকবে। এটা খুবই ভুল তথ্য। ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিরও বিভিন্ন দিক আছে। রুম ও পিলার পদ্ধতিতে ৫০% কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব। যান্ত্রিক লং ওয়াল পদ্ধতিতে এটা ৭০% উঠতে পারে। ” (পৃ: ৪৩)
মালিকানা বিষয়ে:
“দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে রয়্যালটির ভিত্তিতে কয়লা উত্তোলনে বিদেশী ঠিকাদারকে অনুমতি দান যৌক্তিক নয়। খনিজ সম্পদ, তেল, গ্যাস ও কয়লার মালিক দেশের জনগণ। এসব ক্ষেত্রে রয়্যালটি গ্রহণ করলে বিদেশী বিনিয়োগকারীর কয়লা ও গ্যাসের মালিকানা অনুমোদিত হবে যা তারা রপ্তানী করবে। এটা সংবিধান বিরোধী।” (পৃ: ৪৬)
এতোসব ভয়াবহ ঝুঁকি ও ক্ষয়ক্ষতির কথা স্বীকার করবার পরও রিপোর্টের শেষে গিয়ে বড়পুকুরিয়ায় বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে উন্মুক্ত খনন করবার প্রস্তাব করা হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, ভেতরের অংশ বিশেষজ্ঞ মতামত আর উপসংহার কোম্পানির।
অবিলম্বে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের সার্কুলার প্রত্যাহার করতে হবে
আমরা বরাবরই বলে আসছি যে, একটি দুর্বত্ত জোট উত্তরবঙ্গ উন্নয়নের কথা বলে উত্তরবঙ্গে ধ্বংসযজ্ঞ করবারই চক্রান্তে সক্রিয়। এরাই উত্তরবঙ্গে গ্যাস না দিয়ে বাংলাদেশ থেকে গ্যাস ভারতে রফতানির জন্য ওঠে পড়ে লেগেছিল। এরাই বঙ্গোপসাগরের গ্যাস সম্পদ মাকিনী কোম্পানির হাতে তুলে দিতে প্রচারণার কাজ করেছে। উন্মুক্ত খনি করতে গিয়ে দেশের অমূল্য আবাদি জমি, পানি সম্পদ, মানুষের জীবন জীবিকা ধ্বংস হোক, উত্তরবঙ্গ মরুভূমি হোক, ধ্বংসযজ্ঞ করে কয়লা বিদেশে পাচার হোক তাতে তাদের কিছু আসে যায না। সুন্দরবন ধ্বংস করে দেশে বিদ্যুৎ প্রকল্পের নামে সর্বনাশ করতে তারা কিছুমাত্র দ্বিধা করে না। মুনাফা আর কমিশনই এদের লক্ষ্য; প্রতারণা, মিথ্যাচার ও জালিয়াতিই তাদের প্রধান অবলম্বন।
২০০৬ সালে এই দুর্বত্তদের হটিয়ে দিতে ফুলবাড়ীতে মানুষ জীবন দিয়েছেন। রক্তে লেখা ফুলবাড়ী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। গণরায় হয়েছে: এই দেশের সম্পদের প্রতিটি কণা দেশের মানুষের, তাদের কাজেই লাগাতে হবে। এই দেশের জনগণ দেশি বিদেশি লুটেরাদের জন্য দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের সর্বনাশ হতে দেবে না। গণরায় অনুযায়ী প্রথমে ফুলবাড়ি চুক্তি বাস্তবায়ন হবে, এশিয়া এনার্জিকে দেশ থেকে বিতাড়ন করতে হবে। এটি বারবার প্রমাণিত হচ্ছে যে, রাহু থেকে মুক্ত হবার পরই কেবল কয়লা সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের সুরক্ষিত উপায় নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব।
সার্কুলারের মাধ্যমে সরকারের হঠকারী ও কোম্পানিমুখি অতিউৎসাহী তৎপরতায় ফুলবাড়ীসহ কয়েক থানার মানুষ খুবই বিক্ষুব্ধ। অশান্তি, অস্থিতিশীলতা বা অপ্রিয় পরিস্থিতি সৃষ্টির এই পাঁয়তারার জন্য আমরা সরকারকে অভিযুক্ত করছি। আর তাই এই সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে অবিলম্বে দিনাজপুর ও ফুলবাড়ীসহ চার থানায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রচারিত সার্কুলার প্রত্যাহার করবার দাবি জানাচ্ছি। আর এই বছরের ফুলবাড়ী দিবসে ঘোষিত সময়সীমা আবারও উল্লেখ করছি: ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ফুলবাড়ী চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন ও লন্ডনে এশিয়া এনার্জির শেয়ার ব্যবসা বন্ধ করতে হবে। এছাড়া পরিবেশগত সমীক্ষার ন্যুনতম শর্ত ভঙ্গ করে, জোরপূর্বক মানুষ উচ্ছেদ করে, সুন্দরবনসহ বাংলাদেশের সর্বনাশ করে ভারতের কোম্পানিকে সুবিধা দিতে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে সরকারি তৎপরতা বন্ধ করতে হবে।
উন্মুক্ত খনি চক্রান্ত, সরকার ও এশিয়া এনার্জির অপতৎপরতার বিরুদ্ধে ফুলবাড়ীসহ চার থানা ও দিনাজপুর জেলা কমিটি আগামী ১৩ নভেম্বর থেকে সুধী সমাবেশ, প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি ও জনসভাসহ ধারাবাহিক কর্মসূচী গ্রহণ করছে, তাঁরা এসব কর্মসূচী ঘোষণা করবেন আগামী ১০ নভেম্বর। সুন্দরবন ধ্বংস করে রামপাল প্রকল্পের যে সিদ্ধান্ত সরকার গ্রহণ করেছে তার বিরুদ্ধে খুলনা ও বাগেরহাট কমিটি এই মাসেই তাঁদের কর্মসূচী শুরু করবেন। এছাড়া আগামী ১৩ নভেম্বর ঢাকায় প্রতিবাদ সমাবেশ ও ২৮ নভেম্বর দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসুচী অনুষ্ঠিত হবে। ২৮ নভেম্বরের মধ্যে সরকারের ইতিবাচক সাড়া না পাওয়া গেলে ফুলবাড়ী ও রামপাল অঞ্চলসহ সারাদেশে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের বৃহত্তর কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে।
আমরা আবারও দাবী জানাই:
১.৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সমগ্র বাংলাদেশে উন্মুক্ত পদ্ধতি নিষিদ্ধ ও দেশ থেকে এশিয়া এনার্জি (জিসিএম) বহিষ্কারসহ রক্তে লেখা ‘ফুলবাড়ী চুক্তি’ অবিলম্বে পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। লন্ডনে বাংলাদেশের কয়লা দেখিয়ে এশিয়া এনার্জির অবৈধ শেয়ার ব্যবসা বন্ধ করতে হবে। ফুলবাড়ী অঞ্চলে তালাবন্ধ করে রাখা এশিয়া এনার্জির অফিস চক্রান্তের আখড়া বানানোর অপচেষ্টা চলছে, এটি সরাতে হবে।
২.সুন্দরবন ধ্বংসসহ জাতীয় স্বার্থবিরোধী রামপাল প্রকল্প বাতিল করে নিরাপদ স্থানে যথাযথ পরিবেশগত সমীক্ষার মাধ্যমে বিদ্যুৎ প্লান্ট স্থাপনের উদ্যোগ নিতে হবে।
৩.দীর্ঘমেয়াদে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্পায়নসহ জাতীয় প্রয়োজনে, মাটি পানি ও মানুষের ক্ষতি না করে, কয়লা সম্পদের শতভাগ ও সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করবার জন্য জাতীয় সংস্থা গঠন এবং জাতীয় সক্ষমতার বিকাশ ঘটাতে হবে।
৪.বড়পুকুরিয়ায় পুনর্বাসনের নামে জনগণকে অন্যত্র সরিয়ে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনি করার চক্রান্ত বন্ধ করতে হবে, ক্ষতিগ্রস্ত সকল মানুষকে যথেষ্ট ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, নিরাপত্তা বালু ভরাট ইত্যাদি নিশ্চিত করে জাতীয় সংস্থার মাধ্যমে নিরাপদে কয়লা উত্তোলনের উদ্যোগ নিতে হবে।
৫.কনোকো ফিলিপসএর সাথে চুক্তি বাতিল ও ‘খনিজসম্পদ রফতানি নিষিদ্ধ আইন’ প্রণয়ন করতে হবে।
৬.দেশি বিদেশি লুটেরাদের স্বার্থে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো চলবে না। রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্লান্ট মেরামত ও বৃহৎ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ প্লান্ট স্থাপন করে কম দামে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
৭.গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে শতভাগ মালিকানায় শতভাগ গ্যাস ও কয়লা দেশের স্বার্থে ব্যবহারের জন্য জাতীয় কমিটির ৭ দফা দাবী বাস্তবায়ন করতে হবে।
তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি
সূত্রঃ এখানে