আমাদের প্রাইভেট টিভি চ্যানেলগুলি সাংঘাতিক রকমের সৃজনশীল। তারা যখন যেটাকে নিয়ে পড়ে একেবারে খবর করে ছেড়ে দেয়। এই দেশে অনেকদিন পর্যন্ত টিভি চ্যানেল ছিল একটি। সবেধন বিটিভি। আমাদের তাবত সৃজনশীলতা ও শিল্পচর্চা ছিল তাকে ঘিরেই। এরপর এলো প্রাইভেট চ্যানেল। বঙ্গদেশের বিপুল সৃজনশীলতা অবরুদ্ধ আবেগের মত, হঠাত জোয়ারের মত ফুলে ফেপে উঠলো। আমরা বোকা বাক্সে নানান রকম অনুষ্ঠান উৎপাদিত হতে দেখলাম। দেখতেই থাকলাম।
এর মধ্যে রান্নার অনুষ্ঠান বলে এক ধরনের অনুষ্ঠান জনপ্রিয় হতে শুরু করলো। একটি চ্যানেলের অনুষ্ঠান ছিল সত্যিই মান সম্পন্ন। সেটা জনপ্রিয় হলো। চ্যানেলের ভাষায় ‘পাবলিক খাইসে’। এরপর এক চ্যানেলের দেখাদেখি আরেক চ্যানেল, তারপর সব চ্যানেল। প্রত্যেকেরই রান্না করা চাই। আমি সুযোগ পেলেই অনুষ্ঠানগুলো দেখি। অদ্ভুত সব রান্না হয়। সৃজনশীলতার চূড়ান্ত। যার সাথে যার মিলবার নয় তাকেও মিলিয়ে দেওয়া হয়।
এক ভদ্র মহিলা, যিনি মূলত ওবেসিটিতে আক্রান্ত, তিনিও তাদের পারিবারিক টিভি চ্যানেলে রান্নার অনুষ্ঠান খুলে বসলেন। তিনি টিভিতে খাবারে সংযমী হওয়ার পরামর্শমূলক কোন অনুষ্ঠানের এংকর হতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে টিভিতে নানান রকম মজাদার রান্নার রেসিপি নিয়ে আসতে লাগলেন। আমরা নতুন নতুন পদের রান্না দেখতে পেলাম, তারও ওবেসিটি বাড়তেই থাকলো।
ধরে নিলাম তার নাম কুহু। কুহু ফেরদৌসী।
কুহু ম্যাডামের সৃজনশীলতা মারাত্মক। তিনি মাঝে মাঝেই দেশ-বিদেশে গিয়ে রান্না করেন। রোজার সময় সৌদি আরব গিয়ে রান্না করেন। তিনি যে সত্যি সত্যি সৌদি আরবে গিয়েছেন সেটা বোঝানোর জন্য খেজুর গাছের নিচে উন্মুক্ত মরুভূমিতে বোরকা আবৃত হয়ে আলোক চুলায় রান্না করতে থাকেন। সাথে আরেক সহকারী বোরকা। তিনি সম্ভবত স্থানীয় প্রতিনিধি। (পাশে একটা উট বাধা থাকলে ষোল কলা পূর্ণ হতো। সম্ভবত উট ম্যানেজ হয়নি।) সৌদি আরবের সবাই খোলা মরুভূমিতে রান্না করেন কিনা কে জানে।
কুহু ম্যাডামের বিশেষ দিবসের রান্না গুলিও হয় সেই রকম। দিবসের সাথে মিলিয়ে। একবার তিনি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনে রেসিপি নিয়ে আসলেন “শাহী কা্জী মাটন”। কাজী নজরুল ইসলাম নাকি এটা খেতে পছন্দ করতেন। স্বাক্ষী মেনে হাজির হয়েছেন স্বয়ং কবির নাতনী খিলখিল কাজী। তারপর অতিথি খেয়ে তার প্রশংসাও করলেন। এই খিলখিল ম্যাডামের যখন জন্ম হয় হিসাব মতে কবির তখন বাহ্যজ্ঞাণ থাকবার কথা নয়। কারণ বিদ্রোহী কবি পিকস ডিজিজে আক্রান্ত হয়েছিলেন তার জন্মের বহু আগেই। তিনি কবির এই রেসিপি পেলেন কোথায় কে জানে।
বছর দুয়েক আগে কুহু ম্যাডাম ২৬ মার্চে স্বাধীনতা দিবসে তাদের পারিবারিক চ্যানেলের পর্দায় এক নতুন রেসিপি নিয়ে আসলেন। রেসিপির নাম “মুক্তিযোদ্ধা খিচুড়ী”। এরকম রেসিপিও যে হতে পারে সেটা না দেখলে আমার বিশ্বাসই হতোনা। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের যোদ্ধারা নাকি এইরকম সব্জী দেওয়া পাতলা খিচুড়ী খেতেন। তাই এর নাম “মুক্তিযোদ্ধা খিচুড়ী”। কুহু ম্যাডাম ধরেই নিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা ওটা শখ করে খেতেন।
কুহু ম্যাডাম ফ্যাশান হাউজের মালিক হলে নিশ্চয়ই মুক্তিযোদ্ধা লুংগী,মুক্তিযোদ্ধা ফতুয়া প্রভৃতি বাজারে নামাতেন। সেসব পরে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লুংগী ড্যান্স দিতাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বা অন্য কোথাও। টিভি চ্যানেল কি লাইভ দেখাত?
পুনশ্চঃ আমি ভয়েই এবছর স্বাধীনতা দিবসে কুহু ম্যাডামের টিভি চ্যানেলে ঢুঁ দেইনি। একবার ভেবেছিলাম দেখি কি করে। পরক্ষণে ভাবলাম থাক, আবার কি না কি দেখি। যদি লোড নিতে না পারি?