এক.
তাসের মতো মেলে ধরা ছবিগুলোর দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছেন আইজুদ্দিন। উল্টোদিকের চেয়ারে বসে একদৃষ্টে তাকিয়ে হাসিব। অধ্যাপকের এই অভিব্যক্তির সঙ্গে সে পরিচিত। হাসির মানে দাঁড়ায় কাজ হচ্ছে। কিছু একটা খুঁজে পেয়েছেন। হাসিবের এতদূর আসাটা স্রেফ সময়ের অপচয় নয়। তারপর ও নিশ্চিত হতেই প্রশ্নটা করলো
-হাসছেন যে স্যার।
-হুমম। এবার কিছুটা গম্ভীর আইজুদ্দিন। ফরেনসিক ও ক্রিমিনাল সাইকোলজির রীতিমতো মহারথী ধরা হয় তাকে। প্রচুর পেপার আছে তার এ বিষয়ে। এফবিআই, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড এবং ইন্টারপোলের অতিথি লেকচারার হিসেবে যাওয়া-আসা নিয়মিত। বাংলাদেশের জন্য তার মতো জ্ঞানী মানুষ বোঝা বিশেষ। কারণ প্রয়োগের পরিস্থিতিই কদাচিত। যে জন্য তার শরন নেয় গোয়েন্দা বিভাগ, সেগুলো না নিলেও চলে। তারপরও বড় সড় বেশ কিছু কেইসে ব্রেক থ্রু দিয়েছেন ডক্টর আইজুদ্দিন। তার লাইনআপ ফলো করে ঠিকই বেরিয়ে গেছে অপরাধী ও অপরাধের ধরণ। এবারের মামলাটা একটু ভিন্নরকম। হাসিব এসেছে সে কারণেই। এবং এখন পর্যন্ত আইজুদ্দিনের হাবভাব উদ্দীপ্ত হওয়ার মতোই।
-হাসিব বাংলাদেশে সিরিয়াল কিলিংয়ের কোনো স্ট্যাট আছে তোমাদের কাছে?
-সিরিয়াল কিলিংয়ের স্ট্যাট! স্যার কিছু রাজনৈতিক হ্ত্যাকাণ্ড আছে যা পাল্টাপাল্টি ঘটনা। কিন্তু সেই অর্থে সিরিয়াল কিলিং কোথায়।
-সেটাই। আশির শুরুতে নোয়াখালীর জ্বিনের বাদশা কিংবা কয়েকবছর আগে ফুটপাথের ঘুমন্ত মানুষকে ইট দিয়ে মাথা থেতলে খুন করার ঘটনা ছাড়া এ দেশে সিরিয়াল কিলিংয়ের তেমন কোন উদাহরণ নেই। সম্পত্তির লোভে আমাবশ্যায় কয়েকটা বাচ্চা খুন করে নোয়াখালীর সেই ইউপি চেয়ারম্যান সাড়া ফেলেছিল ঠিক। কিন্তু তার ধরণটা ছিল বেশ কাঁচা, মোটিভও পরিষ্কার। তার সঙ্গে কথা বলে আমার একজন অর্থলোভী ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি। খুনটা তার পারভার্সনের পর্যায়ে ছিল না। ফুটপাথের ঘাতক আমাকে ইন্টেরেস্টেড করেছিল। কিন্তু শেষমেষ পাগলের কাজ বলেই ধরা হলো। সেই কেসটায় অবশ্য চমকপ্রদ একটা ব্যাপার ছিল, খুনী কন্টিনিউ করেনি বলে ব্যাপারটা সেখানেই শেষ।
এত কথা বললাম, কারণ মনে হচ্ছে এতদিনে একটা মাথা ঘামানোর মতো কাজ নিয়ে এসেছো তুমি। আমার খুব ভুল না হলে, দিস ইজ আ ক্লিয়ার কেস অব সিরিয়াল কিলিং। বুদ্ধিমান, কিন্তু বিকারগ্রস্ত একজন খুনীর সঙ্গে টক্কর লাগতে যাচ্ছে তোমাদের। আমি আছি তোমার সঙ্গে। পুরো ব্যাপারটার খুটিনাটি আমাকে খুলে বলো।
দুই.
কেসটা হাসিবের কাছে রেফার করা হয়েছে গত সপ্তাহে। কালী উপাসক এক ব্যবসায়ীর কয়েকজন পরিচারিকাসহ খুনের ঘটনাটা আইজুদ্দিনের সহায়তায় সলভ করেছিল সে। গোয়েন্দা বিভাগে তার সুনাম আছে এজন্য। প্রমোশন এবং পদকও জুটেছে। এ বছর ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন হয়েছে প্রথম খুনটা। সুফিয়ান নাম। বিদেশ ফেরত যুবক, নতুন বিয়ে করেছে এসে। বউ নিয়ে যাবে। তার দুদিন আগেই খুন হয়ে গেলো। বউর প্রাক্তন প্রেমিককে ধরে এনে ধোলাই দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সে তরফে কোনো লিড মেলেনি। খুন করার কোনো মোটিভ ছিল না ছেলেটার। এলিবাইও ছিল। প্রমান মিলেছে খুনের সময় সে কোথায় ছিল। সেল ফোনের কলরেকর্ড চেক করে দেখা গেছে নিহতের স্ত্রীর সঙ্গে তার যোগাযোগ আসলেই অনেকদিন বিচ্ছিন্ন। তারপরও ভাড়াটে খুনী দিয়ে খুন করানোর সম্ভাবনাটা যাচাই করে দেখা হয়েছে। তেমন প্রমাণ মেলেনি।
সাভার-আশুলিয়া সড়কে গভীর রাতে লাশটা মিলেছিল। গাড়ির ভেতর। ড্রাইভ করছিল সুফিয়ান নিজেই । লাশের মাথা একপাশে হেলানো ছিল। চোখ উপড়ানো। বাংলাদেশে এখনও ময়নাতদন্ত হাতুড়ি-বাটাল সহকারে ডোমরাই করে থাকে। তাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ সূত্র মিসিং। ঘাড় মটকে হত্যা- ফাইনাল রিপোর্টে প্যান্ট না থাকার উল্লেখ ছিল। তৃতীয় খুনের পর এই ব্যাপারটাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে হাসিবের।
মার্চ মাসেই খুন হয়েছে পরপর দুজন। জয়দেবপুরে মিলেছে দীপ্র হাসান নামের একজন কবির লাশ। ন্যাশনাল পার্কে খুন হবার তিনদিন পর মিলেছে তার হদিস। মৃত্যুর সময় মিলিয়ে দেখা গেছে ঠিক পয়লা মার্চ খুন হয়েছে সে। শেয়াল তার শরীরের অনেকখানি খেয়ে গেছে। পাশে খুলে রাখা প্যান্ট থেকে মিলেছে ট্রেনের দুটো টিকেট। ঝোলায় কিছু কবিতার বই। একটি বইমেলায় সদ্য প্রকাশিত। উতসর্গ করা হয়েছে নিরুপমা নামের কাউকে। কবিতা তেমন বোঝে না হাসিব। নিতান্তই ইনিয়েবিনিয়ে ন্যাকান্যাকা কথামালা। তবে বেশ কটি কবিতার শুরুতে ব্রাকেটযুক্ত বাড়তি পংক্তি আছে যা নিরুপমা নামে কারো উদ্ধৃতি। কবিতা তারই রেশ কিংবা জবাব। হাসিব খোঁজ লাগিয়েছিল নিরুপমা নামের কোনো কবির অস্তিত্ব আছে কিনা জানতে। কেউ হদিস দিতে পারেনি। তবে উতসর্গ পত্রে দীপ্র নিজেই দিয়েছে নিরুপমার বয়ান। নিরুপমা তার ভার্চুয়াল প্রেমিকা। তারই উতসাহে নিজের কবিস্বত্বা পুনর্জীবন পেয়েছে। কাল্পনিক কেউ কিভাবে কাউকে জীবন দিতে পারে মাথায় ঢোকেনি হাসিবের। তার মৃত্যুর কারণেও ঘাড় মটকে হত্যা করা হয়েছে বলে বলা হয়েছে। চোখ উপড়ানো হয়েছে এরও।
২৯ তারিখ হয়েছে তৃতীয় খুন। সুরমা ভিলেজ নামে এক রিসোর্টের পাশে খুন হয়েছে তাসিফ নামের ছেলেটি। বাড়ি কুমিল্লা। কানাডা থেকে দুদিন আগেই ফিরেছে। একটা রেন্ট-আ-কারের গাড়ি ভাড়া করে এসেছিল। একাই এসেছে। তার কোনো সঙ্গী বা সঙ্গিনীর কথা বলতে পারেনি রিসোর্ট কর্মচারিরা। টেলিফোনে একটিই এসটিডি কলের রেকর্ড আছে। বাড়িতে ফোন করেছে। রিসোর্টের কাছাকাছি একটা দিঘির ঢালে পাওয়া গেছে তাসিফকে। অর্ধনগ্ন। চোখের কোটর শুন্য।
তৃতীয় খুনটার পরই টনক নড়েছে কর্তৃপক্ষের। হাসিবকে কেস অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রয়োজনে প্রফেসর আইজুদ্দিনের সাহায্য নিতে নির্দেশ পেয়েছে সে। আগের ঘটনাগুলোর তদন্তে লেজেগোবরে অবস্থা। তাই নথি বানাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে হাসিবকে। ভাগ্যিস ছবিগুলো ছিল। সব নিয়েই আইজুদ্দিনের দরবারে হাজির সে।
তিন.
-খুনগুলোর মধ্যে যোগসূত্র কোথায় বলে মনে হয় তোমার?
-সেটা খুঁজতেই তো আপনার কাছে আসা স্যার।
-মাথাটা একটু খাটাও তো হাসিব। স্পষ্ট বিরক্তি আইজুদ্দিনের গলায়। আমি বলছি সিরিয়াল কিলিং, কারণ খুনী একজনই। তার মোটিভটা কি বোঝা দরকার।
- খুনের ধরণ একই। ঘাড় মটকে মারা হয়েছে বলে লেখা আছে প্রতিটি রিপোর্টে। কিন্তু বাংলাদেশে তো খুনের আকাল নেই স্যার। প্রতিদিন যে হারে হচ্ছে, তাতে ফাইল বাড়ছে। অফিসাররাও ত্যক্ত। আয়েস করে তদন্ত করার সময় কোথায়! তবে প্রথম আর থার্ড ভিকটিমের তলপেটে স্ট্যাবিং করা হয়েছে বলে লেখা আছে। প্রথমজন, অর্থাৎ সুফিয়ানের গাড়ীর সিটে ব্লাড স্টেইন ছিল। গ্রুপ তার সঙ্গে মেলেনি।
- কথা ভুল বলনি। ব্লাড স্টেইন! আচ্ছা!! ভিক্টিম তিনজনেরই পরনে কাপড় ছিল না। মানে প্যান্ট খোলার মতো পরিস্থিতি হয়েছে নাকি খুনের পর খোলা হয়েছে এটা আনসার্টেইন। এ পর্যন্ত একটা মেয়েকে কল্পনা করে নেয়া যায়। ঘাড় মটকানোর ব্যাপারটায় আবার গোল পাকিয়ে যাচ্ছে সব। একজন জলজ্যান্ত মানুষের ঘাড় মটকে খুন করতে হলে রীতিমতো কুস্তি লড়তে হবে। সেক্ষেত্রে খুনী দুজনের টিম হতে পারে। একজন সিডিউস করছে, অন্যজন এসে ঘাড় মটকে দিচ্ছে। পসিবল। হতে পারে। তারপর চোখ উপড়ে নেয়ার মধ্যে একটা নৃশংসতা আছে। খুনীর সিগনেচার এটা। ভিক্টিমকে এটাই তার ম্যাসেজ। আচ্ছা নিরুপমার কাহিনী কি?
- দীপ্রর কবিতার বইয়ে ছিল নামটা। উতসর্গে লেখা ছিল নিরুপমা তার ভার্চুয়াল প্রেমিকা। কাল্পনিক নারী।
- ভার্চুয়াল ক্যারেক্টার। হুমম। ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে খোজ নিয়েছো?
- সেটা আবার কোথায় স্যার!
- ইন্টারনেটে। গুগলে নিরুপমা নামে সার্চ দাও। প্রতিটি চ্যাটরুমে খোজ লাগাও।
আচ্ছা মিডিয়া ব্যাপারটা কিভাবে দেখছে?
- তাইতো! এই ব্যাপারটা মাথায় আসেনি। ওই দীপ্র মরার পর একটু হৈচৈ হয়েছিল। হাজার হোক কবি মানুষ। বাকিদের খবর আর সব বারোয়ারি ঘটনার সঙ্গে চাপা পড়ে গেছে।
-এটা একটা ভালো খবর। পত্রিকাওয়ালারা নাক যত কম গলাবে ততই ভালো। আজ কত তারিখ, ২৫ না? হুমম। আমাদের খুনী মশাইর মাঠে নামার সময় হয়েছে।
- কি জানি স্যার। গত মাসে দুটো করে ফেলেছে, তাই এ মাসে রেস্ট নিচ্ছে মনে হয়। সিরিয়াল কিলিং সময় বেধে করতে হবে এমন কোনো নিয়ম আছে নাকি স্যার?
- না, রেস্টে না। শি শুড স্ট্রাইক এনি টাইম ফ্রম নাউ। পরের খুনটা ঠেকানো যাচ্ছে না যেহেতু, নিশ্চিত করো যে ডেড বডির কাছে আমি আর তুমিই প্রথম যাচ্ছি। কর্ডন স্লিপ দিয়ে আটকে দিতে বলবে তোমার লোকজনকে।
- শি! স্যার?
-আ’ম এইটি পার্সেন্ট সিউর ইটস আ শি।
চার.
হাসিব খুব একটা অবাক হয়নি। আইজুদ্দিনের কথা ফলবেই এটা অবধারিত, বরং না হলেই অবাক হতো। আর সেজন্য ২৪ ঘণ্টার বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। তার মন্তব্য সবসময়ই কনক্লুসিভ। লজিকাল পার্সপেক্টিভেই এগোন সবসময়। তবে পুরোটা বলার আগে অনেক ভাবেন । ডিভানে যে লোকটা শোয়া, তার বয়স ২৫-২৬ হবে। সুদর্শন। কাঠামো ভালো। পরনে কাপড় বলতে একটা শর্টস, পায়ের কাছে দলা পাকানো। রক্তের দাগ চোখের কোল বেয়ে গালে নেমেছে মোটা দাগে। লোমশ বুকটাও কালচে হয়ে আছে। নাভির নিচে অনেকগুলো স্ট্যাব করা হয়েছে। আইজুদ্দিন গ্লাভস গলালেন হাতে, হাসিব তাকে অনুসরন করল। ছবি তোলা হচ্ছে। আলতো করে লাশের কপালটা ধরে মাথাটা ঘোরালেন আইজুদ্দিন। ঘাড়ের খুব কাছে চোখ নিয়ে গেলেন। মুচকি হাসি তার ঠোটে। গ্লাভস খুলে ফেললেন। আর কিছু দেখার নেই।
-কি বুঝলেন স্যার?
-যেটা খুজছিলাম, পেয়ে গেলাম। খুনের পদ্ধতিটা দেখলে মনে হয় সহজ, কিন্তু পিনপয়েন্ট না হলে ঝামেলা। খুবই নিপুন হাতের কাজ। ঘাড়ের কাছে সার্ভাইকাল সেভেন আর এইটের মধ্যে দিয়ে সুঁই ঢুকিয়ে মেডুলা অবলঙ্গাটা ঘায়েল করেছে। সুইয়ের সাইজটা বড়ই হবার কথা। মাথার কাটাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে আদরের ছলে ঘাড় ধরে কাজটা করা হয়েছে প্রতিবার। আর ভিক্টিমের অর্গানটা দেখেছো। মরার পরও ইরেক্ট। দুভাবে ওটা সম্ভব, এক সেক্সুয়াল এসপাক্সিয়ায়। অনেক সময় শ্বাসরোধ করে অনেকে অর্গাজমিক আনন্দ খোজে, ফাসির লাশে দেখবে এমন থাকে। আরেক হতে পারে, মারার আগে তাকে উত্তেজিত করার হয়েছে। এবং এটাই একমাত্র পসিবিলিটি। মরার পর লাশ নিয়ে যথারীতি পাশবিকতায় মাতা হয়েছে। থরো ইনভেস্টিগেশনের একটা রিপোর্ট আমাকে দিও। আর নিরুপমার খোজ লাগাও। সে খুনী হয়ে থাকলে তার এনাটমিকাল জ্ঞান অগাধ। পেশায় ডাক্তার হলেও বিচিত্র হবে না।
-নিরুপমার খোজ পাওয়া গেছে স্যার। ইন্টেরেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে সে প্রতিটি ভিকটিমের সঙ্গেই রিলেটেড।
-ইন্টেরেস্টিং না হাসিব। ইট ওয়াজ অভিয়াস।
(পরের কিস্তিতে শেষ)