ত্বং তদুকথমিন্দ্র বর্হনাক: প্রযচ্ছতা সহসা শূর-দর্ষি। অব গিরের্দাসং শনবরংহন প্রাবী দিবোদাসং চিত্রাভিরূতী!! (ঋগ্বেদ ৬/২৬/২৫)
খ্রিস্টপূর্বাব্দ ১৫০০।
কুরুপঞ্চালের রাজা শ্রীমান দিবোদাস।
কুরুপঞ্চাল হলো ভারতবর্ষের উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চল। দিবোদাস তার আর্য বংশীয় নৃপতি।
আর্য আর অনার্য অসুরদের সমন্বয়ে গড়া পঞ্চাল জনগোষ্ঠীর এই প্রতিভাবান নৃপতি এক মধুর অস্বস্তিতে পড়েছেন।
পঞ্চাল ভূমির আর্য পুরোহিত ঋষি বশিষ্ঠ, ভরদ্বাজ ও বিশ্বামিত্র তাকে নিয়ে এক নতুন খেলা শুরু করেছে। তাকে নিয়ে আর্য ভাষায় শ্লোক ও স্তুতিবাক্য লেখা শুরু হয়েছে। এই স্তুতিবাক্য জিনিসটা দিবোদাসের পূর্বপুরুষদের মূল্যবোধের সাথে যায়না। এইসব প্রশংসা তার ভাল লাগছে আবার লাগছেওনা। কেমন এক ধরণের অহংকার অনুভব হচ্ছে আবার পূর্বপুরুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতেও মন সায় দিচ্ছেনা।
আর্যদের পূর্বপুরুষরা বক্ষু উপত্যকায় (তাজিকিস্তান) যখন বাস করত তখন তাদের জন(গোত্র) পরিচালিত হতো সাম্যবাদী পদ্ধতিতে। তাদের ভেতরে ব্যক্তিশাসনের চল ছিলনা। ছিল সাধারণের শাসন। ফলে সেখানে এইসব স্তুতি রচয়িতা চাটুকারের অস্তিত্ব ছিলনা।
কিন্তু এখন তার জীবন বদলে গেছে। দুটি যুদ্ধে সেনাপতির দায়িত্ব সাফল্যের সাথে পালন করে সে জনপতি হয়েছে।
চাটুকার পুরোহিতরা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে।
পঞ্চালের অনার্যরা দেবতায় বিশ্বাসী। পুরোহিতরা প্রচার করছে ইন্দ্র, অগ্নি, সোম, বরুন প্রভৃতি দেবতা রাজাকে পাঠিয়েছে পৃথিবীর প্রজাদের শাসন করতে। কাজেই সাধারণ মানুষ রাজাকে মেনে চলে আর যথাবিহীত সম্মান প্রদর্শন করে।
এরা কেবল তার স্তুতিই লিখছেনা, অন্ত:পুরে তাদের কন্যাদের পাঠিয়ে রাজাকে ভোগে বিলাসে নিমগ্ন করে তুলছে।
এরকম পরিস্থিতিতে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে দিবোদাসের পুত্র সুদাস।
সুদাস গৃহত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রবঞ্চক পিতার উত্তরাধিকারী সে হতে চায়না।
যাবার আগে মুখোমুখি হয় পিতার।
- আমি এই বিলাসী প্রাসাদে অস্বস্তি বোধ করছি পিতা। এ মিথ্যা রাজত্ব আমাকে দিয়ে হবেনা।
- তুমি কি এরজন্য আমাকে দায়ী করছ পুত্র?
- না এককভাবে আপনাকেই করছিনা। বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্রের মত অনেক কুমীরই আছে এর সাথে।
- আমি সময়ের দাস। এই পঞ্চালের সাধারণ মানুষ এভাবে বিশ্বাস করতেই পছন্দ করে যে রাজা দেবতা কর্তৃক প্রেরিত প্রতিনিধি।
- করে, কারণ আপনার পুরোহিতরা শ্লোক লিখে তাদের উপর মায়াজাল সৃষ্টি করেছে।
- এই মায়াজালের কাছে আমিও তুচ্ছ হে পুত্র। আমি কালের বশ মাত্র। আমি না থাকলে কি হবে? বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্ররা প্রস্তুত হয়ে আছে। ধর্ম-সামন্ত শকুনের মত ঝাঁপিয়ে পড়বে প্রজাদের উপর। কিন্তু আমি বলে দিতে পারি প্রিয় পুত্র, আজ হতে কয়েক হাজার বছর পরও মানুষের নতুন নতুন জ্ঞান চক্ষু উন্মীলিত হবে। তারপরও এই বশিষ্ঠদের মিথ্যা শ্লোক বেদবাক্য হয়ে ধর্মগ্রন্থের মর্যাদাই পাবে মানুষের কাছে।
( রাহুল সাংকৃত্যায়নের ' মানব সমাজ ' ও 'ভোলগা থেকে গংগা' অবলম্বনে লেখা)
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ৯:৪০