somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী’র প্রবন্ধ ‘বাঙালি মধ্যবিত্তের ভালো-মন্দ’(কপি-পেস্ট)

১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী • মধ্যবিত্ত নিজের লাভ-লোকসান বোঝে না এমন অপবাদ তার বিরুদ্ধে বিশ্বের কোনো জায়গায় কখনো করা হয়নি, বাংলাদেশে তো নয়ই। বাঙালি মধ্যবিত্ত সব সময়েই হিসাব করে চলে, লাভের সুযোগ দেখলে উৎফুল্ল হয়, বিপদের আভাস অনুমান করা মাত্র নিজেকে গুটিয়ে নেয়। দুই ব্যাপারের কোনোটাতেই আপেক্ষিকতার ধার ধারে না, এসব ব্যাপারে সে চরমপন্থী। এই যে তার আত্মসচেতনতা তার কারণ আছে। সে প্রসঙ্গে আমরা আবার আসবো। আপাতত আমাদের বিবেচ্য ব্যক্তিগত লাভ-লোকসান নয়, সমষ্টিগত ভালো মন্দ। সমষ্টির জন্য বাঙালি মধ্যবিত্ত কি করে, কতোটা করে, এবং সেখানে তার ভালো ভূমিকার ও খারাপ কাজের হিসাব-নিকাশটা কেমন দাঁড়াবে, আমরা সেদিকেই তাৎক্ষণিকভাবে তাকাতে চাইবো।

বাঙালি মধ্যবিত্তের ভালো কাজের তালিকাটা সামান্য নয়। আমরা যে সংস্কৃতির পরিচয়ে পরিচিত হই, কিছুটা হলেও গর্ব করি, তার গঠনে মধ্যবিত্তের ভূমিকাই প্রধান। উচ্চবিত্ত থেকেছে উদাসীন; বিত্তহীনদের ছিল, এবং এখনও রয়েছে, অপরিসীম লালসা প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখার কাজটা মধ্যবিত্তই করেছে, তাকেই করতে হয়েছে। না-করে উপায় ছিল না। কেননা সব দেশেই মধ্যবিত্ত সংস্কৃতিমনস্ক, আমাদের দেশেও তাই। আমাদের দেশে হয়তো কিছুটা বেশিই। কেননা অন্যান্য ক্ষেত্রে, বিশেষ করে অর্থনীতিতে, আমাদের অর্জনটা উৎফুল্ল হওয়ার মতো নয়, বরং বেশ ম্রিয়মান। সেজন্য মধ্যবিত্তের পক্ষে সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্যকলা, শিল্পকলার ওপর জোর দিতে হয়েছে। কেননা সংস্কৃতিতেই সে সৃজনশীল হওয়ার সুযোগ পেয়েছে, অন্যত্র নয়।

ব্যাপার আরো ছিল, সেটা হলো আত্মপরিচয়। সংস্কৃতি দিয়েই সে নিজেকে পরিচিত করেছে, অন্যের কাছে তো বটেই নিজের কাছেও। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীরই মানুষ। পারিবারিকভাবে রবীন্দ্রনাথরা জমিদার ছিলেন ঠিকই, কিন্তু রুচি ও সংস্কৃতিতে তিনি নিজে ছিলেন মধ্যবিত্ত। বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, মধুসূদন ও বেগম রোকেয়াও মধ্যবিত্তই। আলাউদ্দিন খাঁ, উদয়শঙ্কর, রবিশঙ্কর, সত্যজিৎ রায়, জয়নুল আবেদীন এই শ্রেণী থেকেই এসেছেন। জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, সত্যেন বসু – সবাই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সন্তান। শিক্ষাকেও সংস্কৃতির অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের সমষ্টিগত অর্জন মধ্যবিত্তের কারণেই। বিজ্ঞানী হিসেবে যারা বড় মাপের কাজ করেছেন তাঁদের কেউই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বাইরে নন, হওয়া সম্ভব ছিল না, হওয়ার উপায় নেই। রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রত্যেকটিতে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাছ থেকেই নেতৃত্ব এসেছে, তা সে-আন্দোলন উদারনৈতিক হোক, কিংবা হোক বামপন্থী। চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষ চন্দ্র বসু, একে ফজলুল হক সবাই মধ্যবিত্ত, শেখ মুজিবুর রহমানও তাই, মওলানা ভাসানী এবং কমরেড মুজফফর আহমদ দু’জনই মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে এসেছেন। রাজনৈতিক সচেতনতা যা তৈরি হচ্ছে সেটাও মধ্যবিত্তেরই অবদান। কৃষক আন্দোলন হয়েছে, তাতে তীব্রতা ছিল অসচেতনাও ছিল, কিন্তু সেগুলো স্থানীয় এবং বিচ্ছিন্ন। ব্যাপক আন্দোলন মধ্যবিত্ত নেতৃত্বেই তৈরি।

উচ্চবিত্তরা আন্দোলনে আসাটা পছন্দ করেনি। তাদের সংখ্যাও অবশ্য কম ছিল। কিন্তু মধ্যবিত্তের অসুবিধা যেটা তা হলো উচ্চবিত্তের সামনে দাঁড়িয়ে মধ্যবিত্তের এক ধরনের হীনমন্যতা বোধ। সরাসরি বলতে চাইলে বলা যায় যে, মধ্যবিত্ত নিজেই উচ্চবিত্ত হতে চায়। নিচে নামাকে সে যতো ভয় করে ততোটা ভয় মৃত্যুকেও করে কিনা সন্দেহ। ওদিকে উচ্চবিত্তের পক্ষে নিচে নেমে যাবার ভয়টা কম। সে জানে যে, সে রয়েছে বেশ শক্ত অবস্থানে। রাজনৈতিক আন্দোলন হয়, হবে, হচ্ছে; রাষ্ট্রের ভাঙা-গড়া চলছে, চলবে, কিন্তু উচ্চবিত্তের তাতে কোনো বিপদ ঘটে না। সে নিরাপদেই থাকে। কেবল তাই নয়, তার সুবিধাই হয়। দেশে এতো যে রাষ্ট্রনৈতিক পরিবর্তন ঘটে গেল, এর কোনোটাই বিত্তবানদের জন্য কোনো বিপদ ডেকে আনেনি, বরং প্রত্যেকটি পরিবর্তনেই সে লাভবান হয়েছে, আগে যতোটা ধনী ছিল পরে তার চেয়ে অধিক ধনী হয়েছে।

ওই পরিবর্তনগুলো মধ্যবিত্তের একাংশের জন্যও লাভের কারণ হয়েছে। পাকিস্তান তৈরি, পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ গঠন, বাংলাদেশে নানান রাজনৈতিক ‘বিপ্লব’- এসবের ভেতর দিয়ে মধ্যবিত্তের একাংশ ওপরে উঠে গেছে, বিত্তবান হয়েছে, কারো কারো বিত্ত বৃদ্ধি পেয়েছে অবিশ্বাস্য পরিমাণে। অপরাংশ, যেটা বড় অংশ আসলে, সেটা গেছে নেমে। তাদের জীবনে সংকট বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু তাই বলে তারা যে বিত্তহীনদের সঙ্গে রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিকভাবে এক হয়ে যেতে পেরেছে তা নয়। তারা মধ্যবিত্তই রয়ে গেছে, বলা যায় নিম্ন মধ্যবিত্তের সংখ্যাবৃদ্ধি করেছে, কিন্তু শ্রমজীবী হিসেবে যে নিজেদেরকে গণ্য করবে, এমনটা ঘটেনি। এক্ষেত্রে সে চরম রূপে রক্ষণশীল। আর এখানেই রয়ে গেছে মধ্যবিত্তের প্রধান দুর্বলতা। তার লোভটা ওপরে ওঠার। যখন সে ওঠে, এবং যতোটা ওঠে তখন এবং ততোটাই সে নিজেকে স্বার্থক ও সফল বলে মনে করে। যখন সে পারে না তখন সে যে সাধারণ মানুষদের অংশ হিসেবে নিজেকে গণ্য করবে তেমনটা ঘটে না। তার আছে অভিমান, রয়েছে আত্মসচেতনতা, সে জানে সে শিক্ষিত, ভাবে তারও উচিত ছিল বিত্তবান হওয়া। এবং ঘৃণাই করে সে সাধারণ মানুষকে, যাদেরকে সে দেখে মূর্খ, অজ্ঞান, নোংরা ইত্যাদি হিসাবে। ভয় পায় পাছে ওদের মতো হয়ে যায়।

এই যে একটা ত্রিশঙ্কু অবস্থা, না-ঘরের না-ঘাটের অবস্থান, এটাই রেখেছে তাকে দুর্বল করে। তাই দেখি মধ্যবিত্ত রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলছে ঠিকই, কখনো কখনো মনে হয় বিপ্লবই ঘটে যাবে, কিন্তু বিপ্লব ঘটে না। কেননা মধ্যবিত্ত আর যাই চাক প্রকৃত বিপ্লব চায় না। নানা রকমের বিপ্লবের কথা সে বলে, রাজনৈতিক বিপ্লব, শিক্ষায় বিপ্লব, এমনকি সাংস্কৃতিক বিপ্লবও ঘটেছে সে দেখতে পায় কিন্তু আসল যে বিপ্লব, অর্থাৎ মৌলিক সামাজিক পরিবর্তন, সমাজ ও রাষ্ট্রে যথার্থ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, তার ব্যাপারে মুখে যতোই ধ্বনি দিক অন্তরে সে বিশ্বাস করে না। বিশ্বাস করবে কি, চেষ্টা করে তাকে প্রতিহত করতে। এক্ষেত্রে বাঙালি মধ্যবিত্তের সবচেয়ে স্পষ্ট এবং শ্রেষ্ঠ মুখপাত্র আর কেউ নন স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ই, যিনি আমাদের সকলের পক্ষ হয়ে কথা বলে গেছেন। বলেছেন, ‘আমরা সামাজিক বিপ্লবের অনুমোদক নহি।’ বাঙালি মধ্যবিত্ত সম্পর্কে এর চেয়ে সত্য কথা আর কী হতে পারে?

এই ভীতির কারণটাও স্পষ্ট। কারণ হচ্ছে স্বার্থ। মধ্যবিত্ত বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট। সেই অসন্তোষ ঠিকই আছে। এই ব্যবস্থায় সে যে পরিবর্তন চায় সেটাও সত্য। কিন্তু তার মানে কখনো এটা নয় যে, মধ্যবিত্ত সমাজে সাম্য দেখতে চায়। সে আসলে বৈষম্যের ভক্ত। তার অভিযোগটা ব্যক্তিগতই। ব্যক্তিগতভাবে সে বঞ্চিত। তার ব্যক্তিগত যোগ্যতা আছে, অথচ সেই যোগ্যতার কোনো মর্যাদা নেই। তাই সে চায় সমাজ ব্যবস্থা এমন হোক যাতে সে ন্যায়বিচার পায়, অর্থাৎ ধনী হতে পারে। মুখ তার উপরমুখো। তার স্বার্থ গরিব মানুষের ভাগ্যের সঙ্গে জড়িত নয়।

আমরা বলতেই পারি যে, সকলের স্বার্থের সঙ্গে ব্যক্তির স্বার্থ অভিন্ন। সকলকে গরিব রেখে অল্প কয়েকজন ধনী হলে বিপদ আছে। কেননা বাদবাকি সকলে তখন ধনী মানুষটির বিরুদ্ধে লেগে যাবে, তাকে টেনে নামাবে, না-নামানো পর্যন্ত ক্ষান্ত হবে না। আমরা সেটা বলিও। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সাড়া দিই না। ভেতরে ভয় পাই গরিব হয়ে যাওয়াকে।

শ্রেণীচ্যুত হওয়ার ভয়টা মারাত্মক। যদি সকলের সঙ্গে মিশে যাই তাহলে আমি তো নির্বিশেষ হয়ে গেলাম, কোথায় আমার নিজস্বতা, কিই-বা মূল্য আমার শিক্ষা ও সংস্কৃতির? নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার এই আশঙ্কাই মধ্যবিত্তকে বিপ্লব-ভীরু করেছে। বিপ্লব-ভীরু নয়, আসলে বিপ্লববিরোধী। প্রথমটা থেকেই দ্বিতীয়টা এসেছে।

সমাজ পরিবর্তনের বামপন্থী আন্দোলনে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ অংশ নিয়েছে। কেবল অংশ নেয়নি, ওই আন্দোলন গড়েও উঠেছে মধ্যবিত্তের নেতৃত্বেই। সেক্ষেত্রে যেটা ঘটেছে তা হলো এক ধরনের শ্রেণীচ্যুতি। সমষ্টিগত অবশ্যই নয়, একেবারেই ব্যক্তিগত। ব্যক্তিগতভাবেই কেউ কেউ শ্রেণীকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গেছে। কিন্তু এগিয়ে যে গেছে সেই অগ্রগমনটা যে সর্বক্ষেত্রে স্থায়ী হয়েছে তা নয়। অনেকেই ফিরে এসেছে। চলে এসেছে নিজের শ্রেণীর কাছে। তার কোলে। অল্প বয়সে গেছে, কিছুটা বয়স হলে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। কারণ আর কিছুই নয়, কারণ হচ্ছে শ্রেণী। শ্রেণীই তাকে ঘাড়ে ধরে টেনে নিয়ে এসেছে, বলেছে, তুমি সাধারণ নও, তোমাকে বিশিষ্ট হতে হবে, বিশিষ্ট হতে হলে তুমি অংশ হয়ে যাও শাসকশ্রেণীর। অবিলম্বে করো ওই কাজ। কেননা ইতিমধ্যে তুমি কিছুটা সময় নষ্ট করে ফেলেছো, অন্যরা জায়গা-জমি দখল করে ফেলেছে, তোমাকে তাই বেশি তৎপর হতে হবে, নইলে হতাশাই হবে তোমার চিরস্থায়ী বিধিলিপি। আর যারা থেকে গেছে, বাম আন্দোলন থেকে বিচ্যুত হয়নি, কষ্ট করেছে অমানুষিক, আত্মত্যাগ করেছে অসামান্য তারাও যে পরিপূর্ণরূপে শ্রেণীচ্যুত হয়েছে তা কিন্তু নয়। শ্রেণীচ্যুত হলে এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস ভিন্নভাবে লেখা হতো এবং মানুষ এভাবে হতাশাগ্রস্ত ও দুর্দশায় নিক্ষিপ্ত থাকতো না।

বাম আন্দোলনের নেতারা শ্রেণীচ্যুত হতে পারেননি বলেই দেখি তাঁরা মধ্যবিত্তের বিচ্ছিন্নতাকে লালন করছেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে থাকছেন, কিন্তু তাদের সঙ্গে অভিন্ন হয়ে যেতে পারছেন না। যেন এসেছেন শিক্ষক হিসাবে, এসেছেন আত্মত্যাগী রূপে। ভেতরে রয়ে গেছে আত্মসচেতনতা ও আত্মঅভিমান, যে দুই গুণ মধ্যবিত্তকে মধ্যবিত্ত করে রাখে, তাকে অবিচ্ছিন্ন হতে দেয় না সাধারণ মানুষের সঙ্গে। আর আছে পরমুখাপেক্ষিতা। বাঙালি মধ্যবিত্ত তার উত্থান ও বৃদ্ধিতে পরিপূর্ণরূপে পরনির্ভর। উৎপাদন ব্যবস্থার ভেতর থেকে সে উঠে আসেনি, তার জন্ম হয়েছিল দেশের শাসকশ্রেণীর সহযোগিতায়, বৃদ্ধি ঘটেছে উচ্ছিষ্টভোগে। তার পক্ষে মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়ানো তাই খুবই কঠিন। বাম আন্দোলনেও সে ওই একই দুর্বলতাকে সঙ্গে বয়ে নিয়ে গেছে। নির্দেশ চেয়েছে বিদেশের পার্টির কাছ থেকে। আরো বড় কথা, শাসকশ্রেণীর দলগুলো থেকে নিজেকে সে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি, সেজন্য হয় এই দলের, নয়তো ওই দলের লেজুড় হয়ে পড়েছে। লেজুড় কি পারে বিপ্লব করতে? পারে না, এবং পারেওনি। পারবেও না, যদি না পরিপূর্ণ রূপে শ্রেণীচ্যুত হয়।

বাম আন্দোলনের বাইরে যে মধ্যবিত্ত থাকে সে তো বরাবরই এবং চরিত্রগতভাবেই বিপ্লববিরোধী। মধ্যবিত্তের বক্তব্য এ রকমের যে, এদেশে চরমপন্থার কোনো স্থান নেই, হঠকারী ও জিনিস এখানে চলবে না। অথচ চরম দারিদ্র্য, চরম নিষ্পেষণ এসব কিন্তু ঠিকই চলে যাচ্ছে। দু’একদিন ধরে নয়, যুগ যুগ ধরে। তবে উপায় কি? মধ্যবিত্ত বলবে উপায় হচ্ছে সংস্কার। ধীরে ধীরে করতে হবে। সইয়ে সইয়ে। এর ফল হয়েছে এই যে বৈষম্য বাড়ছে, নিষ্পেষণ দুঃসহ হয়ে উঠেছে। এবং পুরাতন ব্যবস্থা ঠিকই থেকে যাচ্ছে। সংস্কারপন্থার গুপ্ত ইচ্ছাটা অন্যকিছু নয়, সেটা হচ্ছে সংরক্ষণ। মধ্যবিত্ত আমূল পরিবর্তন চায় না, চায় সে সংস্কারের মধ্য দিয়ে সংরক্ষণ।

আমরা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে মধ্যবিত্তের অবদানের কথা বলি। সেটা ঠিকই আছে। অবদান অস্বীকার করবে কে। কিন্তু মধ্যবিত্তের কারণেই ওই সংস্কৃতি দুর্বল হয়ে রয়েছে। তাতে ব্যাপক জনগণের অংশ নেই, যার জন্য প্রাণশক্তিতে সে ক্ষীণ। বলা যায় সংকীর্ণ। সেখানে গণতান্ত্রিকতা নেই, নেই সেই ইহজাগতিকতা যা শ্রমজীবী মানুষের জীবনের বৈশিষ্ট্য। এদেশের মধ্যবিত্ত ধর্মভীরু, একাংশ সাম্প্রদায়িক, এখন তারা মৌলবাদীও হয়েছে; এই দৃষ্টিভঙ্গি তারা জনগণের ভেতর সংক্রমিত করে দেয়। অতীতে করেছে, এখনও করছে।

এই সংস্কৃতির প্রধান উপাদান হচ্ছে সাহিত্য। অথচ সাহিত্যের পাঠক অল্প। সাহিত্য বিদেশী ভাষার চর্চা দ্বারা আক্রান্তও বটে। সাহিত্যের বাইরে এমন গান কম তৈরি হয়েছে যা সকল মানুষের প্রাণ স্পর্শ করে। শ্রমজীবী মানুষের কাছ থেকে সুর নেয়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই সুরে বাঁধা গান শ্রমজীবী মানুষের কাছে ফিরে যেতে পারেনি, মধ্যবিত্তের কাছেই রয়ে গেছে। চিত্রকলা তো সাধারণ মানুষের জন্য প্রাসঙ্গিকই নয়। মধ্যবিত্ত শিক্ষাক্ষেত্রে কাজ করেছে কিন্তু খেয়াল রেখেছে শিক্ষা যেন সর্বত্রগামী না হয়। বিজ্ঞানী তৈরি করেছে, কিন্তু বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিকতার পসার ঘটায়নি।

বাংলাদেশের এখন অনেক সমস্যা। কিন্তু প্রধান সমস্যা কি সেটা চিহ্নিত করা অত্যাবশ্যক। সেটি অন্যকিছু নয়, সেটি হলো দেশের শাসকশ্রেণী। হ্যাঁ, শাসক শ্রেণীই; দল কিংবা গোষ্ঠী নয়। শাসকদের একটি শ্রেণী তৈরি হয়েছে যারা বিভিন্ন নামে ক্ষমতায় নিত্য আসা-যাওয়া করে। নাম ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু শ্রেণী অভিন্ন। এরা হচ্ছে বিত্তবান মানুষের দল। মধ্যবিত্ত এই শ্রেণী থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। মধ্যবিত্তের যে অংশ বিত্তবান হয়েছে তারা তো এর ভেতরেই আছে। তারাই তো এদেশের শাসক। আর যে অংশ বিত্তবান হতে পারেনি, উল্টো দরিদ্র হয়েছে তারা এই শাসক শ্রেণীর সঙ্গেই রয়েছে। আশা রাখে উঠবে, ভয় পায় নিচে পড়ে যাওয়াটাকে।

বাংলাদেশ অপেক্ষায় রয়েছে মৌলিক সামাজিক পরিবর্তনের। যেটি ঘটেনি। ঘটবে বলে মনে হয়েছিল কিন্তু ঘটতে পারেনি। কারণ অন্য কিছু নয়। কারণ হচ্ছে ওই মধ্যবিত্ত শ্রেণী নিজেই। কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেণী ছাড়া তো এগোবার পথও নেই। তারাই তো সচেতন, তারাই তো অগ্রসর। সামনে তো তারাই আছে। মধ্যবিত্তের একাংশ এগিয়ে যাবে বলে আশা আছে। কিন্তু তাকে যেতে হবে পরিপূর্ণরূপে শ্রেণীচ্যুত হয়ে। অগ্রসর সেই মধ্যবিত্তের পিছুটান থাকবে না, তাকে বুঝতে হবে যে ব্যক্তির মুক্তি আলাদা কিছু নয়, নিহিত রয়েছে সে সমষ্টির মুক্তির ভেতরে। কিন্তু কেন বুঝবে? বুঝবে হৃদয় ও বৃদ্ধির কারণে। হৃদয় বলবে বর্তমান অবস্থা দুঃসহ ও অবমাননাকর। বুদ্ধিও বলবে একই কথা। হৃদয় বলবে চলো সংলগ্ন হই, বুদ্ধি বাধা দেবে না। সংকীর্ণ স্বার্থবুদ্ধি দিতে পারে বাধা, কিন্তু যে-বুদ্ধি জানে যে সকলের স্বার্থ এক ও অভিন্ন সে প্রতিরোধ তৈরি না-করে বরং সহায়তা দেবে। বলাবাহুল্য, ওই বুদ্ধিরই বিকাশ দরকার। আমাদের সংস্কৃতি চর্চার প্রাণকেন্দ্রে স্থাপন করা দরকার এই বোধের যে, আমরা কিছুতেই বড় হবো না, যদি অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হই। মধ্যবিত্তের লাভ-লোকসানের হিসাবটা ব্যক্তিগত নয়, হওয়া চাই সমষ্টিগত। তাতে তার নিজের ভালো হবে যেমন, ভালো হবে সমাজের সকল মানুষের।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ৩:৪৭
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

এখানে সেরা ইগো কার?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪






ব্লগারদের মাঝে কাদের ইগো জনিত সমস্যা আছে? ইগোককে আঘাত লাগলে কেউ কেউ আদিম রোমান শিল্ড ব্যবহার করে,নাহয় পুতিনের মত প্রটেকটেড বুলেটপ্রুফ গাড়ি ব্যবহার করে।ইগো আপনাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছে, টের পেয়েছেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবং আপনারা যারা কবিতা শুনতে জানেন না।

লিখেছেন চারাগাছ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮

‘August is the cruelest month’ বিশ্বখ্যাত কবি টিএস এলিয়টের কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ ‘The Westland’-র এ অমোঘ বাণী যে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এমন করে এক অনিবার্য নিয়তির মতো সত্য হয়ে উঠবে, তা বাঙালি... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:২৪


আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×