খবরটা শুনে ফজু মিয়ার মেজাজ চরম খারাপ । ‘ঢাকা শহর মেলেটারীরা গোরস্তান বানাইয়া ফালাইছে’। ফজু মিয়া আখাউড়া রেল স্টেশনের কুলি। মাল টানা ছাড়া তার আর কোন কাজ নেই। নেহায়েত নিরীহ এই মানুষটার শরীরে আগুন ধরে গেছে। কেন ধরেছে সে নিজেও জানেনা। শুধু মনে হচ্ছে “শরীল থেইক্কা রক্ত ফুইট্টা বাইরাইতাছে”।
ফজু মিয়া যুদ্ধে যায়। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় মেজর শফিউল্লাহর সামনে । নৌ কমান্ড দল গঠন হবে। সুইসাইডাল স্কোয়াড।ফজু মিয়া রাজি।
পেছনের কথাঃ মার্চের শুরুর দিকে পাকিস্তানি সাবমেরিন পি এন এস ম্যাংরো ফ্রান্সের তুলন সাবমেরিন ডকইয়ার্ডে যায় পাকিস্তানি সাবমেরিনারদের প্রশিক্ষন দেয়ার জন্য। সেই ৪১ জন সাবমেরিনারদের মধ্যে ১৩ জন ছিলেন বাঙালি অফিসার। তারা আনতর্জাতিক প্রচার মাধ্যমে ২৫ মার্চের গণহত্যার কথা শুনে পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসার সিদ্ধানত নেন। এর মধ্যে ৮ জন ৩০ মার্চ বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ৯ এপ্রিল ১৯৭১ তারা দিল্লিতে এসে পৌছান। এরা হলেন
১. মোঃ রহমতউল্লাহ।
২. মোঃ সৈয়দ মোশাররফ হোসেন।
৩. মোঃ শেখ আমানউল্লাহ।
৪. মোঃ আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী।
৫. মোঃ আহসানউল্লাহ।
৬. মোঃ আবদুর রকিব মিয়া।
৭. মো আবদুর রহমান আবেদ।
৮. মোঃ বদিউল আলম।
তারপর উক্ত ৮জনের সাথে আরো কয়েকজনকে একত্র করে ২০ জনের একটি গেরিলা দল গঠন করে তাদের ভারতে বিশেষ ট্রেনিং দেয়া হয়। তারপর দেশে আসলে তাদের সাথে কর্নেল ওসমানীর দেখা করানো হয়। তখন ওসমানী নৌ-কমান্ডো বাহিনী গঠনের সিদ্ধানত নেন।
নৌকমান্ডো ফজু মিয়া ঃ ফজু মিয়া নৌ কমান্ডো দলে নাম লেখান। আখাউড়া রেল স্টেশনের মালটানা কুলি ফজুমিয়া এখন নৌ কমান্ডো। তাকে নেওয়া হলো পলাশী, ভাগিরথী নদীর তীরে। প্রতিদিন আঠারো ঘন্টা পানিতে ডুবে ট্রেনিং চলে। আখাওড়া বিলে কত সাঁতরেছে ফজু মিয়া! পাল্লা দিয়ে তিতাস এপার ওপার করেছে। এখন দেশের জন্য তার জল বিহার। ফজু মিয়ার জীবন এখন বাজির তাশ। পেটে লিমপেট মাইন, কোমওে ছুরি, মুখে জয় বাঙলা। “আমরা মরবার লাইগ্গাই তো আইছি” ফজু মিয়া বলে। ভারতীয় প্রশিক্ষকের চোখে পানি চলে আসে “হায়, ভগবান এদেও কি ধাতু দিয়ে গড়েছে”!
ট্রেনিং পর্বঃ নৌ-কমান্ডোদের ঐ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন ভারতীয় নেভাল অফিসার লেঃ কমান্ডার জি এম মার্টিস। প্রশিক্ষকদের মধ্যে ফ্রান্স থেকে পালিয়ে আসা ৮ জন সাব-মেরিনার ছাড়াও আরো ছিলেন মিঃ গুপ্ত, পি কে ভট্টাচার্য, কে সিং, এল সিং, মারাঠি নানা বুজ এবং সমীর কুমার দাশসহ আরো কয়েকজন।
ট্রেনিং শুরু হবার আগেই বাছাইকরা যোদ্ধাদের বলে দেয়া হয় যে এটি একটি সুইসাইডাল অপারেশন বা আত্মঘাতী যুদ্ধ হবে। তাই প্রশিক্ষণের শুরুতেই প্রত্যেকের ছবি সহ একটি সম্মতিসূচক ফর্মে স্বাক্ষর নেয়া হতো।সেখানে লেখা থাকতো যে, আমি দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন বিসর্জন দিতে সম্মত হয়েই এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছি, আর যুদ্ধে আমার মৃত্যু ঘটলে কেউ দায়ী থাকবে না।
প্রায় টানা দু'মাস ট্রেনিঙের পর আগস্টের প্রথম সপ্তাহে তাদের ট্রেনিং শেষ হয়।
অপারশনে জ্যাকপটঃ
প্রশিক্ষণ শেষের দিকে। আক্রমনের পরিকল্পনা সাজানো হতে থাকে। একই সাথে একই সময়ে দুই সমুদ্র বন্দর ও দুই নদী বন্দরে আক্রমন চালানোর পরিকল্পনা হয়। ৬০ জনের ২টি দল এবং ২০ জনের আরো ২টি দল। চারটি দলের চারজন লিডার ঠিক করা হল। টিম লিডারদের অপারেশন পরিচালনার জন্য শিখিয়ে দেয়া হয়েছিল বিশেষ পদ্ধতি যা টিমের অন্যান্য সদস্যদের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল। দুটি পুরোনো দিনের বাংলা গানকে সতর্ক সঙ্কেত হিসেবে ব্যবহার করা হবে। গানদুটি ও তাদের সঙ্কেত হলোঃ-
১. আমি তোমায যত শুনিয়েছিলাম গান,তার বদলে চাইনি প্রতিদান......। এটি হবে প্রথম সঙ্কেত, এর অর্থ হবে ২৪ ঘন্টার মধ্যে ২য় গান প্রচার হবে। এর মধ্যে আক্রমনের সকল প্রসতুতি সম্পন্ন কর।
২. আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুর বাড়ি......। এটি ২য় এবং চূড়ানত সঙ্কেত। অর্থাৎ এরপর যে ভাবেই হোক আক্রমণ করতে হবে।
যাত্রা শুরুঃ পলাশির হরিনা ক্যাম্প থেকে যাত্রা শুরু । পরিকল্পনা অনুযায়ী সিদ্ধানত হয়েছিল, তারা একযোগে পৌছে যাবেন স্ব স্ব এলাকা চট্টগ্রাম,খুলনা, চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ। তাদেরকে প্রয়োজনীয় অস্ত্র দিয়ে দেয়া হয়। প্রত্যেক নৌ-কমান্ডোকে একটি করে লিমপেট মাইন,ছুরি,একজোড়া সাঁতারের ফিন আর কিছু শুকনো খাবার। প্রতি তিন জনের জন্য একটি করে স্টেনগান এবং গ্রুপ লিডারদের একটি করে ট্রানজিস্টার। অপারেশনের দিন ধার্য করা হয়েছিল ১৪ আগস্ট অর্থাৎ পাকিসতানের স্বাধীনতা দিবস। তবে সূদূর পলাশী থেকে গন্তব্যস্থলে পৌছাতে বা পথের নানা প্রতিবন্ধকতা কারণে এসব অভিযান দু'এক দিন বিলম্ব হয়।
চট্টগ্রাম বন্দরে অপারেশন পরিচালিত হয় ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে অর্থাৎ ১৬ আগস্ট প্রথম প্রহরে। এ সফল অপারেশনে তিনটি বড় অস্ত্রবাহী জাহাজ এবং একটি সোমালি জাহাজসহ আরো অনেকগুলো জাহাজ ধ্বংস হয। ১৬ আগস্ট একই সাথে মংলা বন্দরেও অপারেশন হয। এ অপারেশনে তারা বন্দরে অবস্থানরত ২টি মারাঠি, ২টি চীনা, ১টি জাপানী ও ১টি পাকিস্তানি অর্থাৎ মোট ৬টি জাহাজ এবং আরো কিছু নৌযান ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হন।১৫ আগস্টের ঐ অপারেশন গুলোতেই প্রায ২৬টি জাহাজ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয এবং আরো অনেক নৌযান ক্ষতিগ্রস্থ হয। বলা যায় পাকিস্তানীদের কোমর ভেঙ্গে যায়, আত্ম বিশ্বাসে চিড় ধরে। তাছাড়া ধ্বংসের তালিকায় বেশ কয়েকটি বিদেশী জাহাজ থাকায় আন্তজার্তিক মিডিয়ায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা ছড়িয়ে পড়ে।
এবং একজন ডাক্তারঃ এই ঘটনার চল্লিশ বছর পর ডিসেম্বর মাসে এক ডাক্তার যায় নৌ কমান্ডো ফজলুর রহমান ভুঁইয়ার বাড়িতে। বাড়ি বলা যাবে কি? সরকারি খাস জায়গা, একটা পুকুরের বর্ধিত পাড়ে কোন রকম একটা ঘর। ডাক্তার সাহেব ঢাকায় থাকেন। পেপার টেপারেও লেখেন। নাটক টাটক ও করেন। সব মিলিয়ে এক উদ্ভট মানুষ। ডাক্তার একটা ক্যাম কর্ডার নিয়ে এসেছেন। উদ্দেশ্য একটা ইন্টারভিউ নেবেন। ভিডিও করবেন তার কথা। ফজলুর রহমান কথা বলেন। বলতে বলতে কাঁদেন, কখনো ফোঁসেন। তার সহযোদ্ধাদের কিভাবে ভুলিয়ে ভালিয়ে পাকিস্তানীদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন সাবেক এক মন্ত্রী , সেই কাহিনী বললেন। বলতে বলতে দুটো অশ্লীল গালি দেন। ডাক্তার ফজলুর রহমানকে আরো উত্তেজিত করার চেষ্টা করেন। ডাক্তার চালু মানুষ, তিনি জানেন উত্তেজনা ছাড়া বিষয়টা জমবেনা। “এই যে যুদ্ধ করলেন,কি পাইলেন? দেশ স্বাধীন করলেন অথচ এখন এই বয়সে ও আপনে ঠেলা গাড়ি চালান, পুকুর পাড়ে ভাঙ্গা ঘরে থাকেন”। ফজলুর রহমান , নৌ কমান্ডো, ভাবলেশ হীন।“ বিল্ডিং দেওনের লাইগ্গা তো আর দেশ স্বাধীন করি নাই। আমরা আসিলাম সুইসাইড টিম। মরনের লাইগ্গা যুদ্ধ করছি। বাইচ্চা যে রইছি , স্বাধীন দেশটারে দেখলাম, এইডাইতো বেশী”। ডাক্তার হতবুদ্ধি হন,মানুষটা বলে কি? চোখে পানি চলে আসে, এই ফজলুর রহমানরা কি ধাতু দিয়ে তৈরী কে জানে?
তথ্যঋণঃ অপারেশন জ্যাকপট- সেজান মাহমুদ
ব্লগার আলী মাহমেদ