দুনিয়ায় এখনো ঈশ্বর শক্তিশালী। ঈশ্বরের শান্তির বাণী মুখে নিয়ে দেশের পর দেশে মানুষের জীবন ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত করার কোনো কমতি নেই। কিন্তু ধর্মের ঈশ্বর শক্তিশালী হলেও দুনিয়া এখন চলে পুঁজির নিয়মে। ধর্ম নিজেই অনেক ক্ষেত্রে বাণিজ্যের অবলম্বন। অন্যদিকে নিরাকার পুঁজির সাকার রূপ করপোরেট জগৎ, দেশি-বিদেশি বাণিজ্যিক সংস্থা; তার সাক্ষাৎ প্রতিনিধি বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, বলপ্রয়োগের জন্য সিআইএ পেন্টাগন আর সব খুনি বাহিনী, মোলায়েম প্রলেপের জন্য এনজিও। এগুলো এখন শত হাত-পা দিয়ে সর্বত্র বিরাজমান; নদীনালা, খালবিল, সমুদ্র, বন, মাটি, বায়ু, পশু, পাখি, আকাশসহ মানুষের জীবনের সব ক্ষেত্র তাদের আয়ত্তে। ‘বিশ্বায়নের’ এই পরিবেশে মানুষ ক্রমান্বয়ে পুঁজির ক্রিয়ায় বিচ্ছিন্ন হচ্ছে নিজের থেকে, নিজের শ্রম ও মেধা থেকে, পরস্পরের থেকে, নিজ বসত থেকে, নিজ ভূমি থেকে। আবার সম্পর্কিত হচ্ছে পুঁজির নিয়মে, তার কর্তৃত্বে, কিংবা তার বিরোধিতায়। পুঁজিই এখন সক্রিয় ঈশ্বর।
বর্তমানকালে এসব ঘটনা যেহেতু ঘটে ‘গণতন্ত্র’, ‘জনগণের কল্যাণ’, ‘দারিদ্র্য বিমোচন’ এবং ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’র নামে; সেহেতু এই সময়ে মানুষের ‘সম্মতি উৎপাদন’ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শুধু জোরজবরদস্তি দিয়ে এখন কাজ হাসিল হবে না। রাজরাজড়ার কালে ক্ষমতাবানেরা যে দূরত্বে থাকত, তুলনায় তারা এখন অনেক নিকটে এবং দৃশ্যমান। এই নিকট যে ইলেকট্রনিক মায়ায় বন্দী, তা সহজে মানুষের বোধে ধরা পড়ে না। দেশের ও বিশ্বের ক্ষমতাবানদের বাণী ও চিত্র মানুষ শোনে ও দেখে, প্রতিদিন অবিরাম। আর তাদের কথা ও সুর যাতে নিজের কথা ও সুর হিসেবে মানুষ ভাবতে শেখে, সে জন্য থাকে বিশাল আয়োজন—শিক্ষা, সংস্কৃতি, আর গণমাধ্যমের হুলস্থূল সমাবেশ।
বস্তুত আমরা এখন বাস করি বিজ্ঞাপনের রাজ্যে। আমরা বেতার, টিভি, সংবাদপত্র, ইন্টারনেট, পোস্টার, ঝলমলে বিলবোর্ড, ফ্যাশন শো, স্পনসরড নাটক-চলচ্চিত্র-গানের আসর, খেলা, চিত্রাঙ্কন, করপোরেট শিক্ষামেলার মধ্যে দিয়ে আমাদের দিনরাত্রি অতিক্রম করি; আসলে আমরা দেখি আর আত্মস্থ করি নানা ধরনের বিজ্ঞাপন। বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ, লালন, নজরুল, করিম শাহসহ নারী-পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ, মুক্তিযুদ্ধ, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, ইফতার—সবই এখন বিজ্ঞাপনের বাহন। অসাধারণ অভিনয় আর স্ক্রিপ্ট এখন বিজ্ঞাপন হিসেবে হাজির হচ্ছে। বহু মেধাবী শিল্পী, চলচ্চিত্রকার, কবিরা তাঁদের প্রতিভার শ্রেষ্ঠ অংশটুকু যেন ইজারা দিয়েছেন বিজ্ঞাপনী সংস্থার কাছে। কোনো না কোনো পণ্যে ধন্য হওয়ার জন্য মানুষকে প্ররোচিত করার কাজেই তা ব্যবহূত হয়।
বাংলাদেশে, দেশে দেশে, সারা বিশ্বে এই বিজ্ঞাপনের মধ্যে দিয়েই গড়ে ওঠে এক বৈশ্বিক ভাষা, স্বাদ, আকাঙ্ক্ষা, আর প্রেস্টিজ বোধ। প্রয়োজন আর চাহিদা নির্মিত হয় এক সুসংগঠিত অভিযান দিয়ে। আর তাই গাছের আমের চেয়ে বোতলের আম, প্রকৃতির বিশুদ্ধ পানির চেয়ে বোতলের পানি কিংবা এনার্জি ড্রিংক, প্রকৃতির বাতাসের চেয়ে এসির বাতাস, স্বাভাবিক খাদ্যের চেয়ে ফাস্টফুড, স্বাভাবিক সৌন্দর্যের বদলে কৃত্রিম রং, খেলার মাঠের চেয়ে ভিডিও গেমস বেশি পরিচিত ও প্রিয় হয়ে ওঠে। এগুলো না পেলে জীবন অর্থহীন মনে হয়। মেধা বা আকর্ষণীয় সৌন্দর্য নিয়েও ফরসা না হওয়ার কারণে হীনম্মন্যতায় কাঁদে কিশোরী-তরুণী। অভাগা শিশুরা আনন্দের জগৎ সন্ধান করতে গিয়ে শৈশব থেকেই অন্য এক আগ্রাসী রাজ্যের শিকার হয়ে যায়।
তারুণ্যের উদ্দামতা কিসে? প্রচণ্ড গরমে বা বর্ষায় বা শীতে দেহের সব পেশি ও স্নায়ুর কর্মক্ষমতার অতিরিক্ত চাপ দিয়ে চাষবাস, ফসল ফলানো, নদী বা অশান্ত সমুদ্রে মাছ ধরা, বা কারখানায় পণ্য উৎপাদন, বা মানব পরিবহন এগুলোতে নয়; স্বাধীন জ্ঞানচর্চায়, মননে শ্রমনিষ্ঠ হওয়ায় নয়, সৃজনশীলতার নৈপুণ্যে নয়, প্রতিবাদী মিছিলে নয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নয়, জীবনদানে নয়, বোনের কিংবা বন্ধুর অপমানের প্রতিবাদ করতে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নেওয়া, তাতেও নয়। তবে কিসে? এইকালের বাণী তৈরি হয় বিজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে, তা জানায়... তারুণ্যের উদ্দামতা তৈরি হয় হরেক নামের ক্ষতিকর কোমল পানীয় পানে, মোবাইল ফোনে অনর্গল কথা বললে, নির্ধারিত ফ্যাশন অনুসরণে, ফরসা হওয়ার ক্রিম মাখলে, গাড়ি-বাড়ির নেশায় উন্মত্ত হলে, ফসলের জমি, জলাশয়, বন দখল করে বানানো অ্যাপার্টমেন্ট কিনলে, পুঁজির সেবায় সৃজনশীলতা ঢেলে দিলে, কোম্পানির সেবায় চৌকস হলে...।
শুধু কেনা আর বেচা, বেচা আর কেনাতে, ভোগেই জীবনের সার্থকতা চিহ্নিত, প্রচারিত। কিন্তু তার জন্য যে অফুরান অর্থ দরকার তা আসবে কোত্থেকে? তরুণের জীবনীশক্তি পাল্লা দিতে ব্যর্থ হয় বাজারের চাহিদার সঙ্গে। ছিনতাই, সন্ত্রাসে কিংবা নানা শর্টকাট পথে অর্থ উপার্জনে আগ্রহীদের সংখ্যা বাড়ে। মাদক ব্যবসা, শিশু-নারী পাচার, প্রতারণা ও জালিয়াতি ভরা যৌন-বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, নিয়োগ-বাণিজ্য, এমএলএম নানা পথ হাতছানি দেয়। তারুণ্যের কৃত্রিম জোশ আনতে কিংবা পরাজয় ভুলতে অনেকে ভর করে ইয়াবা কিংবা অন্য কোনো মাদকদ্রব্যের নেশায়। তাতে ভয়ংকর পুঁজি চাঙা হওয়া সহজ হয়।
আমাদের খেলার মাঠ, আকাশ, বৃক্ষরাজি দখল করে ভূমিদস্যুরা। দরিদ্র পরিবারের শিশুরা একাংশ রাস্তায় কিংবা ভয়ংকর কোনো কর্মক্ষেত্রে শৈশব ঢেলে দেয়। আর সচ্ছল অংশ? তারা ঘরের টিভি বা কম্পিউটারে অখাদ্যকে খাদ্য, মিথ্যাকে সত্য, বিষকে মধু হিসেবে দেখে, ভাবতে ও বিশ্বাস করতে শেখে।
শুধু এখানেই শেষ নয়। জ্ঞানচর্চা, শিক্ষা ও মিডিয়ার জগৎও এখন আরেক রকম বিজ্ঞাপনের বাহন। অনেক ক্ষেত্রে আরও বেশি শক্তিশালী, সম্পূরক। সারা দুনিয়াতেই বহুজাতিক সংস্থাসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এখন পণ্যের মান উন্নয়ন, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, প্রযুক্তি বিকাশে যত অর্থ ব্যয় করে তার চেয়ে বেশি ব্যয় করে জনসংযোগ বা পাবলিক রিলেশনস তৎপরতায়। এর সহজ অর্থ বিষময় প্রকল্প পাস বা পণ্য বাজার তৈরিতে সরকারি নীতি ও জনমত পক্ষে আনা। বিদ্যাজগৎ দখলের মধ্য দিয়ে তারা মানুষের বদলে তৈরি করতে চায় তাদের প্রয়োজনীয় নাটবল্টু, তাদের নাম বা পরিচয় হতে পারে ‘করপোরেট সেনাবাহিনী’। যে বাহিনীর সদস্যদের ক্যারিয়ার সাফল্য নির্ভর করে আনুগত্য, পুঁজির ফুলে ফেঁপে ওঠায় দক্ষ ভূমিকা পালন, কোম্পানির স্বার্থকে স্বপ্নে জাগরণে নিজের স্বার্থ বলে ভাবতে শেখা, আর করপোরেট মস্তিষ্কের ছাঁচে নিজের মস্তিষ্ক তথা সকল ইন্দ্রিয়কে সচল রাখার ওপর।
আনুষ্ঠানিক কর্মচারী না হয়েও বিশেষজ্ঞ, আমলা, মন্ত্রী, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, এনজিও কর্মকর্তাদের দিয়ে যে কনসালট্যান্ট, মিডিয়া পার্টনার আর লবিস্টদের বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে, তা এই করপোরেট সেনাবাহিনীরই অংশ। বর্তমান বিশ্বে মানুষের জীবন, সম্পদ এমনকি দেশ দখল আর উপনিবেশীকরণে অস্ত্র বহনকারী সেনাবাহিনীর পাশে এই সুশীল সেনাবাহিনীও সদা সক্রিয়। মানুষ ভোট দিয়ে সরকার বানায়। আর সেই সরকার পরিচালিত হয় সর্বশক্তিমানের এসব প্রতিনিধি দিয়ে, যাদের জনগণ চেনে না, সচরাচর দেখেও না।
সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র। আর বিশ্বপুঁজির বিধান অনুযায়ী, এই দেশ তার বৈশ্বিক ব্যবস্থায় প্রান্তিক একটি অঞ্চল মাত্র। সরকার এখানে কেবলই ব্যবস্থাপক। সর্বশেষ চিত্র: বাংলাদেশের সমুদ্র এখন দখল নিতে উদ্যত মার্কিন তেল কোম্পানি আর তাদের সামরিক বাহিনী। ভূমি আর ভূমির নিচের সম্পদও ক্রমান্বয়ে এসব বহুজাতিক পুঁজির দখলে নেওয়ার চেষ্টায় প্রাণান্ত করছে করপোরেট সেনাবাহিনী। কাগজে-কলমে জনগণ এসব সম্পদের মালিক হলেও সেই সম্পদ ভাগ-বাঁটোয়ারার খবর তারা খুব কমই অবহিত, তাদের নির্বাচিত সংসদও সর্বজনের মালিকানা রক্ষার ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয়। দৃশ্যমান নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান সবই যেন মায়া। আছে এবং নাই।
বিশেষজ্ঞ পরিচয়ে কনসালট্যান্ট বা লবিস্টরা যখন তাদের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার মাধ্যমে ধ্বংসকে উন্নয়ন হিসেবে মানুষের সামনে উপস্থিত করে, তথাকথিত স্টাডি রিপোর্টে সত্যকে মিথ্যা দ্বারা ঢাকে, অবিরাম সংলাপে দারিদ্র্য বিমোচনকে দারিদ্র্য সৃষ্টির বন্দোবস্ত দ্বারা পরিচালিত করে, তখন তা বিজ্ঞাপনেরই আরেকটি রূপ নেয়। উদ্দেশ্য অভিন্ন: নির্দিষ্ট প্রকল্প বা দখলকে ‘বিক্রি’ করার জন্য জনগণের ‘সম্মতি উৎপাদন’। সম্মতি আদায়, তাতে কাজ না হলে বলপ্রয়োগ, এটাই ব্যাকরণ।
কিন্তু ইতিহাস পাঠ থেকে একজন মুক্তদৃষ্টির মানুষের পক্ষে এতটুকু বোঝা খুবই সম্ভব যে যতই ক্ষমতাধর আর চতুর হোক, দুনিয়া সব সময় ‘তার’ ইচ্ছায় চলে না, চললে অবস্থা আরও অনেক খারাপ থাকত। জীবন্ত মানুষ জীবন্ত হয়, প্রচারণার আচ্ছাদন সরিয়ে সত্যকে দেখে; নিজের উপলব্ধি আর শক্তি দিয়ে ক্ষমতার ওপর পাল্টা দখল নেয়। বিশ্বব্যাপী মানুষ বারবার জমায়েত হয়, নিজেদের মধ্যে ‘ঘন হয়ে আসে’ নিজের সম্পদ ও জীবন নিজের কাছে ফিরিয়ে আনতে।
নিপীড়ক ক্ষমতার সঙ্গে চিন্তার ও প্রত্যক্ষ সংঘাতে নিপীড়িত শ্রেণী, জাতি, লিঙ্গ আর প্রান্তের মানুষদের নতুন ক্ষমতার উদ্ভব হয়। ক্ষমতা মানেই নিপীড়ক, মিশেল ফুকোর এই সর্বজনীন সিদ্ধান্তটি তাই মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। বরং তালাল আসাদের এই সিদ্ধান্তটি ইতিহাসের প্রতি সুবিচার করে যখন তিনি বলেন, ক্ষমতা হতে পারে নিপীড়ক আবার হতে পারে সৃষ্টিশীল। আধিপত্য, অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে যখন মানুষ দাঁড়ায় তখন তার মস্তিষ্ক সক্রিয় হয়, আচ্ছাদন সরে যায়, সৃষ্টিশীল ক্ষমতার অভ্যুদয় ঘটে। বিজ্ঞাপনের রাজ্য থেকে মুক্ত হয়ে মানুষ তখন নিজের বোধে জগৎ দেখে, জগতের ডাক শোনে, পরস্পর ঘনিষ্ঠ হয়, আর বুকের ভাষ্য বলে। প্রকৃত তারুণ্য বাস করে সেখানেই।