মানুষের আচার-আচরণের মাপকাঠি হচ্ছে মূল্যবোধ। মূল্যবোধ অর্জনে শুধু পাঠ্য শিক্ষাই যথেষ্ট নয়। তার জন্য পরিবার, সমাজ ও সমাজস্থ প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কেউ শিক্ষিত হয় সার্টিফিকেট সর্বস্ব কিন্তু নিজের শিক্ষার জ্ঞান, রুচিবোধের থেকে অপরের প্রতিষ্ঠিত পদের মর্যাদাকে কেউ কেউ নিজ পরিচয়ে মানদণ্ড হিসাবে গ্রহণ করে। এতে শুধু তার মর্যাদাই ক্ষুণ্ন হয়না! ক্ষুণ্ণ হয় আপন শিক্ষার গৌরবও। যেমন- কেউ যদি মাস্টার্স পাস করা উচ্চশিক্ষিতা কর্মজীবী হয়ে নিজের পরিচয়কে তুচ্ছ ভেবে স্বামীর পদের পরিচয়ে গর্বিত হন, তবে সে শুধু নিজেকেই ছোট করেননা বরং তার স্বামীকেও ছোট করেন। কারণ আমি মনেকরি, যে নিজেকে মর্যাদা দিতে জানেনা সে অপরের মর্যাদাবোধ সম্পর্কে সচেতন নন। শুধু শিক্ষা গ্রহণই যদি হ-য-ব-র-ল শিক্ষার মত হয়, সেখানে পারিবারিক শিক্ষার যেমন মর্যাদা থাকেনা তেমনি বৃহৎ অঙ্গনে চলার ফলে যে অভিজ্ঞতা অর্জন হয় তাও ব্যর্থ হয়-সমগ্র অর্জন তথা মানুষ হিসাবে চলার পথে। শিক্ষা শুধু মূল্যবোধজনিত হয়, তা নয় কিন্তু মূল্যবোধের শিক্ষাকে উপলব্ধির দ্বারা অর্জন করাই জ্ঞানীর কাজ। জ্ঞান সবার থাকতে পারে কিন্তু সবাই জ্ঞানী নয়, অনুরূপ মেধা সবার থাকতে পারে কিন্তু মেধাবী সবাই নন। মেধাহীন হলেই যে তার মধ্যে মূল্যবোধ নেই এমনটা বলা যাবেনা। আমি বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, অনেক অশিক্ষিত এবং অর্ধশিক্ষিতরা আছেন যারা অসম্ভব রকমের সৃজনশীল মূল্যবোধের উদাহরণ হতে পারেন। আবার অনেকে আছেন যারা শিক্ষিত হয়ে সর্বোচ্চ পদমর্যাদায় ভূষিত হয়েছেন, তাদের মূল্যবোধের পরিচয় ক্ষীণ ও দুর্বল। আপনাদের অনেকেই মনে করতে পারেন আমি শিক্ষিতদের ছোট করছি-আসলে বিষয়টি এমনভাবে ভাবা ঠিক হবেনা, তবে এমন হবে কেন সেটা আমারও জিজ্ঞাসা।
আমরা সাধারণেরা পদের আসীন মানুষের থেকে পদটাকেই বেশি শ্রদ্ধা করি। এ শ্রদ্ধাভক্তি জোড় করে আসেনা। বরং শ্রদ্ধাভক্তি আসে মূল্যবোধের নির্ভরযোগ্য ভালবাসা থেকে। যদি দেখা যায়, পদে আসীন হওয়া মানুষটি তার পদের যথাযথ বা উপযুক্ত, তবে পদের মর্যাদার সাথে ঐ মানুষের মর্যাদা সমহারে যুক্ত হয়। আর যদি বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যায় তবে পদের সুনামের অংশে ব্যক্তির দুর্নাম যুক্ত হয়ে মূল্যবোধের অবক্ষয় জনিত ব্যধির প্রকাশ চরম আকার ধারণ করে।
সমাজে এমন অনেক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ আছেন যারা নিজের অবস্থানকে বিচার বিশ্লেষণে যাননা বরং অপরের মূল্যবোধ যাচাই করে নিজের ভিত্তিকে মজবুত করতে উৎসাহী হন। রাষ্ট্রের বা প্রজাতন্ত্রের অনেক দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি আছেন, যারা শুধু নিজের কৃতিত্বকেই বড় করে দেখেন বা দেখতে অভ্যস্ত, তার যদি সামান্যতম বিপদের আচ করেন তবে সম্পর্কের জাল তৈরি করে অধীনস্তের স্বাধীন মূল্যবোধকে গ্রাস করতে উদ্ধত হন।
মূল্যবোধের চিন্তা ধরা বা ছোয়া যায়না, এটা উপলব্ধির বিষয়। যা শুধু ব্যক্তির ভালমন্দের কাজের ক্রিয়ানকের ইচ্ছা স্বাধীনতাকে প্রকাশ করে। আপনারা হয়তো অনেকেই আশ্চর্য হবেন এমন বক্তব্য লেখার উদ্দেশ্য কী! উদ্দেশ্য ভিন্ন মত নেই। আমি কেবল সমাজের কিছু প্রতিষ্ঠিত মানুষের ইচ্ছা বা অনিচ্ছার সেই মানদণ্ডকেই তুলে ধরছি যা মূল্যবোধের মাপকাঠিতে বিচার হয়।
মানুষ কর্মের মধ্যে বাঁচে বলেই সে স্বাধীন হতে শেখে। এখানে স্বাধীনতার হিসাবটা একেবারে অংকে কষা-যা হয়তো পীথাগোরাস কিংবা লগের হিসাবে মেলানো যায় কিন্তু পরিমাণ সংখ্যায় প্রকাশ অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। মিথ্যার রুচিবোধ নিয়ে মূল্যবোধেরবাণী প্রচার হতাশার চেয়ে চরম হতাশার জন্ম দেয়। জ্ঞানের সাথে বিজ্ঞানের চিন্তা করা যায় কিন্তু আত্নার সাথে আত্নশুদ্ধির চিন্তা করা বেশ কঠিন। যারা সুবিধাভোগী তারা সরলদোলকে হিসাব কষে কিন্তু মন বা আত্নার উপলব্ধির সীমা নেই-তাই তাকে বিচার করে মূল্যবোধ। জাগ্রতচিন্তাকে অবচেতনে ফেলে হিসাব করা সত্যিই দুঃখজনক, কেননা মানুষ শৃঙ্খলার মধ্যে থাকে মূল্যবোধের দ্বারা। জীবনে মানুষ যতটা ভুল করে তার ৯৯%-ই মূল্যবোধজনিত ভুল। ১০০% ভুল এজন্য বলবনা কারণ কিছু ভুল-ভুল নয়। বরং এটি সমস্যা। আর সমস্যাকে সমস্যার মত বিশ্লেষণে নিয়ে যায় যেমন মূল্যবোধ। তেমনি সমস্যা উত্তোরণের পথও দেখায় নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির মূল্যবোধজনিত আদর্শ। নেশার ঘোরে কেউ মাতাল হতে পারে কিন্তু মাতালের বৈশিষ্ট্য ধ্বংস হয় বিপরীত প্রতিক্রিয়ায়। এ ক্রিয়াটি সঠিক কিংবা জবাবদিহিমূলক হবে কিনা, সেটি নির্ভর করে মূল্যবোধে দৃষ্টির উপর। সমাজে যা কিছু স্বীকৃত, রাষ্ট্র তাকে অস্বীকার করেনা। সমাজের স্বীকৃতিই রাষ্ট্রের স্বীকৃতি। মূল্যবোধের স্বীকৃতি ব্যক্তি পর্যায়ে আসে আর ব্যক্তি-ব্যক্তি মিলে দল বা গোষ্ঠীগত স্বীকৃতির মূল্যবোধ যাচাই হয়। আর এখান থেকেই যে সারমর্ম দ্বারায় তা হচ্ছে-মূল্যবোধের চরমপত্র।