somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে অনুপস্থিতি নিয়ে জেনারেল এমএজি ওসমানীর বক্তব্য

১২ ই জানুয়ারি, ২০০৯ সকাল ১১:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে আনুষ্ঠানিক জন্ম নেয় বাংলাদেশ। এদিন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলের সেনাধিনায়ক জেনারেল নিয়াজী মিত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেন সদলে। বাংলাদেশের পক্ষে এই অনুষ্ঠানে প্রতিনিধিত্ব করেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন (এয়ার ভাইস মার্শাল) একে খন্দকার। এই আত্মসমর্পণে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি ও মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানী কেনো ছিলেন না- এনিয়ে ব্লগ গরম হয়েছে একসময়। টুকরো যে সূত্র মিলেছিলো তাতে জানা গেছে ওসমানী সিলেট যাওয়ার পথে তার হেলিকপ্টারে গুলি করা হয়। আহত হওয়ায় তিনি অনুষ্ঠানে আসতে পারেননি। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া মিত্রবাহিনীর অন্যতম জেনারেল জেকবের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বেশ বিস্মিত হয়েই বলেছিলেন- আমরাও জানতাম না উনি কোথায় চলে গিয়েছিলেন!

এ নিয়ে সেসময় কোলকাতায় বাংলাদেশ প্রবাসী সরকার ও বাঙালীদের মধ্যেও ব্যাপক জল্পনার জন্ম নিয়েছিলো। নানা ধরণের কাল্পনিক ও পরস্পরবিরোধী প্রচারণার মধ্যে আলোচিত ছিলো কয়েকটি কাহিনী :
১. প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে দেখা করে ওসমানী জানিয়ে দিয়েছেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়কের কাছে আত্মসমর্পন করতে হবে। ওসমানী নিজে ঢাকায় গিয়ে তাদের আত্মসমর্পণে রাজী করাবেন। কিন্তু ভারতীয় বাহিনী এতে নারাজ। তাদের দাবি তাদের কাছেই আত্মসমর্পণ করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে নাখোশ করতে চান না, আবার ওসমানীকেও না বলতে পারছেন না। এই দড়িটানাটানিতে রাগ করে ওসমানী কোথায় চলে গেছেন।

২. প্রধানমন্ত্রী ওসমানীকে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে থাকতে বললে তিনি রাজী হননি কারণ ভারতীয় বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব কে করবেন সেটা তখনও ঠিক হয়নি। ভারতীয় সেনা প্রধান স্যাম মানেকশ যদি আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যান, তাহলে কর্ণেল ব্যাজধারী ওসমানী তার সঙ্গে যেতে অস্বস্তি বোধ করবেন। প্রধানমন্ত্রী এরপর অরোরা নাম প্রস্তাব করলে ওসমানী আবারও অস্বীকৃতি জানান। কারণ মর্যাদার দিক থেকে তিনি ভারতীয় সেনাপ্রধানের সমপর্যায়ের- একটি দেশের সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক। অন্যদিকে অরোরা একটি আঞ্চলিক কমান্ডের অধিনায়ক মাত্র। ওসমানী তাই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন না। উনি পরে কোলকাতায় ফিরবেন।

এর বাইরে আরেকটি হাস্যকর গল্প ছিলো যে ভারতীয় বাহিনীর জেনারেলদের সমাদর করার মতো অবস্থা ঢাকায় ওসমানীর ছিলো না। তাই লজ্জায় তিনি গা ঢাকা দিয়েছেন। এ বিষয়ে অবশেষে কিছু তথ্য জানা গেছে যার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ কম। যুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের অধীনে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরে জনসংযোগ কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন নজরুল ইসলাম। একাত্তরের রণাঙ্গন অকথিত কিছু কথা নামে এক স্মৃতিচারণে তিনি তুলে ধরেছেন এর বিষদ বিবরণ।

ঘটনা হচ্ছে ১২ ডিসেম্বর ওসমানী কলকাতা থেকে আগরতলা হয়ে মুক্তাঞ্চল সিলেটে যান। এটা নিশ্চিত করেন মুক্তিবাহিনী হেডকোয়ার্টারের অফিসার ইন চার্জ জেনারেল ওসমানীর বিশ্বস্ত বন্ধু মেজর এমআর চৌধুরী। তার ভাষায়- তানী এখন সিলেট গেছুন।

১৮ ডিসেম্বর সদর দপ্তরে ফিরে তাকে নিয়ে এসব গুজব শুনে ভীষণ ক্ষুব্ধ হন ওসমানী। নজরুল ইসলামের মুখে পুরোটা শুনে যে জবাব দিয়েছেন কোট করছি:

দেখুন আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে যাচ্ছি। কিন্তু দুঃখ হলো স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধ সম্পর্কে কোনো চেতনা এখনও জন্ম হয়নি। আমাকে নিয়ে রিউমার ছড়ানোর সুযোগটা কোথায়? কোনো সুযোগ নেই। তার অনেক কারণ রয়েছে। নাম্বার ওয়ান- পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কবে আত্মসমর্পণ করবে আমি জানতাম না। আমি কলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তাদের আত্মসমর্পণের প্রস্তাব এসেছে।


নাম্বার টু- ঢাকায় আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আমার যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ এই সশস্ত্র যুদ্ধ ভারত-বাংলাদেশের যৌথ কমান্ডের অধীনে হলেও যুদ্ধের অপারেটিং পার্টের পুরো কমান্ডে ছিলেন ভারতীয় সেনাপ্রধান লেফট্যানেন্ট জেনারেল স্যাম মানেকশ। সত্যি কথা হচ্ছে আমি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনো নিয়মিত সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধানও নই। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুযায়ী পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমার কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারে না। কারণ বাংলাদেশ জেনেভা কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী কোনো দেশ নয়।


আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে জেনারেল মানেকশকে রিপ্রেজেন্ট করবেন লে.জে অরোরা। জেনারেল মানেকশ গেলে তার সঙ্গে যাওয়ার প্রশ্ন উঠতো। সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে আমার অবস্থান জেনারেল মানেকশর সমান। সেখানে তার অধীনস্থ আঞ্চলিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল অরোরার সফরসঙ্গী আমি হতে পারি না। এটা দেমাগের কথা নয়। এটা প্রটোকলের ব্যাপার। আমি দুঃখিত, আমাকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। আমাদের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধের বড় অভাব।

ঢাকায় ভারতীয় বাহিনী আমার কমান্ডে নয়। জেনারেল মানেকশর পক্ষে জেনারেল অরোরার কমান্ডের অধীন। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে যৌথ কমান্ডের ভারতীয় বাহিনীর কাছে। আমি সেখানে (ঢাকায়) যাবো কি জেনারেল অরোরার পাশে দাড়িয়ে তামাশা দেখার জন্য? হাও ক্যান আই!

আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করবেন জেনারেল মানেকশর পক্ষে জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আর পাকিস্তানী বাহিনীর পক্ষে জেনারেল নিয়াজী। এখানে আমার ভূমিকা কি? খামোখা আমাকে নিয়ে টানা হ্যাচড়া করা হচ্ছে।

পাশাপাশি কেনো মুক্তিবাহিনীর কাছে পাকিস্তানীরা আত্মসমর্পণ করেনি এটার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন ওসমানী সংক্ষেপে ব্যাপারটা এমন যে যুদ্ধবন্দীদের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক নীতিমালা আছে যার অন্যনাম জেনেভা কনভেনশন। বাংলাদেশ এই কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ নয় বলেই সেই নীতিমালা মানতে মুক্তিবাহিনী বাধ্য ছিলো না। তাই তাদের হত্যা করলে বা তাদের উপর অত্যাচার করলে বলার থাকতো না কিছু। পাকিস্তানীরা জেনেশুনে সে ঝুকি নেয়নি। তাছাড়া ৯০ হাজার যুদ্ধবন্দীকে খাওয়ানো পড়ানো তদারক করার ক্ষমতাও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের ছিলো না। তখনও নিজের খাওয়াটাই যে জোটে না!

একই বইয়েই জানা গেছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য ওসমানী একটি ভাষণ লিখেছিলেন ইংরেজীতে যার অনুবাদে কমান্ডার ইন চীফের বাংলা মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি করা হয়েছে দেখে খেপে যান তিনি। নির্দেশ দেন সর্বাধিনায়ক লিখতে। বিব্রত নজরুল তথ্য মন্ত্রনালয়ে গেলে ভারপ্রাপ্ত সদস্য আব্দুল মান্নান প্রধান সেনাপতি লিখতে বলেন। ক্ষুব্ধ ওসমানী এরপর স্বাধীন বাংলা বেতারে কোনো ভাষণ দেননি গোটা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে। প্রসঙ্গত মুজিব নগরে বাংলাদেশ সরকারের স্বাধীনতা ঘোষণায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়কের পদ দেওয়া হয়। ওসমানী ছিলেন মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক।

ছবি কৃতজ্ঞতা : বাংলাপিডিয়
তথ্যসূত্র : একাত্তরের রণাঙ্গন অকথিত কিছু কথা
লেখক: নজরুল ইসলাম, অনুপম প্রকাশনী ১৯৯৯
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০০৯ দুপুর ১:৩৩
৫৪টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×