বন্ধুদের সাথে এটাই ছিল ঢাকার বাইরে আমার প্রথম ঘুরতে যাওয়া। শ্রীমঙ্গলে প্রথম যাই ২০০৬ সালে ঈদ-উল-ফিতর এর পরদিন। এরপর আরো কয়েকবার গিয়েছি এবং কোন বারই এক যায়গা বার বার দেখার ক্লান্তি আসে নি। যারা অল্প সময়ে ঢাকার বাইরে ঘুরে আস্তে চান কোন রকম কষ্টকর ভ্রমন ছাড়াই, তাদের জন্য মৌল্ভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল একটি আদর্শ স্থান।
কিভাবে যাবেনঃ
সর্বোচ্চ ৪দিন এবং সর্বনিম্ন ১দিনেই ঘুরে আসতে পারেন শ্রীমঙ্গল। ঢাকা থেকে
ঢাকা থেকে বাস অথবা আন্তঃনগর ট্রেনে শ্রীমঙ্গল যেতে পারেন। সকাল থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত অনেক বাস পাবেন (হানিফ, শ্যামলী, ইউনিক ইত্যাদি), ভাড়া পড়বে ৩০০-৩৫০টাকা। ভ্রমন ক্লান্তি এবং সময় বাচাতে রাত ১০টা থেকে ১১টায় রওনা দেয়া ভাল। শ্রীমঙ্গল শহরে পৌছাবেন ৪ঘন্টা পর অর্থাৎ রাত ২টা থেকে ৩টায়। বাস যেখানে থামবে সেখানেই হোটেল খোলা পাবেন। বাস থেকে নেমে সরাসরি হোটেলে উঠে যান, এক দফা ঘুমিয়ে নিন।
যারা দিনে যেয়ে দিনে ফিরে আসতে চান তারা সকাল ৬টা- ৭টায় রওনা দিবেন এবং ফিরতে পারবেন রাত ৯টার মধ্যে।
কি দেখবেনঃ
নির্ভর করে আপনি কতদিন থাকবেন তার উপর।
৫দিন-- ফিনলে টি গার্ডেন, লাউয়াছড়া রেইনফরেষ্ট, মাধবপুর লেক, মনিপুরি ও খাসিয়া পল্লী, নীলকন্ঠ সাত রঙ চা, মাধবকুন্ড, "লাউয়াছড়ায় রাত্রি যাপন, ক্যাম্প ফায়ার এবং খুব ভোরে লাউয়াছড়ায় ৬-৭ঘন্টা হাটা (যারা বন্যপ্রানী দেখতে চান এবং তাদের ছবি তুলতে চান)"
৪দিন-- ফিনলে টি গার্ডেন, লাউয়াছড়া রেইনফরেষ্ট, মাধবপুর লেক, মনিপুরি ও খাসিয়া পল্লী, নীলকন্ঠ সাত রঙ চা, মাধবকুন্ড
৩দিন- ফিনলে টি গার্ডেন, লাউয়াছড়া রেইনফরেষ্ট, মাধবপুর লেক অথবা মনিপুরি ও খাসিয়া পল্লী, নীলকন্ঠ সাত রঙ চা, মাধবকুন্ড
২দিন- লাউয়াছড়া রেইনফরেষ্ট (ভিতরে চা বাগান আছে), নীলকন্ঠ সাত রঙ চা, মাধবকুন্ড।
সকাল সন্ধ্যা - লাউয়াছড়া রেইনফরেষ্ট (ভিতরে চা বাগান আছে), নীলকন্ঠ সাত রঙ চা
শ্রীমঙ্গল শহর থেকে সিএনজি অথবা লোকাল বাস অথবা নিজস্ব গাড়িতে যাবেন লাউয়াছড়া , যেতে লাগবে ১৫-২০ মিনিট। যাবার পথে ডান দিকে পড়বে ফিনলে চা বাগান আর সোজা চলে গেলে লাউয়াছড়া, যারা ১দিনের বেশি থাকবেন তারা এখানে নেমে যান, চা বাগান এবং রাবার বাগানের সৌন্দর্য উপভোগ করুন।
ফিনলে চা আসল চা! এই সেই চা। আসল চা খেতে হলে কচি পাতা চাবান!
ফিনলে টি গার্ডেনে আমরা কয়েকজন।
ছুডুকালে গেছিলাম, তাই প্রকৃতি থেকে নিজেদের ছবি তোলার দিকে মনযোগ বেশী ছিল, স্বচ্ছ কাচের মত টলটলে পানির এই খালটি পড়বে ফিনলে টি গার্ডেন যাওয়ার পথে।
উপরের খালটির আরেকটি ছবি।
যতক্ষন খুশি টি গার্ডেনে সময় কাটান, ফেরার পথে বিডিআর ক্যাম্প এর সামনে নীল কন্ঠ চায়ের দোকান থেকে বিখ্যাত সাত রঙের চা খেয়ে নিন (দাম পড়বে ৭০ টাকা প্রতি গ্লাস)
এইখানে ৫ কালারের চায়ের ছবি দিলাম, প্রতি লেয়ারে আলাদা স্বাদ! তবে জিনিসটা খাইলেও পস্তাবেন না খাইলেও পস্তাবেন, দিল্লির লাড্ডুর মত।
এবার হোটেলে ফিরে আসুন এবং যে যার মত আরাম করুন।
পরদিন আবার সকাল ১০টায় লাউয়াছড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিন (যারা সকাল সন্ধ্যা যাচ্ছেন তাদের শুরু এখান থেকে)
১০:৩০ বা ১১টার মধ্যে পৌছে যাবেন, গাড়ি থাকলে পার্কিং এ রাখুন। বনে প্রবেশের জন্য টিকিট কাটতে হবে, জনপ্রতি ৭-১০টাকা। বনের মধ্যে ৩টি রাস্তা আছে-
আধা ঘন্টার ট্রেইল,
১ ঘন্টার ট্রেইল,
৩ ঘন্টার ট্রেইল।
আধাঘন্টা এবং ১ ঘন্টার ট্রেইলের জন্য গাইডের দরকার নেই, নিজেরাই যেতে পারবেন যদিও ঢোকার সময় আপনাকে বার বার অনুরোধ করা হবে গাইড নেয়ার জন্য, চাইলে অনুরোধের ঢেকি গিলতে পারেন, আমি গিলিনি তাই গাইডের খরচ বলতে পারছিনা।
আধা ঘন্টার ট্রেইলে আপনি বনের সামান্য অংশ, উপজাতী পল্লী দেখতে পারবেন। যারা ২টোই দেখতে চান এবং মাঝামাঝি কষ্ট করতে চান তারা ৩ ঘন্টার বড় রাস্তা ধরে এক থেকে দেড় ঘন্টা হাটুন। পাখির সাইন বোর্ড পার হওয়ার অনেকটুকু পর আরেকটি তিন রাস্তার মোড় দেখতে পাবেন, বাম দিকে চলে যান সেখানেই অপেক্ষা করছে চা বাগান, ফিনলে টি গার্ডেন না দেখে এটা দেখলেও চলবে।
লাউয়াছড়ার ভেতরে চা বাগান
মাকড়সার জালে আটকা পড়া এক ক্ষুদ্র প্রান।
জংগল!
হেটে হেটে বহুদূর।
বুনোফুল
বুনোফুল
যে পথে হাটতে হবে।
টিলার উপর থেকে তোলা।
সাতরং চা।
ফেরার পালা, যে পথে এসেছিলেন সে পথেই ফিরুন। যারা থাকতে চান তারা লাউয়াছড়ার রেস্ট হাউজে থাকতে পারেন, সেখান থেকে গাইড নিয়ে খুব ভোরে গভীর বনে ট্রেইলের বাইরে হাটলে বন্য প্রানী (উল্লুক, অনেক প্রজাতির পাখি, বানর, শেয়াল ইত্যাদির দেখা পাবেন এবং ছবি তুলতে পারবেন)।
সকাল সন্ধ্যা ভ্রমন যারা করছেন, আপনারা ২:৩০ এর মধ্যে লাউয়াছড়া ত্যাগ করে নীল কন্ঠে বসে চা খান এবং ৪টার আগেই রওনা দিন, ৫টা থেকে সিএনজি ষ্টেশন বন্ধ থাকে। ৪টায় রওনা দিলে রাত ৮টার মধ্যে ঢাকা চলে আসতে পারবেন। আপনাদের যাত্রা এখানেই শেষ।
যারা তিন দিন ৪দিন থাকবেন তারা পরদিন মাধবপুর লেক এবং মনিপুরী পাড়া ঘুরে দেখুন, কিছু কেনা কাটা করার ইচ্ছা থাকলে কিনুন, গ্রীন টি, স্পেশাল টি ইত্যাদি কিনে নিতে পারেন শহরের বাজার থেকে।
অথবা মাধবকুন্ড যারা যেতে চান আপনারা পরদিন সকালে ৯-১০টায় শ্রীমঙ্গল ষ্টেশল থেকে ট্রেনে করে কুলাউড়া যেয়ে নামুন। (ভাড়া মনে করতে পারছি না, দাঁড়িয়ে যেতে হতে পারে টিকিট থাকলেও)। কুলাউড়া থেকে সিএনজি তে করে আপনি মাধবকুন্ড যাবেন, ভাড়া হতে পারে ১০০-১৫০ টাকা, অথবা সাথে গাড়ি থাকলে সরাসরি শ্রীমঙ্গল থেকে মাধবকুন্ড চলে যান। ৯টায় রওনা দিলে দুপুর ১২টার মধ্যে পৌছাবেন। দেখে আসুন বাংলাদেশের সবচেয়ে উচু জনপ্রপাত। অনেকে মনে করেন এটি বাংলাদেশের একমাত্র জলপ্রপাত, কথাটি সত্য নয়। আরো অনেক জলপ্রপাত আছে এই দেশের যেমন নাফাখুম যার কথা বলেছি আমার আগের পর্বে ।
মাধবকুন্ডের পাহাড়ে উঠতেছি খুইজা বাইর করেন!
ছুডুকালের আমরা কয়েকজন, মাধবকুন্ড জলপ্রপাতের পাদদেশে।
মাধবকুন্ড জলপ্রপাত
মাধবকুন্ড জলপ্রপাত
মাধবকুন্ড জলপ্রপাত
বিকালে মাধবকুন্ড থেকে একই ভাবে ফিরে আসুন শ্রীমঙ্গল, শ্রীমঙ্গল থেকে ঢাকার বাস পাবেন রাত ১১:৩০ পর্যন্ত।
সময়ঃ
পূর্বে উল্লেখিত (১ থেকে ৫ দিন)
ভ্রমনের উপযুক্ত সময়ঃ
অবশ্যই শীতকাল, যত বেশী শীত শ্রীমঙ্গল ভ্রমন তত আনন্দদায়ক।
খরচঃ
জনপ্রতি ২৫০০-৫০০০ (সর্বোচ্চ ৬০০০) নির্ভর করছে আপনি কতদিন থাকছেন এবং কি কি করছেন তার উপর।
সকাল সন্ধ্যা ভ্রমনে যদি গাড়ি ভাড়া করে ৬-৮জন যান সেক্ষেত্রে খরচ হবে ১২০০-১৫০০টাকা জনপ্রতি।
কি কি নেবেনঃ
শীতকালে যেহেতু ভ্রমন করছেন অবশ্যই শীতের কাপড় (শ্রীমঙ্গল বাংলাদেশের সবচেয়ে শীতল অঞ্চলগুলোর মধ্যে অন্যতম), কিছু ঔষধ যেমন প্যারাসিটামল, মেট্রোনিডাজল, অ্যাভিল, স্যাভলন ইত্যাদি।
হাটার জন্য স্নিকারস অথবা আরামদায়ক স্যন্ডেল।
কি কি নেবেন নাঃ
যেহেতু হাটতে হবে অতিরিক্ত বোঝা বহন না করাই ভাল, আর যদি নিতেই হয় তবে অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো হোটেল বা গাড়ীতে রেখে যান।
কিছু পরামর্শঃ
লাউয়াছড়া বাংলাদেশের একটি ন্যাশনাল পার্ক। বেশ কিছু বিলুপ্তপ্রায় এবং হুমকির সম্মুখীন বন্যপ্রানীর আবাসস্থল এটি, সুতরাং, বনের ভিতরে অযহা হৈচৈ করবেন না, আগুন জালাবেন না, বন্য প্রানীর ক্ষতি হয় এমন কিছু করবেন না।
উইকি লিঙ্ক
আরো তথ্য জানার জন্য
*** জলপ্রপাতের ছবি তিনটি উইকি কমন্স থেকে নেওয়া, লাউয়াছড়ার ছবিগুলো তুলেছেন "সাবরিনা রশিদ রাফি" এবং বাকিগুলো আমার তোলা।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মার্চ, ২০১১ সকাল ১১:৪৪