ঘর থেকে যখন বেরুলাম তখনি পেলাম বৃষ্টির দেখা। গাড়ির ধুলো পড়া উইন্ডস্ক্রিন বৃষ্টির মধুর দানায় ধুয়ে যেতে লাগলো । আমি জানালার কাচ নামিয়ে হাত বাড়ালাম। এক হাতে বৃষ্টিকে ছুঁই। আরেক হাতে গাড়ির লাগাম।
গন্তব্য গুলশান। ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারে আজ ছিল রাধারমনের গান। শিল্পী বিশ্বজিত রায়।
বিশ্বজিত রায় রাধারমনের গানের বিশেষায়িত শিল্পী। বাংলাদেশে এই মূহুর্তে তিনিই একমাত্র রাধারমনের গান করেন বিশেষ ভাবে।
রাধারমন সম্পর্কে খুব বেশী তথ্য পাওয়া যায়না। তার গান আলাদা করে পাওয়াও কঠিন। ২০০৮ সালে বিশ্বজিত রায় একটি অ্যালবাম বের করেছিলেন। এরপর দুই বছর পর আরেকটি। আমি ২০০৯ সালে যখন প্রথম তার অ্যালবামটি শুনি রাধারমন সম্পর্কে নতুন করে ধারণা হয়। ফেসবুক স্বাক্ষী,বুদ হয়ে শুনেছিলাম সেই গান। ফলে পেপারে যখন দেখলাম বিশ্বজিত রায় গাইবেন তাও আমার বাসার কাছেই। লোভ সামলানো গেলনা।
তাপিত ধরা শীতল বায়ে যখন দগ্ধ প্রান জুড়ায় আমি তখন ইন্দিরা গান্ধীর হল রুমে রাধারমনের সুরের ধারায় অন্তর জুড়ানোর আশায়।
বাশী আর দোতরার সংগতে শুরু হলো গান।
ও আমার প্রান থাকিতে রাই আইন্না দেখারে সখী
জন্মের মত দেইখা যাই
একবার জন্মের মত দেইখা যাই
কেমন আছে কমলীনি রাই।
বল বল বল ছাই...............
রাধারমণ দত্তের জন্ম সুনামগঞ্জে। ১৮৩৩ সালে জন্ম। বেচে ছিলেন ১৯১৫ অব্দি। বাবা রাধামাধব দত্তও গানের মানুষ ছিলেন। রাধারমণ ছিলেন বৈষ্ণব প্রভাবিত। মানব প্রেমের ভেতর দিয়ে স্রষ্টার অনুসন্ধান করেছেন। শ্রী চৈতন্যের কথা তার গানে পাওয়া যায়।
ও আমি যার কারনে বৃন্দাবন রে সুবল কান্দিয়া সদাই বেড়াই...........
রাধারমণের গানে রাধার বিরহ যেমন আছে তেমনি আছে কৃষ্ণর বিরহ। এটা নাকি রাধারমণের একটি বিশেষত্ব। "তিনি কেবল রাধাকেই বিরহ কাতর দেখাননি কৃষ্ণকেও পুড়িয়েছেন বিরহ অনলে"।
উভয়ের সমান অধিকার।
রাধে গো দেখার যদি ইচ্ছা থাকে আইসো রাই যমুনার ঘাটে
কাল সকালে কলসী কাখে লইয়া
অথবা
রাধে গো আমার কথা নাই তোর মনে
প্রেম করছো আয়ানের সনে
শুইয়া আছো নিজ পতি লইয়া.........
কৃষ্ণের বিরহ এবং ঈর্ষাকাতরতার নমুনা। পরকীয়া প্রেম এখানে অনেক বেশী বোল্ড। (বিশ্বজিত গানটা যখন গাইছিলেন সাদিয়া তখন পাশে বসা, স্বীয় স্ত্রীর সাথে পরকীয়া সংগীত উপভোগ)
রাধারমণের গানের সুর গুলোও আলাদা। ভাটিয়ালী এবং রাগ সংগীতের মিশ্রণ। সুরে লোকগানের তীব্রতা নেই, মেলোডি আছে। কোমল স্বরের ব্যবহার বেশি। বিরহের হাহাকার সুরের পরতে পরতে।
গানের কথা গ্রামীন সরলতায় ভরা।
বন্দে যখন বাজায় বাশি আমি তখন রান্ধি
ভিজা লাকড়ি চুলায় দিয়া ধুমার ছলে কান্দি
ও বাঁশী রে..............
রাধারমন গান লিখেছেন ২০০০। কেউ বলেন তারো বেশি। কেউ বলেন রাধারমণ তার ছদ্ম নাম। অধিকাংশ সুর হারিয়ে গেছে। অনেক গানে নতুন করে সুর দিয়েছেন সুনাম গঞ্জের আরেক কিংবদন্তী বিদিত লাল দাশ। পন্ডিত রামকানাইদাশও অনেকগুলিতে সুর দিয়েছেন। প্রথম জন বেচে নেই। রামকানাই দাশ থাকেন কানাডায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালন সাই ও হাসন রাজাকে ইন্ট্রডিউস করেছিলেন নাগরিক শ্রোতার কাছে। রবিবাবুর দেখা পেলে হয়ত রাধারমণ আরো বেশী সুবাস ছড়াতে পারতেন।
রাধারমণ সিলেটের বিখ্যাত ধামাল গানেরও প্রবর্তক। ঘেটু গানের সুরের সাথে এর মিল আছে।
সব কিছু ছাপিয়ে রাধারমণ প্রেমের সাধক। অন্তর ছেড়া বিরহের কান্না তার গানের চরনে চরনে।
ভ্রমর রে
আগে যদি জানতাম রে ভ্রমর যাইবরে ছাড়িয়া
দুই চরন বান্ধিয়ারে রাখতাম মাথার কেশ দিয়া........
.................
অনুষ্ঠানের শেষে বের হয়ে দেখি রাস্তা খটখটে। বৃষ্টি যে এসেছিল বোঝার উপায় নাই। শুধু দাবদাহ একটু কমেছে। বাতাসে একটা শীতলভাব। রাধারমণের সুরে ভেতরটা যেমন শীতল হয়।
আমার বন্ধু দয়াময়
তোমারে দেখিবার মনে লয়
গাড়িতে বিশ্বজিত রায়ের সিডি ঢুকানোই ছিল। ফলে আবারো রাধারমন।
ধন্যবাদ বিশ্বজিত রায়।
২৬.০৪.২০১৪