উপরের আহবানটি মুক্তিযুদ্ধের সময়কার। ৬ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার-আলবদরদের একটা সুযোগ নিতে বলেছিল স্বাধীনতার পক্ষে চলে এসে। যারা এসেছিল, ক্ষমা পেয়েছিল। যারা আসেনি, তাদের জন্য ছিল লজ্জা, হেনস্থা, প্রকারান্তরে মৃত্যুও। আরো একদল ছিল, যারা ক্ষমা চায়নি। এখনও চায় না। তাদের দুষ্কর্ম জায়েজ করতে তারা সগর্বে বলে চলে তারা ভুল করেনি। স্বাধীনতার পর তারা কোনো না কোনোভাবে পালিয়ে গিয়েছিল। সুযোগ পেয়ে ভোল পাল্টে ফিরে এসেছে। কিন্তু কথা পাল্টায়নি। একদল লোভী রাজনৈতিকের সঙ্গ পেয়ে এরা এখনও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যা-তা বলার অপপ্রয়াস পায়। এরা ক্ষমার অযোগ্য।]
তোমার সঙ্গে আমার এমনিতে কোনো দ্বন্দ্ব নেই যুবক। কিংবা হয়তো তুমি তরুণ। হতে পারে সদ্য গোফ ওঠা কিশোর। তোমার আমার দ্বন্দ্ব একান্তই চেতনার। এই চেতনার সংঘর্ষেই তুমি আমার রোষের শিকার। তুমি আমার ধিক্কারের শিকার। আমি সরোষে তোমাকে অহরহ ঘৃণা জানাই তোমার চেতনার কারণে। তুমি এমন এক আদর্শে বুদ আছো যুক্তি দিয়ে তার পক্ষপাতের কোনো কারণ নেই। হয়তো চক্ষুলজ্জায়, হয়তো রক্তের টানে তুমি বিবেকের ডাকে সাড়া দিতে পারছ না। তারপরও আমি তোমার বিবেককে আরেকবার জাগানোর শেষ চেষ্টা নিতে চাই।
আমি কোন চেতনার কথা বলছি? আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলছি। একাত্তরের সাড়ে ন’মাস লাখ লাখ শহীদের রক্ত মাখিয়ে, লাখ লাখ ধর্ষিতার শাড়ি ছিড়ে ওই দেখো ওড়ে পতাকা আমার। আমি ওই লাল সবুজ পতাকার কথা বলছি। একটা ঝড় এসেছিল। সে ঝড় আমার ঘরদোর ভেঙে দিয়েছিল। কিন্তু আমি বাতাসকে যত না অভিশাপ দেই, তারও বেশি শাপ দিই সেইসব লুটেরাদের। যারা আমার অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়েছিল। যারা আমার ঘর লুটেছিল। পরদেশীর সঙ্গে সঙ্গীন উচিয়ে আমার বাবা-ভাইয়ের প্রাণ, আমার বোনের সম্মাণ লুটেছিল। আমি স্বাধীনতা বিরোধীদের কথা বলছি। রাজাকার ও আলবদরদের কথা বলছি। আমি জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্র শিবিরের কথা বলছি। আমি গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, কামারুজ্জামান, মুজাহিদ ও কাদের মোল্লার কথা বলছি।
এইসব স্বাধীনতাবিরোধীরা কি করেছে সেজন্য অজস্র তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। এমনকি জামাতের মুখপাত্র সংগ্রাম পত্রিকায় থরে থরে সাজানো আছে তাদের নানা অপকীর্তির কথা। আজ তারা তাদের তখনকার বুলি তোমার মুখে বসিয়ে তোমাকে আমার শত্র“ বানাচ্ছে। ওঠো যুবক, নাড়া খাও। জানার চেষ্টা করো আসল কাহিনী। এইসব আওয়ামী লিগের অপপ্রচার নয়। এইসব ভারতের দালালদের অপপ্রচার নয়। এইসব এই দুঃখিনী বাংলা মায়ের নয় মাসের নির্যাতনের উপাখ্যান। যার হাওয়া বাতাসে তুমি বড় হয়ে ওঠো। যার সামান্য অপমানে তোমারও আঁতে ঘাঁ লাগে বলে আমি নিশ্চিত জানি। এই পতাকার অপমানে তুমিও ব্যথিত হও আমি নিশ্চিত মানি। কিন্তু কি কারণে জানি তোমার হাত-পা বাধা।
হতে পারে তুমি এক গরীব যুবক। গাঁ থেকে এসেছো। এই মহানগরে অপরিচিত বলেই হারিয়ে গিয়েছো। রাতে দুঃস্বপ্নে মাকে ভেবে কেঁদে উঠেছো। কেউ হাত বাড়ায়নি সাদরে। যার হাত পেয়েছো তার শর্ত ছিল। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কালাম পড়ায় কোনো সমস্যা নেই। মুসলমান হিসেবে অবশ্যই তা পালনীয়। কিন্তু তোমাকে ভিন্ন আফিম খাওয়ানো হয়েছে। তোমাকে কোরআন হাতে নিয়ে শপথ করতে হয়েছে এক ভুল জেহাদের। তুমি ব্যবহৃত হয়েছো এবং হচ্ছো। যুবক, তুমি ভুলে নিজের আত্মা বিক্রি করে দিয়েছো ছদ্মবেশী শয়তানের কাছে। কোরআন পড়ে দেখো, এর উল্লেখ আছে।
তোমার কি কখনো দ্বিধা জাগে না এই ভেবে যে এই যে নেতারা, তারা কেনো নবিজীর সাধারণ জীবনযাপনের কথা বলে নিজেরা ডুবে থাকে বিলাসে বৈভবে? কেনো তারা সুদ নেয়? কেনো তাদের সঙ্গে আদর্শে মেলেনা ইসলামপন্থী অন্য দলগুলোর? কোনো আলেমের? কেনো তারা তোমারই সহপাঠী হত্যায় তোমাকে উৎসাহ দেয় জেহাদী মৌতাতে? তুমি মানতে বাধ্য কারণ তোমার আত্মা তার কাছে বাঁধা। এবং প্রজন্মান্তরে এমনটাই হচ্ছে। কিংবা তুমি নিজেও হয়তো তাদেরই সন্তান। তোমার কি প্রশ্ন জাগে না কেনো তার পাপে তুমি সাজা পাবে? কেনো তোমাকে রাজাকার গালি শুনতে হবে তার নষ্টামিতে? তুমি তো যুদ্ধ দেখনি। তুমি তো মাটিলেপা গাড়ি নিয়ে তুলে নিয়ে যাওনি দেশসেরা বুদ্ধিজীবিদের। তাদের চোখ তুলে, কলিজা ছিড়ে, স্তন কেটে গুলি করে ফেলে আসনি রায়ের বাজারে। তাহলে কেনো? কারণ তুমি ভুল শিখেছো। বাবাকে যখন জিজ্ঞেস করেছো সে সময়ের কথা, সে লজ্জায় তার পাপ লুকোতে তোমাকে যা বলেছে তাই শিখেছো। তাই আমার কথা শুনে তুমি অবাক হও। তেড়ে মারতে আসো বাবাকে বাঁচাতে। আমি তোমার দোষ দেখি না। তোমার চেতনার দোষ দেখি। তোমার ভুল শিক্ষার দোষ দেখি। আমি চাই তুমি শুদ্ধ হও। তোমার বিবেক ও চিন্তাকে কাজে লাগাও।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ধর্মবিরোধীতার কারণে নয়। ভেবে দেখো শহীদুল্লাহ কায়সার, নিজামউদ্দিন, আলিম চৌধুরী নামগুলো। এরা মুসলমান। তোমার নেতা কিংবা বাবার সঙ্গে তাদের বিরোধ ধর্মের ছিল না। ছিল আদর্শের। আমরা বাংলায় কথা বলব, বাংলা সংস্কৃতি ধারণ করে বাঙালী হয়ে বাচব। এই চাওয়ার সঙ্গে ধর্মের সংঘাত কোথায়? তোমাকে ভুল শেখানো হয়েছে। তুমি ভুল জেনেছো। তারা দালালী করেছে পাকিস্তানীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে নেহাতই ক্ষমতার লোভে। মীরজাফর-রায় দুর্লভরা যেমন ইংরেজদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল সিরাজকে হটাতে। মীর জাফর সফল হলেও গোলাম আযম ব্যর্থ। কিন্তু ইতিহাস দুজনকেই ছুড়েছে আস্তাকুড়ে। বাঙালী আজীবন ঘেন্না করবে তাদের। এবং তাদের পেছনে হাঁটছ বলে তোমাকেও।
৩০ লাখ বাঙালীর স্বজনেরা বিচার চায়। তুমি কেনো ভুল আদর্শে তাদের বিরুদ্ধে যাবে। কেনো তুমি বুঝছো না এ কোনো রাজনৈতিক দাবি নয়। এ দাবি সাধারণ মানুষের। এসো যুবক, তাদের সঙ্গে সুর মেলাও। নৈতিকতার প্রশ্নে কোনো ছাড় নয়। তুমি তো পড়েছো- একটি মানুষ খুন করলো, সে যেনো গোটা মানব জাতিকে খুন করলো। আমরা যাদের কথা বলছি, তারা অনেক অনেকবার মানব জাতিকে খুন করেছে। তার দায় ঘাড়ে নিও না। তাদের পাপের ভার বয়ো না। তাদের ত্যাগ করো। রাজনৈতিক-সামাজিকভাবে। তুমি ধর্মপ্রাণ। পিতাও যদি অবিশ্বাসী হয় তার সঙ্গ ত্যাগ করার ঐশী আদেশের কথা তুমি জানো। ভেবে দেখো একাত্তরে তার কৃতকর্ম তোমার সত্যিকার আদর্শের সঙ্গে সত্যিই যায় কি না। তোমার বিবেক কি বলে?
ভেবে দেখো একবার। আমি তোমার বিনাশ চাই না। আমি তোমার চেতনার বিনাশ চাই। সে জন্য যদ্দূর যেতে হয় যাব। তার আগে তোমাকে সাবধান করিনি, এমন কিন্তু বলো না।