"তু লাল পাহাড়ির দ্যাশে যা,
রাঙ্গামাটির দ্যাশে যা,
ইতাক তুরে মানাইছে নাই গো,
ইখেবারে মানাইছে নাই গো।"
রাঙ্গামাটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা নতুন করে কিছু বলার নেই তবে লাল পাহাড়ের মানুষগুলো সম্পর্কে একটা কথাই বলব, দেশের যত জায়গায় ঘুরতে গেলাম রাঙ্গামাটির মত আন্তরিক এবং অতিথীপরায়ন মানুষজন আর কোথাও দেখিনি। রাঙ্গামাটি গিয়েছি ২ বার। ভরা বর্ষায় ২০০৭ সালে এবং গ্রীষ্মে ৭ মে ২০০৯ সালে।
কিভাবে যাবেন:
সর্বোচ্চ ৩ দিন এবং সর্বনিম্ন ২ দিনে ঘুরে আসতে পারবেন রাঙ্গামাটি।
সরাসরি ঢাকা থেকে রাঙ্গামাটি বাসে যেতে পারেন অথবা ট্রেনে যেতে চাইলে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ট্রেনে এসে আবার বাস পাবেন রাঙ্গামাটির জন্য।
বাস ভাড়া নন এসি-৩৫০-৩৮০টাকা এবং এসি-৫০০ টাকা,
বাস সার্ভিসগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত দেখুন এখানে
ট্রেন ভাড়া শোভন চেয়ার ১৫০ টাকা চট্টগ্রাম পর্যন্ত, এরপর চট্টগ্রামের অক্সিজেন মোড় থেকে ৬০-১০০টাকা ভাড়ায় বাস পাবেন রাঙ্গামাটি পর্যন্ত।
ট্রেনের ভাড়া জানতে এখানে ক্লিক করুন।
রাঙ্গামাটি যাওয়ার জন্য সবচেয়ে ভাল সময় বর্ষাকাল। এটা যেকোন পাহাড়ি এলাকার জন্যই সত্য। সময় বাচাতে চাইলে ঢাকা থেকে বাসে অথবা ট্রেনে উঠুন রাত ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে। বাসে গেলে সকাল ৬-৭টায় রাঙ্গামাটি পৌছাবেন আর ট্রেনে গেলে চট্টগ্রাম পৌছাবেন ৭টায়, নাস্তা করে অক্সিজেন মোড় থেকে রওনা দিন বাসে, রাঙ্গামাটি পৌছাবেন ১১টায়।
শিশির ভেজা রেলপথ।
কি দেখবেনঃ
আরে মিয়া সারা পথ তো দেখতে দেখতেই যাবেন, দেখার কি কোন শেষ আছে?!
রাঙ্গামাটির রাস্তায়।
রাঙ্গামাটিতে নেমেই হোটেলের খোজ করুন, খুব স্বাভাবিক ভাবেই অনেকে টানাটানি করবে আপনার পছন্দমত যেকোন একটি তে উঠে যান। চেষ্টা করবেন ৩তলার উপরে রুম নিতে তাহলে কাপ্তাই লেকের মনোরম দৃশ্য হোটেল থেকেই দেখতে পাবেন। হোটেল ভাড়া জনপ্রতি ১০০ থেকে শুরু করে ৪০০ পর্যন্ত রয়েছে।
হোটেল রুম থেকে কাপ্তাই লেকের একাংশ।
যদি বাসে করে সকালে রাঙ্গামাটি পৌছান তাহলে তাড়াহুড়ার কিছু নেই। সকালের নাস্তা করে হোটেল রুমের আশে পাশে ঘুরে কাপ্তাই লেক দেখুন। যেদিকেই তাকান লেক চোখে পড়বেই, পুরো শহরটাকেই এই লেক ঘিরে রেখেছে। আর যারা ১১টায় পৌছাবেন তাদের ও তাড়াহুড়ার কিছু নেই, আপনারা দৌড়ায় কাপ্তাই লেকে ঝাপায় পড়েন, গোসল সেরে ফেলতে পারেন, এই চান্স আর পাবেন না! সাতার যারা জানেন না তারা সাবধান, স্থানীয়রা বলে প্রতি বছরই নাকি লোক মারা যায়।
এবার চলুন ঘুরে আসি রাজবন বিহার আর চাকমা রাজার বাড়িতে। সিএনজি তে যেতে পারেন (পুরো শহরে কোন রিকশা নেই, এমন আকাবাকা উচুনিচু রাস্তায় রিকশা চলা সম্ভব নয় তাই বাহন সিনএনজি, তবে ভয় নেই ভাড়া খুবই কম, অবাক হবেন)(সিএনজি রিজার্ব করলে ১৫০-২০০টাকা লাগবে) অথবা কাপ্তাই লেক থেকে নৌকা ভাড়া করে লেক, চাকমা রাজার বাড়ি ও রাজবন বিহার ঘুরে আসতে পারেন। নৌকা ভাড়া করলে খরচ একটু বেশী হবে। আর যে নৌকা ভাড়া করবেন সেটি পরের দিনের জন্যেও রাখুন কারন পরদিন যেতে হবে শুভলং। নৌকা ভাড়া একদিনের জন্য ৮০০-২০০০টাকা পর্যন্ত (নৌকার আকারের উপর নির্ভর করে), গাইড নেয়ার দরকার নেই।
নৌকার আকার দেখুন, ৮-১০ অনায়াসে বসতে পারবেন। এগুলো ৮০০-১০০০ টাকায় পাওয়া যাবে একদিনের জন্য।
রাজবাড়ি তে নৌকায় যেতে সময় লাগবে প্রায় ২ ঘন্টা আর সি এন জি তে আধা ঘন্টার কিছু বেশী।
লেক দেখে আর নৌকায় বসে থাকা গেল না, লাফ লাফ লাফ!
কাপ্তাই লেক।
রাজবাড়ির ঘাটে।
চাকমা রাজার বাড়ির প্রবেশ পথ।
চাকমা রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায়ের বাড়ি
চাকমা রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায়ের বাড়ির পাহারাদার সিংহ!
রাজবাড়ি
চাকমা রাজা কর্তৃক মুঘলদের কাছ থেকে দখলকৃত কামান "ফতে খাঁ"।
গুগলে খোজ নিয়ে জানতে পারলাম রাজবাড়িটি ২০১০ সালের শেষের দিকে আগুন লেগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়

অনেক ছবি হারিয়ে যাওয়ায় রাজবাড়ীর আর ছবি দিতে পারলাম। চলুন এবার যাই রাজবন বিহারে।
রাজবাড়ি থেকে সিড়ি দিয়ে নামলেই আরেকটি টিলা দেখতে পাবেন।
বিহারে যাওয়ার পথ।
ভিক্ষুদের বাসস্থান।
প্রথম মন্দির।
আমরা মন্দ বলি না।
মন্দ শুনি না।
মন্দ দেখি না।
একটি অচলিল ছবি!
বুদ্ধের পদচিহ্ন!
বুদ্ধের হাতে কেন ম্যাঙ্গো জুস আমার জানা নেই!
এটি একটি কুপ যার উপর অনেক মোমবাতি জ্বালানো হয় ধর্মীয় আচার উপলক্ষে।
দ্বিতীয় মন্দির। (আরো বেশ কয়েকটি মন্দির দেখতে পাবেন পাশপাশি)
সাতটি স্বর্গের প্রতিকী উপস্থাপন।
স্বর্গে যাচ্ছি!
তৃতীয় মন্দিরে পুজার অপেক্ষায় কয়েক শিশু।
এই মন্দিরটিতে বুদ্ধের একটি ছবি আছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে আপনি এই ছবির দিকে তাকিয়ে যদি ডানে বা বামে হাটতে থাকেন তবে ছবিটিও আপনি যেদিকে তাকাবেন সেদিকে মুখ করেই আপনার দিকে তাকিয়ে থাকবে! আমরা নিশ্চিত ছিলাম না ছবি তোলা যাবে কিনা তাই তুলিনি।
বুদ্ধের ছবিটি পর্যবেক্ষন চলছে।
কুইক কুইক, এইবার ব্যাক করতে হইবেক কারন সন্ধ্যায় আছে একখান জিনিস!
পাহাড়ী এলাকা গেছেন পাহাড়ী কিছু খাবেন নাকি? এই যেমন ধরেন ব্যাং, কচ্ছপ, শুকর অথবা শামুক, কচি বাশের বাচ্চুরি অথবা গামলা ভর্তি চাপিলা মাছ ভাজা?আসেন আমার সাথে।
সিএনজি তে করে সন্ধ্যায় চলে আসুন বনরুপা বাজারে। কাচা বাজারের রাস্তা ধরে নেমে যান, ১৫-২০ মিনিট হাটার পর রাস্তে ২ ভাগ হবে, বামে গেলে দেখবেন রাস্তা শেষ, ঢাল বেয়ে নেমে যান নিচের কাপ্তাই লেকের পাড়ে। শুকনা থাকলে হেটেই পার হতে পারবেন আর পানি থাকলে দেখবেন একটা নৌকা বাধা আছে, মাঝি বা বইঠা নেই কোন, নৌকায় বসে দড়ি টেনে ওপার যেতে হবে। ওপারের টিলায় উঠে যান। একটি রেষ্টুরেন্ট দেখতে পাবেন, মুলত উপজাতীয়দের জন্য, যা ইচ্ছা হয় অর্ডার দিয়ে ফেলুন। শামুক, ব্যাং খাবেন কিনা আপনার ইচ্ছা তবে গামলা ভর্তি চাপিলা মাছ ভাজি আর কাচা বাশের বাচ্চুরি না খেলে মিস করবেন। দাম খুব বেশি নয়।
রেস্টুরেন্টের ভিতরে কোন এক গাছের ফল।
বাটী ভর্তি শামুক, খোলস সহ, খাবেন নাকি?! ছোট প্লেটে বাচ্চুরি।
দর্শনীয় স্থান এবং নৌকা ভাড়া।
এবার রাতে ভাল করে ঘুমান। সকালে আরো মজা আছে।
পরদিন রিজার্ভ নৌকা বা স্পিড বোটে (আগের দিনেই রিজার্ভ করতে হবে) করে সকাল সকাল ৯টা-১০টার মধ্যে রওনা দিন। শহর থেকে উঠলে নৌকাকে বলুন ঝুলন্ত ব্রীজে আগে নিতে অথবা আপনি সিএনজি তে করে ঝুলন্ত ব্রীজ পর্যন্ত যেয়ে সেখান থেকেও নৌকায় উঠতে পারেন। সাথে দুপুরের খাবার নিয়ে নিতে পারেন যদি খরচ কমাতে চান।
এই সেই ঝুলন্ত ব্রীজ।
ঝুলন্ত ব্রীজের পরে কাপ্তাই লেকে নৌকা চলবে, পথে ৩টি বড় দর্শনীয় স্থান চোখে পড়বে। আপনি নিকটবর্তী গুলো দেখতে দেখতে দূরে যেতে পারেন অথবা দূরের টা দেখতে দেখতে কাছে আসতে পারেন। দূরেরটা আগে দেখাই ভাল। সবচেয়ে দূরে পড়বে বরকল উপজেলার বিডিআর ক্যাম্প। বাজারটির নাম ভুলে গেছি। শুভলং এর ঠিক পরেই। এখানে একটি ছোট চিড়িয়াখানা আছে, আর রাঙ্গামাটির সবচেয়ে উচু পাহাড়টি এখানে অবস্থিত। পাহাড়ের চূড়ায় বিডিআর ক্যাম্প। দম থাকলে উঠে যান। পাহাড়ের অর্ধেক পর্যন্ত সিড়ি আছে বাকিটা আল্লাহ ভরসা!
পাহাড় বেয়ে ওঠা।
রাঙ্গামাটির সর্বোচ্চ চূড়া থেকে বরকল উপজেলার ছবি। (১৮৬০ ফুট)।
"দা লস্ট কিংডম"। কাপ্তাই একটি কৃত্রিম হ্রদ। হ্রদ হওয়ার আগে যেখানে রাজবাড়ি ছিল সেখানে একটি বিরাট গাছ ছিল যা এখনো কালের সাক্ষি হয়ে লেক থেকে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বরকল যাওয়ার পথে এটি চোখে পড়বে।
এবার চলুন শুভলং যা পিছনে ফেলে এসেছেন।
শুভলং এর পথে।
এই সেই শুভলং। প্রবেশমূল্য সম্ভবত ৫ অথবা ১০ টাকা। শুভলং ঝরনার প্রকৃত রূপ দেখার জন্যই বর্ষাকালে রাঙ্গামাটি যাওয়া উচিৎ।সাহসীরা চাইলে ঝরনার ধার ঘেসে বেশ কিছুদুর উঠে যেতে পারেন তবে একবার পড়লে কিন্তু আর রক্ষা নাই। শুভলং যারা একবার দেখেছেন, এই পানির গর্জন আপনার কানে বাজবে সারাজীবন।
ঝরনার পানিতে গোসল সেরে নিতে পারেন। যারা খাবার এনেছিলেন তারা খেয়ে নিন কারন বেলা ২টা বেজে যাওয়ার কথা।এবার ভেজা কাপড়েই চলুন ছোট ঝরনায়। এই ঝরনার শুধু বর্ষা কালেই পাবেন। শুভলং এর আগেই এই ঝরনা পড়ে। ঝরনাটি ছোট হলেও এর বৈশিষ্ট্য হল এটি একটি পাহাড়ি নদী। ঝরনার পাশ দিয়ে পাহাড়ে উঠে অপর পাশে নেমে গেলেই নদীর দেখা পাবেন। নদীতে ভালোই স্রোত তবে পানি সর্বোচ্চ কোমর পর্যন্ত। নদীতে নেমে হেটে যেতে পারেন অনেক দূর। ১৫ মিনিট হাটলেই বান্দরবনের সাঙ্গু নদীর মত ছোট একটি জলপ্রপাত দেখতে পাবেন। চাইলে এই জলপ্রপাতের ঢালে বস্তে পারেন, স্রোত আপনাকে ভাসিয়ে নেবে তবে ভয় নেই ডুববেন না। পানি তো কোমর পর্যন্ত! তবে সাবধান, আর ভেতরে যাওয়ার দরকার নেই, উপজাতী লোকালয় সামনে। মেয়েরা গোসল করছে, তাই অতিথীর আগমন তারা পছন্দ করে না!
যারা খাবার আনেন নি তাদের খুদা লেগেছে নিশ্চই কারন এখন প্রায় ৩টা বাজার কথা। কুইক নৌকায় বসুন কারন মাঝি আপনাদের নিয়ে যাবে "পেদা টিং টিং" রেষ্টুরেন্টে। এই নামের অর্থ হচ্ছে "পেট পুরে খাওয়া"। তবে এখানে পেট পুরে খেতে আপনাকে পকেট ভরে টাকা নিতে হবে কারন খাবারের দাম টা ভালই বেশি। অর্ডার দিয়ে বসুন, খাবার আসতে সময় লাগবে। আর খাবারের নাম গুলোও বেশ।
ভ্রমন শেষ। চাইলে ঐদিনেই ফিরে আসতে পারেন অথবা পরদিন থেকে আসুন। ফিরতি বাসের সময় জানতে পোস্টের শুরুতে বাস সার্ভিসের লিঙ্ক দেখুন।
সময়ঃ
২-৩ দিন
খরচঃ
২৫০০-৫০০০(সর্বোচ্চ) টাকা
যাওয়ার সময়ঃ
সবচেয়ে ভাল বর্ষাকালে যাওয়া।
কি কি নেবেনঃ
ব্যাগভর্তি জিনিসপত্র না নেওয়াই ভাল কারন আপনাকেই টানতে হবে। ব্যাগ অবশ্য হোটেলে রেখে যেতে পারেন।
পানিতে যেহেতু নামতে হবে তাই জুতা না পরাই ভাল, প্লাস্টিক ধরনের স্যান্ডেল পরতে পারেন। আর সঙ্গে প্রয়োজনীয় কিছু ঔষধ যেমন প্যারাসিটামল, মেট্রনিডাজল, স্যাভলন রাখতে পারেন।
অন্যান্য দর্শনীয় স্থানঃ
সময় নিয়ে আসলে কাপ্তাই জল বিদ্যুত প্রকল্প, জেলা প্রশাসকের বাংলো, টুক টুক ইকো পার্ক, উপজাতী জাদুঘর দেখতে পারেন।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ
রাঙ্গামাটি থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করেছে কিনা জানিনা। সেনাবাহীনির একটি ক্যাম্প আছে। সেখানে খুবই সুন্দর দুটি কটেজ ভাড়া বেসামরিক লোকদের থাকার জন্য ভাড়া দেয়া হয়। আর্মি তে পরিচিত কেউ থাকলে আগে থেকে কটেজ বুক করে যেতে পারেন।
সেনাবাহিনীর কটেজ।
ভ্রমন বিষয়ে আমার অন্যান্য পোস্টগুলোঃ
ঘর হতে কয়েক পা ফেলিয়া (ছবিসহ বিস্তারিত) পর্ব-কুয়াকাটা, ফাতরার চর।
ঘর হতে কয়েক পা ফেলিয়া (ছবিসহ বিস্তারিত) পর্ব- শ্রীমঙ্গল,মাধবকুন্ড।
ঘর হতে কয়েক পা ফেলিয়া (ছবিসহ বিস্তারিত) পর্ব- নাফাখুম
ঘর হইতে কয়েক পা ফেলিয়া- বাড়ির পাশে নবাব বাড়ি-পর্ব আহসান মঞ্জিল