এ.এইচ.এম. ফারুক:
একটি প্রবাদ প্রায়ই শোনা যায়, ‘বেড়া যদি ক্ষেত খায়!’ হ্যাঁ, বেড়ার ক্ষেত খাওয়ার মতো ঘটনাই ঘটছে রাজধানী ঢাকা শহরের পাঁচ শতাধিক এবং দেশের প্রায় দু’হাজার মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের বেশির ভাগে। সরকারিভাবে রাজধানীসহ সারাদেশে মাত্র ৪টি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় নিরাময় কেন্দ্র কম হওয়ার ফলে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের নামে গড়ে তুলেছে বেসরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র। আর সরকারের যথাযথ তদারকি ও নজরদারি এবং সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের উপরি কামাইয়ের লোভে অবাধে ও নিরাপদে মাদক ব্যবসার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে অধিকাংশ মাদক নিরাময় কেন্দ্র। পরিবারের লোকজন মাদকসেবীদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে সম্মান ও সংঘাত এড়াতে মাদকাসক্ত আপন লোকটিকে টাকার বিনিময়ে নির্বিঘেœ মাদক গ্রহণের ব্যবস্থা করতেও দ্বারস্থ হচ্ছে তথাকথিত মাদক নিরাময় কেন্দ্রগুলোর। তাদের পরামর্শে ভর্তি করে দেয়া হচ্ছে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে। সরেজমিনে ঘুরে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রগুলোর ব্যাপারে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। পাঠকের সুবিধার্থে কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা হলো :
মাদকাসক্তদের সুস্থ, সুন্দর জীবনে ফিরিয়ে আনতে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ‘মাদক নিরাময় কেন্দ্র’ কাজ করছে। একেকটি কেন্দ্রের চিকিৎসা ব্যবস্থার ধরন একেক রকম। বিশেষ করে রাজধানীর অলিগলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা মাদক নিরাময় কেন্দ্রগুলোর চিকিৎসাব্যবস্থার ধরণ রীতিমতো শিউরে ওঠার মতো। সেগুলোতে মাদকাসক্তদের সুস্থ করার নামে চলে নানা অপচিকিৎসা। নিবন্ধনহীন প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা করাতে আসা রোগীরা প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। অনেক কেন্দ্রের বিরুদ্ধে রয়েছে মাদকাসক্তি নিরাময়ের নামে মাদকদ্রব্য বেচাকেনার অভিযোগ। বিধিমালা ভঙ্গ করে অধিকাংশ মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র কথিত চিকিৎসার প্রয়োজনের কথা বলেও ব্যবহার করা হচ্ছে মাদক। এ যেন ‘সর্ষের ভেতরই ভূত’!
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা মহানগরে অবৈধ প্রায় পাঁচ শতাধিক মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র আছে। রাজধানীর বাইরে আছে আরও প্রায় তিন গুণ। এগুলোকে সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখিয়ে কেউ কেউ সমাজসেবা অধিদফতর বা ঢাকা সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কাছে সনদ নিয়ে কেন্দ্র পরিচালনা করছেন। এসব কেন্দ্রে চিকিৎসা সুবিধা বলতে কিছু নেই, আছে অভিযোগ আর অভিযোগ। রোগীর ওপর শারীরিক নির্যাতন, মাদকের ব্যবসা পরিচালনা ও রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে ইচ্ছামতো অর্থ আদায় করার অভিযোগ তো রয়েছেই।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্র জানায়, ২০০৫ সালে প্রণীত হয় ‘মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র ও মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা বিধিমালা’। বিধিমালা অনুসারে কেন্দ্র পরিচালনার জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর থেকে নিবন্ধন নেয়ার কথা; কিন্তু এ পর্যন্ত ঢাকা মেট্রো উপ-অঞ্চলে ১৭ ও সারাদেশে ৬৯টি কেন্দ্র বেসরকারি নিবন্ধন নিয়েছে। এছাড়াও ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনায় চারটি সরকারি মাদকাসক্ত পরামর্শ, নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র রয়েছে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বেশ কয়েকটি অবৈধ কেন্দ্রের সন্ধান মেলে। এদের মধ্যে রাজধানীর বেড়িবাঁধের পাশে টিনশেডের আধাপাকা একটি বাড়ি। ছোট ছোট পাঁচটি কক্ষ। নেই আলো-বাতাসের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা, ঘরের জানালা বলতে টিনকাটা ফোকর। তার মধ্যেই রান্না ও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। চিকিৎসক নেই, নেই চিকিৎসা সরঞ্জাম। অবিশ্বাস্য হলেও এটি একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র। মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ সংলগ্ন ঢাকা উদ্যানের এ কেন্দ্রটির নাম ‘নিউ তরী’। এর পাশে ‘জীবনের আলো’ ও ‘ফিউচার’ নামের আরও দুটি কেন্দ্রের একই চিত্র। পশ্চিম যাত্রাবাড়ীর দয়াগঞ্জ মোড়ের হাদী, উত্তর যাত্রাবাড়ীর দিশারী, যাত্রাবাড়ীর শহীদ ফারুক রোডের নতুন জীবন, তেজগাঁওয়ের আরাধনা, দনিয়ার উৎসব, মিরপুরের পাইকপাড়া আহমদ নগরে হিরা, মিরপুর উত্তর বিশিল এলাকার পরিবর্তন, শ্যামলী বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন নিরাময়, খিলগাঁও রেলগেট সংলগ্ন নির্বাণ, খিলগাঁও চৌরাস্তা আইডিয়াল কলেজ সংলগ্ন রূপান্তর, খিলগাঁও মেরাদিয়া ভূঁইয়াপাড়ায় প্রান্তি, উত্তর গোড়ান সিপাহীবাগে সৃষ্টি, দক্ষিণ গোড়ান শান্তিপুরে স্বপ্ন মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রসহ বিভিন্ন এলাকায় শতাধিক অবৈধ কেন্দ্র রয়েছে। পশ্চিম যাত্রাবাড়ী দয়াগঞ্জ মোড়ে মদিনা হাসপাতালের অন্তরালে সাইনবোর্ডবিহীন অবৈধভাবে অবাধে ব্যবসা চালাচ্ছে হাদী নামক মাদক হ্রাস কেন্দ্রটি। কৌশলে জানা যায়, এখানে মেঝেতে ঢালা বিছানায় ২০-৩০ জন ও কেবিনের মাধ্যমে নিয়মনীতি না মেনে চিকিৎসা দেয়া হয়। এ ব্যাপারে হাদীর কর্মকর্তা লিটন অনুমোদনের ব্যাপারে কোনো সদুত্তর দেননি। তার মতে, লাইসেন্সের দরকার নেই। এ বিষয়ে গোড়ান সিপাহীবাগের প্রশান্তির কো-অর্ডিনেটর ফারুক রহমান মিন্টু বলেন, সরকারকে নিয়মিত ট্যাক্স-ভ্যাট দিয়ে মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছি। বাণিজ্য নয়, আমাদের মূল লক্ষ্য সেবাদান।
‘নিউ তরী’ নিরাময় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, দুটি কক্ষের মেঝেতে ২৫ জন রোগীর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি কক্ষ তুলনামূলক বড় হওয়ায় দিনে সেখানে রোগীদের মানসিক চিকিৎসা বিষয়ে পরামর্শ দেয়া হয়। রাতে ওই কক্ষের মেঝেতে বিছানা পেতে রোগীরা ঘুমান বলে জানান প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। এখানে জরুরি বিদ্যুতের জন্য নিজস্ব জেনারেটর নেই। রোগীদের রুচিশীল বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। পাশের ‘ফিউচার কেন্দ্র’র পরিবেশ ছিমছাম। তবে রোগীদের ঘুমানোর জন্য পর্যাপ্ত খাট নেই। একটি বিছানায় দুজনের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। মেঝেতে শুয়ে আছেন কেউ কেউ। এখানে একটি ক্যারামবোর্ড রয়েছে। ‘জীবনের আলো’ কেন্দ্রে ৩০ জন রোগীকে পাওয়া যায়। টিনশেডের এই বাড়ির মেঝেতে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখানেও রোগীরা মেঝেতে ঘুমান। ১০ শয্যার কেন্দ্রে যেসব সুবিধা থাকার কথা তার কিছুই নেই এখানে। ‘নিউ তরী মাদকাসক্ত সেবা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র’র নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ হেলাল জানান, এটি ১০ শয্যার। বাড়তি রোগী থাকলেও সবাই এখানে থাকেন না। অনেকেই বাইরে থেকে এসে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরে যান। এখন ১০ জন রোগী আছেন। জেনারেটর না থাকলেও জরুরি বিদ্যুতের জন্য জেনারেটর লাইন ভাড়া নেয়া আছে। নিবন্ধন নিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা নিবন্ধনের জন্য প্রকল্প প্রস্তাবনা জমা দিয়েছি। কর্মকর্তারা ফাইল জিম্মি করে ধান্দা করছেন।
ঢাকা উদ্যানে ‘ফিউচার মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে’র কর্মসূচি সমন্বয়কারী সৈয়দ ইসকান্দার আলী জানান, বিধিমালায় লাইসেন্স পাওয়ার জন্য যেসব শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে, তার অনেকটাই অপ্রয়োজনীয় এবং কঠিন। তার মতে, মনোরোগ চিকিৎসক, একজন চিকিৎসক, দুজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স বা বয়, একজন সুইপার বা আয়া, জেনারেল ইস্ট্রুমেন্ট সেট, রোগী বহনের ট্রলি, স্ট্রেচার, বেডপ্যান, ফ্লোমিটার ও মাস্কসহ অক্সিজেন সিলিন্ডার, সার্জিক্যাল কাঁচি, বেডের কোনো প্রয়োজন নেই। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, অধিকাংশ মালামাল অব্যবহৃত থাকবে। সারাদিন একজন চিকিৎসক কাজ না করে বসে থেকে তিনি এখানে চাকরি করতে চাইবেন না। এ ছাড়া লাইসেন্সের শর্তে বলা আছে, আবেদনপত্রে যে ঠিকানা উল্লেখ করা হয়, সেখানেই কেন্দ্রের কাজ পরিচালনা করতে হবে। এ শর্তটিও ঠিক নয় বলে তিনি মনে করেন। তার মতে, ঢাকা শহরের অধিকাংশ কেন্দ্রে বাড়ি ভাড়া নিয়ে পরিচালনা করতে হয়। ফলে বাড়িওয়ালার সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেই কেন্দ্রটি অন্যত্র সরিয়ে নিতে হয়।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারি পর্যায়ে মাদকাসক্তি পরামর্শ কেন্দ্র, মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র ও মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা বা সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য ২০০৫ সালের জুনে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে একটি বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়। এ বিধিমালার ৪ (খ) ধারায় বলা হয়েছে, ওই কেন্দ্র সুরক্ষিত পাকা বাড়িসহ আবাসিক এলাকায় হতে হবে এবং এতে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের সুবিধাসহ নিরিবিলি সুন্দর পরিবেশ থাকতে হবে। খ ধারায় বলা আছে, ওই কেন্দ্রে একজন মাদকাসক্ত রোগীর জন্য গড়ে কমপক্ষে ৮০ বর্গফুট জায়গা থাকতে হবে এবং পর্যাপ্ত নিরাপত্তার জন্য সুরক্ষিত ব্যবস্থা থাকতে হবে। এ ছাড়া বহুতল ভবনের তৃতীয় তলা বা তার চেয়ে ওপরের তলায় অবস্থিত হলে ওঠানামার জন্য লিফটের ব্যবস্থা থাকতে হবে। গ ধারায় বলা আছে, প্রতি ১০ বিছানার জন্য পৃথক একটি টয়লেট ও পানীয় জলের সুব্যবস্থাসহ কমপক্ষে একজন মনোচিকিৎসক (খ-কালীন বা সার্বক্ষণিক), একজন চিকিৎসক, দুজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স বা বয়, একজন সুইপার বা আয়া এবং জীবন রক্ষাকারী উপকরণ ও অত্যাবশ্যক ওষুধপত্র থাকতে হবে। এছাড়া প্রতি রোগীর জন্য একটি করে বিছানাসহ খাট, খাটের পাশে লকার বা টেবিল। জরুরি বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য জেনারেটরের ব্যবস্থা থাকার কথা থাকলেও অধিকাংশ কেন্দ্রে তা নেই।
অব্যবস্থাপনায় মাদকাসক্তি
নিরাময় কেন্দ্র :
চিকিৎসার নামে রোগীর ওপর শারীরিক নির্যাতন, মাদকের ব্যবসা পরিচালনা ও রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে ইচ্ছামতো অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে অধিকাংশ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে। বেসরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় ও মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা এবং পরিচালনার জন্য আবাসিক এলাকার পাকা বাড়ি বা ভবনে অবস্থিত, পর্যাপ্ত আলো-বাতাস, নিরিবিলি সুন্দর পরিবেশ হতে হবে। একজন রোগীর জন্য কমপক্ষে ৮০ বর্গফুট জায়গা, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা থাকতে হবে। অন্যদিকে প্রতি ১০ বেডের জন্য পৃথক একটি টয়লেট, বাথরুম, বিশুদ্ধ পানি অন্যান্য সুব্যবস্থা এবং খ-কালীন বা সার্বক্ষণিক একজন মনোচিকিৎসক, সার্বক্ষণিক একজন ডাক্তার, দু'জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স বা বয়, একজন সুইপার বা আয়া এবং জীবন রক্ষাকারী উপকরণ ও অত্যাবশ্যক ওষুধপত্রাদি থাকতে হবে। এ ছাড়া মাদকাসক্ত ব্যক্তির রক্ত, কফ, মলমূত্র ইত্যাদি পরীক্ষার জন্য অনুমোদিত যেকোনো ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে সম্পৃক্ত ও চিকিৎসা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সংরক্ষণের সুবিধা থাকতে হবে। কেন্দ্রে একক বা দলগত পরামর্শক এবং মানসিক বিনোদনের জন্য অভ্যন্তরীণ খেলাধুলা, পত্রিকা, ম্যাগাজিন, টেলিভিশন ও কাউন্সেলিংয়ের জন্য ২০ জনের উপযোগী একটি শ্রেণীকক্ষ থাকা প্রয়োজন। কিন্তু বেশিরভাগ নিরাময় কেন্দ্র মানছে না এ নিয়ম।
নোংরা এলাকার পুরনো ভবনে ১২ বেড নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে দিশারী কেন্দ্রটি। খিলগাঁওয়ের ভূঁইয়াপাড়ার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশনের প্রান্তি নামক কেন্দ্রটি মেঝেতে ঢালা বিছানায় ২০-৩০ জনের বেডে পরিচালিত হচ্ছে। এক যুবক সম্প্রতি একটি নিরাময় কেন্দ্র থেকে বের হয়ে অভিযোগ করেন, তারা নিম্নমানের খাবার দিতো। কথা বললেই শারীরিক নির্যাতন করতো। অথচ থাকা-খাওয়ার জন্য প্রতি রোগীর পরিবার থেকে মাসে ৬-১৮ হাজার টাকা আদায় করা হয়। অপর এক ব্যক্তি জানান, কেন্দ্রে রোগীদের চিকিৎসার জন্য কিছু মাদক ব্যবহারের অনুমতি নিয়ে তা বাইরের লোকজনের কাছে বিক্রি করে। কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছিলো না। জানা যায়, রাজধানীতে অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ, ছোট ছোট রুম নিয়ে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে। এ বিষয়ে ধোলাইর পাড়ের নবনির্মিত আধুনিক ও ডিজিটাল পদ্ধতির সুন্দর জীবন মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের চেয়ারম্যান শফিকউল্লাহ বলেন, আমার মূল লক্ষ্য প্রকৃত সেবার মাধ্যমে সমাজের অবহেলিত বা যেকোনো মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে চিকিৎসা সেবার মাধ্যমে তাদের সুন্দর জীবনে ফিরিয়ে আনা। তাই সব নিয়ম মেনে সেবা প্রদানের চেষ্টা করছি। কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের একটি সূত্র দাবি করেছে, লোকবলের অভাবে সঠিক তদারকি করা সম্ভব হচ্ছে না। সারাদেশে সরকারি চারটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে আসন রয়েছে মাত্র ৫৫টি। কিন্তু রোগীর চেয়ে এ আসন সংখ্যা খুবই সীমিত। রয়েছে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সঙ্কট। ডাক্তারের জন্য আবেদন করা হয়েছে। আশা করি, সব সমস্যা অচিরেই সমাধান হয়ে যাবে।
নীতিমালা ছাড়াই চলছে
মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র :
রাজধানী ঢাকা শহরের পাঁচ শতাধিকসহ দেশের প্রায় দু’হাজার মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে পরিচালিত হলেও সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে এর কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। অনুমোদনহীনভাবে চলছে এগুলো। অনেক ক্ষেত্রে টাকা দিয়ে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে চলছে এর কার্যক্রম। এসব জায়গা থেকে চিকিৎসাসেবা নিয়ে সুস্থ জীবনে ফিরে এসেছে এমন নজির কম। কেউ কেউ চিকিৎসা নিয়ে কিছুদিন ভালো থাকলেও আবারও তাকে ফিরে আসতে হচ্ছে। এ সুযোগে অভিনব পদ্ধতিতে নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসার নামে একটি চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। অথচ ওসব কেন্দ্রের অধিকাংশের নেই কোনো বৈধ অনুমোদন এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভাড়া বাসা নিয়ে ব্যাঙের ছাতার মতো দিন দিন গজিয়ে ওঠছে নতুন নতুন মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র।
দেখা যায়, বেশিরভাগ নিরাময় কেন্দ্রে তালা মেরে রাখা হয় মাদকাসক্তদের। ভয়ঙ্কর মাদকাসক্তদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে পরিবারের লোকেরা এসব চিকিৎসা কেন্দ্রে পাঠিয়ে নানা রকম উৎকণ্ঠায় থাকেন। সম্প্রতি রাজধানীর একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে মাদকাসক্তির অভিশাপ থেকে সুস্থ জীবনে ফিরে আসতে ভর্তি হয়েছেন এক যুবক। কিন্তু ওই কেন্দ্রে তাকে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলে থাকা অবস্থায় লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনার পর নিরাময় কেন্দ্রে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে পলাতক রয়েছে পরিচালক বাবুল।
মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের
রোগীদের অভিযোগ:
সম্প্রতি একটি নিরাময় কেন্দ্র থেকে বের হয়ে আসা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক যুবক অভিযোগ করেন, তিনি যেখানে ছিলেন, সেখানে খাবারের মান খুবই নিম্নমানের। বাইরে থেকে কোনো খাবার কিনে খাওয়ার সুযোগ না থাকায় বাধ্য হয়েই ওই খাবার খেতে হয়েছে। খাবারের মান নিয়ে কোনো কথা বলার সুযোগ নেই। কথা বললেই শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। অথচ থাকা-খাওয়ার জন্য একেকজন রোগীর পরিবারের কাছ থেকে প্রতি মাসে পাঁচ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়।
অপর এক ব্যক্তি জানান, তিনি যে কেন্দ্রে ছিলেন, ওই কেন্দ্রে রোগীদের চিকিৎসার জন্য কিছু মাদক ব্যবহারের অনুমতি ছিলো। কর্তৃপক্ষ ওই মাদক বাইরের লোকজনের কাছে বিক্রি করে থাকে। এছাড়া পরিবারের কাছ থেকে যে পরিমাণ টাকা আদায় করা হয়, তার কিছু অংশ রোগীর পেছনে ব্যয় করে বাকি টাকা তাদের পকেটস্থ করা হয়।
কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র জানায়, অবৈধভাবে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে তাদের কাছে ৮০টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা রয়েছে যারা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে অনুমোদন না নিয়ে নিরাময় কেন্দ্র খুলে বসেছেন। এসব নিরাময় কেন্দ্রের মধ্যে রাজধানীতে ৩৫টি, রাজধানীর বাইরে ঢাকা উপ-অঞ্চলে ১৩টি, দিনাজপুর উপ-অঞ্চলে দুটি, কক্সবাজার উপ-অঞ্চলে দুটি, বগুড়া উপ-অঞ্চলে চারটি, ময়মনসিংহে নয়টি, রংপুরে একটি, খুলনায় তিনটি, নোয়াখালীতে দুটি এবং রাজশাহীতে আটটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে।
নিবন্ধনকৃত প্রতিষ্ঠান :
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ঢাকা মেট্রো উপ-অঞ্চলের তৈরিকৃত তালিকা অনুযায়ী যেসব প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন নিয়েছে সেগুলো হলোÑ মধ্য বাড্ডার সেতু মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্র, এলিফ্যান্ট রোডের সেবা মাদকাসক্তি ও মানসিক রোগ চিকিৎসা কেন্দ্র, উত্তর গোড়ানে প্রশান্তি মাদকাসক্তি চিকিৎসায় মনোবিকাশ ও পুনর্বাসন সহায়তা কেন্দ্র, মোহাম্মদপুরে ক্রিয়া মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্র, মিরপুরে ফেরা মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্র, উত্তরায় লাইট হাউস ক্লিনিক, নিকুঞ্জ-২-এ দিশা মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্র, গুলশান-২-এ মুক্তি মানসিক অ্যান্ড মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র লিমিটেড, ফার্মগেটে হাইটেক মডার্ন সাইকিয়াট্রিক হাসপাতাল প্রাইভেট লিমিটেড ও বারিধারা আবাসিক এলাকায় প্রত্যয় মেডিকেল ক্লিনিক লিমিটেড।
অবৈধ প্রতিষ্ঠান
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ঢাকা মেট্রো উপ-অঞ্চল রাজধানীতে পরিচালিত অবৈধ কেন্দ্রের তালিকা তৈরি করেছে। এ তালিকায় যেসব কেন্দ্রের নাম স্থান পেয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মোহাম্মদপুরের স্যার সৈয়দ রোডে বারাক, মনোচিকিৎসালয়, বাংলাদেশ ইয়ুথ ফাস্ট কনসার্স, মোহাম্মদী হাউজিংয়ে জীবনের ঠিকানা, ঢাকা উদ্যানে ফিউচার, জীবনের আলো, নিউ তরী, রায়ের বাজারে আশার আলো, আজিজ মহল্লায় নতুন জীবনে ফিরে আসা, উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরে রি-লাইফ, ৭ নম্বর সেক্টরে ফেরা, ৯ নম্বর সেক্টরে সেবা, ৪ নম্বর সেক্টরে গ্রিন লাইফ, ৩ নম্বর সেক্টরে দীপ জ্বেলে যাই, এলিফ্যান্ট রোডে নিউ মুক্তি ক্লিনিক, পশ্চিম যাত্রাবাড়ীতে নতুন জীবন মাদকাসক্তি ও চিকিৎসা পুনর্বাসন কেন্দ্র, হাদী মাদকতা হ্রাস কমপ্লেক্স, উত্তর যাত্রাবাড়ীতে দিশারী মাদকসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র, উত্তর শাহজাহানপুরে নির্বাণ মাদকাসক্তি নিরাময় ক্লিনিক, মালিবাগে হলি লাইফ মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র, বাড্ডার ছোলমাইদ পূর্ব পাড়ায় ক্লিন লাইফ, নবজন্ম, বাড্ডার এভারগ্রিন, পশ্চিম রামপুরায় সমর্পণ, রামপুরের ডিআইটি রোডে স্নেহ নীড়, খিলগাঁওয়ে আশার আলো, গ্রিন রোডে লাইফ অ্যান্ড লাইট হসপিটাল, ব্রেন অ্যান্ড লাইফ হসপিটাল, ব্রেন অ্যান্ড মাইন্ড হসপিটাল প্রাইভেট লিমিটেড, পশ্চিম পান্থপথে মনমিতা মানসিক হাসপাতাল, কাজীপাড়ায় রমজান ক্লিনিক, মিরপুর কাওলাপাড়ায় গোল্ডেন লাইফ, ফিউচার লাইফ, ফ্যায়িদ, নব স্বপ্ন পুনর্বাসন সমাজকল্যাণমূলক সংস্থা, পল্লবীতে ঢাকা মনোরোগ ক্লিনিক, লালবাগে মধুমিতা ক্রিয়া প্রকল্প ও ইস্কাটন গার্ডেন রোডে সারডা উল্লেখযোগ্য।
সরকারের কি কিছুই করার নেই
মাদকের বিষে দেশের ভবিষ্যত ধাবিত হচ্ছে মৃত্যুর সুনিশ্চিত গন্তব্যে। মাদকের ছোবলে ভাঙ্গছে সংসার, ধসে পড়ছে সমাজ, হারিয়ে যাচ্ছে মেধা। বাড়ছে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, খুন। সন্তানের হাতে জীবন দিচ্ছে বাবা-মা, বাবা-মার হাতে নিভছে সন্তানের জীবনপ্রদীপ। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে খুনোখুনি হচ্ছে নিত্যদিন।
এমন দুর্বিসহ বাস্তবতায় রাষ্ট্র যেন অনেকটাই উদাসীন। রাষ্ট্রের যৎসামান্য দু-একটা উদ্যোগ দুর্নীতি ও অবহেলার শিকার হয়ে বিশাল ক্ষত নিরাময়ে তেমন কোনো ভূমিকাই রাখতে পারছে না। অথচ সরকার চাইলে মাদক নিয়ন্ত্রণ এবং মাদকাসক্তি নিরাময়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে সহজেই।
মাদক নিরাময় বিষয়ে কথা হয় মোহাম্মদপুর ঢাকার জামিয়া রাহমানিয়ার সিনিয়র মুহাদ্দিস আল্লামা আশরাফ আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিক শিক্ষার অভাবে সমাজে মাদকাসক্তের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, স্কুল কলেজ ও মাদরাসার ধর্মীয় শিক্ষকগণকে সরকারি উদ্যোগে বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উপযোগী করে তোলার ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। এ খাতে সরকারের যৎসামান্য বরাদ্দ রাখতে হলেও তা বহুগুণে সুফল বয়ে আনবে। প্রতিটি গ্রাম-গঞ্জে পাড়া-মহল্লায় উঠতি বয়সের তরুণ প্রজন্মকে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাদানের মাধ্যমে মাদক আগ্রাসনের পাগলা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরা সম্ভব। পাশাপাশি ইমাম ও ধর্মীয় শিক্ষকদের নিয়ে মনিটরিং টিম গঠন করে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রগুলো মনিটরিং এর ব্যবস্থা নিলে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রগুলোর মাদক ব্যবসা এবং অনিয়ম প্রতারণাও দিন দিন হ্রাস পাবে।
তবে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা মাদক নিয়ন্ত্রণ এবং মাদকাসক্তি নিরাময়ে আসলেই কতটুকু আন্তরিক, সে প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়।
http://www.weeklylikhoni.com/news.php?content_id=11
http://www.amiopari.com/14338/